বাংলাদেশে আজ থেকে ১০-১৫ বছর আগে লেখালেখির জন্য বেশি জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল কমিউনিটি ব্লগিং সাইটগুলো। এর মধ্যে কয়েকটি ওয়েবসাইট ভিউয়ার সংখ্যার দিক দিয়ে শীর্ষে উঠে আসে। কিন্তু এক সময় যে ব্লগ নিয়ে এতো মাতামাতি ছিল সেটা আর এখন দেখা যায় না।
এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন বিভিন্নভাবে ব্লগিংকে বিতর্কিত করা, ব্লগারদের হত্যার ঘটনা, সেসব মামলার বিচারকাজ নিষ্পত্তি না হওয়া এবং স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের ওপর সরকারের নজরদারি, লেখালেখির এই মাধ্যমটিকে ঘিরে এক ধরণের আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে।
তার মধ্যে তথ্য প্রযুক্তিগত পরিবর্তনকেও আরেকটি বড় কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশের কমিউনিটি ব্লগিং প্ল্যাটফর্মগুলিতে এখন যারা সক্রিয় আছেন সেই সংখ্যাটি হাতে গোনা।
বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় ব্লগের যাত্রা শুরু হয় “সামহোয়্যার ইন ব্লগ” এর মাধ্যমে ২০০৫ সালে। এর নিবন্ধিত ব্লগারের সংখ্যা সাত বছরের মাথায় দেড় লাখের ছাড়িয়ে যায়।
এছাড়া সেখানে নিয়মিত লিখতেন অন্তত ১০ হাজার ব্লগার। আবার নির্বাচিত লেখক নিয়ে গড়ে ওঠা ব্লগ-সাইট সচলায়তন ও ছিল আলোচনায়। ওই ব্লগগুলো নিছক শখের বশে গল্প, কবিতা, সাহিত্যের মতো লেখালেখিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না।
বরং এতে সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রসঙ্গ, ইতিহাসসহ বিভিন্ন বিষয় প্রাধান্য পেত। তবে একসময়কার লেখালেখির তুমুল জনপ্রিয় এই মাধ্যম হঠাৎ করেই যেন হারিয়ে গেছে।
এর কারণ হিসেবে সচলায়তনের একজন ব্লগার বলেন, “বাংলাদেশে ব্লগিংকে এক পর্যায়ে খুব নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়। একটি গোষ্ঠী ব্লগারদের নাস্তিক বলে সম্বোধন করতো। এরপর হুমকি ধমকির মুখে অনেক ব্লগার দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। এই সব কিছু মিলিয়ে ব্লগে কেউ আর তেমন লেখালেখি করতে চায় না।”
তথ্য প্রযুক্তির বিকাশ লাভের সাথে সাথে শুধু বাংলাদেশ নয় বরং বিশ্বব্যাপী ব্লগিং এর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছে বলে জানিয়েছেন অনেক তথ্য প্রযুক্তিবিদ।
তাদের মতে, ব্লগের জায়গাটি এখন দখল করে নিয়েছে ফেসবুক এবং টুইটার। বাংলাদেশে ফেসবুক সবচেয়ে জনপ্রিয় যোগাযোগ মাধ্যম হওয়ায় বেশিরভাগ লেখক ফেসবুকের স্ট্যাটাস না হলে নোটসেই লেখালেখি করছেন।
ব্লগের চাইতে ফেসবুকের বেশিরভাগ লেখার মান খারাপ হলেও এর মাধ্যমে দ্রুত হাজার হাজার মানুষের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ রয়েছে। পাঠকরাও সাথে সাথে ফেসবুকে তাদের প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন।
তেমনি ব্লগের মতো নিবন্ধন, সম্পাদনার ঝক্কি ফেসবুকে না থাকাকেও এই ব্লগিং থেকে সরে আসার একটা বড় কারণ বলে মনে করছেন মি. স্বপন। তিনি বলেন, “মানুষ চায় যে তাদের লেখাটা বেশি মানুষের কাছে যাক। ফেসবুক সেক্ষেত্রে ব্লগের চাইতে অনেক গ্রহণযোগ্য মাধ্যম। বিদেশে এখন বেশ প্রেস্টিজিয়াস ব্লগে নামীদামী লেখকরা লেখেন। সাধারণ মানুষ যে ব্লগ করতো, সেটা আর নেই।”
তাছাড়া বাংলাদেশে ব্লগিং নিয়ে বিতর্কের মুখে বেশ কয়েকটি ব্লগ সাইট বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। সেই বাধার মুখে পড়ায় ব্লগ আর আগের রূপে ফিরে আসতে পারেনি বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশে ব্লগিং সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে আন্দোলন চলাকালীন।
সে সময় নির্দিষ্ট দলের পক্ষে বা বিপক্ষে লেখা হতো, আবার রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের উপায় নিয়েও লিখতেন কেউ কেউ।
এক কথায় সে সময় বাক স্বাধীনতা চর্চার প্ল্যাটফর্ম হিসেবেও ব্লগকে বেছে নিয়েছিলেন লেখকরা। সেসময় আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত একজন ব্লগার নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
ইসলামী দলগুলোর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত কেউ কেউ ধর্ম নিয়ে বিভিন্ন ব্লগে আপত্তিকর মন্তব্য করেছে।
ব্লগিং নিয়ে এমন বিতর্কের মুখে বেশ কয়েকজন ব্লগারকে হত্যা, পরবর্তীতে লেখালেখির ওপর সরকারের কঠোরতা আরোপ মত প্রকাশের এই জায়গাটিকে সংকুচিত করেছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন।
তিনি বলেন, “একের পর এক ব্লগার হত্যার পর রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কঠোর কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। মামলার বিচার নিষ্পত্তি হয়নি।
এজন্য হুমকির মুখে ব্লগাররা দেশ ছেড়ে চলে যায়। তারপর সরকার ব্লগিংকে নজরদারিতে আনায় মানুষ যে স্বাধীনভাবে লিখবে সেই জায়গাটা আর থাকেনি।”
অনলাইনে বাংলা ভাষার চর্চাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে এবং তরুণ প্রজন্মকে বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস জানানোর লক্ষ্যে ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে বাংলা ভাষায় ব্লগের যাত্রা শুরু হয়।
এ ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়েই ২০০৯ সালের ১৯শে ডিসেম্বর থেকে প্রতি বছর ব্লগাররা এই দিনটিকে বাংলা ব্লগ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।
তথ্যসূত্রঃ বিবিসি নিউজ বাংলা