শেখ হাসিনা তিন দশক আগে ১৯৮১ সালের এই দিনে দীর্ঘ নির্বাসন শেষে তিনি বাংলার মাটিতে ফিরে আসেন। ওই দিনটি ছিল রবিবার। ওই দিন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে একনজর দেখার জন্য বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত এলাকাজুড়ে লাখো জনতার ঢল নামে। সারাদেশের গ্রাম-গঞ্জ-শহর-নগর-বন্দর থেকে অধিকার বঞ্চিত মুক্তিপাগল জনতা সেদিন ছুটে এসেছিল রাজধানী ঢাকায়। এ সময় সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকামী লাখো কণ্ঠের শ্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা বিমানবন্দর এলাকা। সেদিনের গগনবিদারী মেঘ গর্জন, ঝাঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ প্রকৃতি যেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার বদলা নেওয়ার লক্ষ্যে গর্জে উঠেছিল ।
২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাই শেখ হাসিনার প্রাণনাশের প্রথম বা শেষ চেষ্টা নয়। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বিদেশে থাকার কারণে বোন শেখ রেহানাসহ বেঁচে গেলেও দেশে ফেরার পর থেকেই শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে বারবার।গত সাড়ে তিন দশকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য চেষ্টা হয়েছে কমপক্ষে ১৯ বার। মানুষের দোয়া এবং আল্লাহর অসীম কৃপায় বারবারই তিনি বেঁচে গেছেন।
শেখ হাসিনার ওপর প্রথম বড় হামলা হয় ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে ৮ দলীয় জোটের মিছিলে। শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে পুলিশ এবং বিডিআর গুলি করলে সাতজন নিহত হন, আহত হন তিনশ মানুষ।
এর পরের হামলা ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে। ইত্তেফাকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুক-রশিদের ফ্রিডম পার্টির একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে হামলা চালায়। বঙ্গবন্ধু কন্যা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তখন বাসভবনে ছিলেন। হামলাকারীরা ৭/৮ মিনিট ধরে বঙ্গবন্ধু ভবন লক্ষ্য করে গুলি চালায় ও একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। তবে গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হয়নি।
শেখ হাসিনার প্রাণনাশের তৃতীয় চেষ্টা হয় ১৯৯১’র ১১ সেপ্টেম্বর। টুঙ্গিপাড়া থেকে ফিরে বেলা আড়াইটার দিকে ধানমন্ডি স্কুলে উপনির্বাচনের ভোট দেয়ার পর তিনি গ্রিনরোডে পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রে ভোটের পরিস্থিতি দেখতে যান। ‘গাড়ি হইতে নামার সঙ্গে সঙ্গেই বিএনপির ওয়াহিদের নেতৃত্বে বিএনপি’র কর্মীরা গুলিবর্ষণ ও বোমা বিস্ফোরণ করিতে শুরু করে। ২০/২৫ রাউন্ড গুলি ও বোমাবর্ষণ হয়।’( দৈনিক ইত্তেফাক ১২.০৯.১৯৯১)
তিন বছরের মাথায় ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৪ ঈশ্বরদী ও নাটোর রেল স্টেশনে প্রবেশের মুখে শেখ হাসিনাকে বহনকারী রেলগাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হয়। (দৈনিক সংবাদ ২৪.০৯.১৯৯৪)
ইত্তেফাক জানাচ্ছে, সোয়া এক বছরের মধ্যে ১৯৯৫ সালের ৭ ডিসেম্বর রাসেল স্কয়ারের কাছে সমাবেশে ভাষণ দেওয়ার সময় গুলিবর্ষণ করা হয় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার উপর।
ষষ্ঠ হামলাটি হয় ১৯৯৬ সালের ৭ মার্চ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতার পর হঠাৎ একটি মাইক্রোবাস থেকে সভামঞ্চ লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ ও বোমা নিক্ষেপ করা হয়। এতে অন্তত ২০ জন আহত হন বলে ইত্তেফাকের পরদিনের সংবাদে জানানো হয়।
ওই হামলার কয়েক মাসের মাথায় তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পরও হত্যা চেষ্টা ও ষড়যন্ত্র চলতে থাকে।
১৯৯৯ সালের ১২ জুলাই দৈনিক জনকণ্ঠের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পুত্রকন্যাসহ ৩১ জনকে হত্যার জন্য পুরস্কার ঘোষণার ই-মেইলটির প্রেরক ইন্টার এশিয়া টিভির মালিক শোয়েব চৌধুরী। শেখ হাসিনাকে হত্যা, গণতন্ত্রিক সরকারকে উৎখাত এবং বিদ্বেষ সৃষ্টির লক্ষ্যে ই-মেইল প্রেরণের অভিযোগে শোয়েব চৌধুরীর বিরুদ্ধে ঢাকার সিএমএম আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
শুধু হুমকির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না ষড়যন্ত্রকারীরা। ২০০০ সালের ২২ জুলাই ইত্তেফাক জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (হুজি) ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় জনসভাস্থলের কাছে এবং হেলিপ্যাডের কাছে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রেখেছিলো। এই বোমা গোয়েন্দাদের কাছে ধরা পড়ে। বোমাটি বিস্ফোরিত হলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো জনসভাস্থল। ২২ জুলাই বেলা সাড়ে দশটায় শেখ লুৎফুর রহমান ডিগ্রি কলেজ মাঠে ওই জনসভায় প্রধানন্ত্রীর বক্তব্য রাখার কথা ছিলো।
সেবার প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে শেষ চেষ্টা হয় ২০০১ সালের ২৯ মে। খুলনার রূপসা সেতুর নির্মাণকাজ উদ্বোধন করতে যাওয়ার কথা ছিলো তার। জঙ্গি সংগঠন হুজি আবারো সেখানে বোমা পুঁতে রাখে যা গোয়েন্দা পুলিশ উদ্ধার করে। পরে হুজি স্বীকার করে, তারাই হত্যা চেষ্টা চালিয়েছিলো।
এই হত্যা চেষ্টার কয়েক মাসের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন শেখ হাসিনা। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেট গিয়েছিলেন তিনি। সেদিন রাত ৮ টার দিকে জনসভাস্থল থেকে ৫০০ গজ দূরে একটি বাড়িতে বোমা বিস্ফোরিত হলে ঘটনাস্থলেই দুই জনের মৃত্যু হয়। আগেই বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় ভেস্তে যায় শেখ হাসিনাকে হত্যা প্রচেষ্টা। হরকাতুল জিহাদ হুজি এই হত্যা চেষ্টার কথা স্বীকার করে।
সিলেটের ওই হত্যা চেষ্টাটির মতো ২০০২ এর ৪ মার্চ আরেকটি হত্যা চেষ্টার কথা জানায় বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক। প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়, যুবদল ক্যাডার খালিদ বিন হেদায়েত নওগাঁয় বিএমসি সরকারি মহিলা কলেজের সামনে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে হামলা চালায়।
এভাবে বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা চলতেই থাকে। ২০০২ সালে ৩০ সেপ্টেম্বর বিএনপি-জামাত নেতা-কর্মীরা সাতক্ষীরার কলারোয়ার রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে শেখ হাসিনার ওপর হামলা চালায় বলে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক জানায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষমতাসীন জোটের এমপির প্রত্যক্ষ মদদে জোট সন্ত্রাসীরা শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে হামলা চালায়।
শেখ হাসিনার ওপর ১৩তম হামলা ঘটে ২০০৪ সালের ২ এপ্রিল। বরিশালের গৌরনদীতে শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে গুলিবর্ষণ করে জামায়াত-বিএনপি।
এরপর সেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে শান্তি সমাবেশস্থলে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও নিহত হন আইভি রহমানসহ ২৪ নেতাকর্মী। হামলায় আরও ৪শ জন আহত হন। আহতদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। তাদের কেউ কেউ আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মেজর ডালিম এ অভ্যুত্থান পরিকল্পনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলো। হংকং, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় বসে এ অভ্যুত্থান চেষ্টার পরিকল্পনা চলছিলো। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৬ জন অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত সদস্য এতে জড়িত ছিলেন। হংকংয়ে বসবাসরত বাংলাদেশী ব্যবসায়ী ইশরাক আহমেদ এ পরিকল্পনায় অর্থায়ন করে বলে গোপন বার্তায় উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকাশিত নথি অনুসারে, এ ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টা এবং পরিকল্পনায় খালেদা জিয়া, তারেক জিয়া ও জামায়াতে ইসলামীর সংশ্লিষ্টতা ছিলো। (দৈনিক যুগান্তর, ৪ জুলাই, ২০১৫)
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র এবং অভ্যুত্থানের আরেকটি পরিকল্পনার কথা স্বীকার করেছে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান বিস্ফোরণের ঘটনায় গ্রেফতার নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবি নেতা শাহানুর আলম। নিরাপত্তা বাহিনীর বরাত দিয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা এবং অভ্যুত্থানের মাধ্যমে 'বৃহত্তর ইসলামিক রাষ্ট্র' গড়ার ষড়যন্ত্র করছিলো জেএমবি। শাহানুরের স্ত্রী সুজেনা বলে, রাজীব গান্ধী হত্যাকাণ্ডের মতো নারী ‘মানববোমা’ ব্যবহার করে শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা ছিলো তাদের
শেখ হাসিনাকে হত্যার সর্বশেষ চেষ্টা হয়েছে ২০১৫ সালের ৭ মার্চ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার সময়ে কারওয়ানবাজারে তার গাড়িবহরে বোমা হামলা চালানোর চেষ্টা চালায় জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। শেখ হাসিনার যাওয়ার পথে কাওরানবাজার এলাকায় পর পর কয়েকটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। বর্ধমান খাগড়াগড় থেকে পালিয়ে আসা জেএমবির জঙ্গিরাই প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহরে বোমা হামলা চালিয়েছে। এই বোমা হামলার নেতৃত্ব দিয়েছে কওসর ওরফে বোমা মিজান। তার সঙ্গে রয়েছে হাত কাটা নাসিরুল্লাহ ওরফে সুহেল, তালহা শেখ, সালাউদ্দিন শেখ ওরফে হাফিজুর রহমান ওরফে মাহিন ও রফিক। (দৈনিক জনকন্ঠ তারিখ: ১১/০৩/২০১৫)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০১৬ দুপুর ১২:৩৫