৭১১ সালের জুলাই মাস। হিস্পানিয়াতে এসে পৌছালো চারটি বণিক জাহাজ। তখন মরক্কো থেকে প্রায়ই মালবাহী জাহাজ এসে ভিড়তো আইবেরিয়ার বন্দরে, তাই স্থানীয়দের বাড়তি নজর এড়িয়ে নিরাপদে নোঙর করতে সক্ষম হয় বহরটি। কিন্তু মাল খালাসের সময় উপকূলের মানুষজন আবিষ্কার করে এটি কোনো সাধারণ বণিক জাহাজ নয়। প্রায় সাত হাজার বাববার যোদ্ধা আর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এক আরব সেনাপতি এসেছেন স্পেন দখল করতে!
উমাইয়া সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদের নেতৃত্বে এই ছদ্মবেশী মুর যোদ্ধাদের হাতেই পতন হয়েছিলো সেসময় স্পেন শাসন করা ভিসিগথ সাম্রাজ্যের, আর এর মাধ্যমে স্পেনে শুরু হয়েছিলো আরবদের সাড়ে সাতশো বছরের শাসনামল।
ভিসিগথদের সাম্রাজ্য
ভিসিগথ রাজার মুকুট
রোমান সাম্রাজ্যের ভঙ্গুর অবস্থার সুযোগ নিয়ে ফ্রান্সের দক্ষিণ অংশে উত্থান ঘটে ভিসিগথদের। অনেকটা মধ্যযুগে বাংলার নবাবদের মতো, রোমান সম্রাটের প্রতিনিধি হিসাবে শাসন ক্ষমতা পেয়েছিলো তারা। কিন্তু পরবর্তীতে রোমানদের দুর্বলতার সুযোগে তারা নিজেদের প্রদেশে কার্যত স্বাধীন হয়ে যায়। এরপর ৪২৯ সালে তারা স্পেন অধিকার করে এবং এই দুই অংশে ভিসিগথ নামে আলাদা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। একটা পর্যায়ে ফ্রান্সের দখল হারালেও স্পেনে পরবর্তী দুইশো বছর নিজেদের শাসন বজায় রাখতে সক্ষম হয় ভিসিগথ রাজারা। তাদের রাজধানী ছিলো টলেডোতে।
৭১১ সালে যখন তারিক হিস্পানিয়াতে প্রবেশ করেন, তখন ক্রমাগত গৃহযুদ্ধ আর দুর্বল শাসনের ফলে ভিসগথদের সাম্রাজ্য প্রায় ভেঙ্গে পড়েছে।
আগের রাজা উইটিজা-র মৃত্যুর পর রাজপরিবারকে বিতাড়িত করে রাজধানী টলেডোতে ক্ষমতায় বসেছেন রাজা রড্রিক। আর উত্তরাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে বিদ্রোহীরা। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে তারিকের বেপরোয়া হামলার মুখে পড়েন তিনি।
কলকাঠি নাড়া হয়েছিলো ভেতর থেকে
স্পেন জয়ের ঘটনার ভেতর অকস্মিকতা ছিল বটে। তবে, এলাম দেখলাম আর জয় করলাম – ব্যাপারটা আবার এমনও ছিলো না। বরং গৃহযুদ্ধে জর্জর দুর্বল স্পেনে বিদেশী আরবদের ডেকে আনার কাজটি করেছিল এর স্থানীয় শাসকরাই। মোটা দাগে উমাইয়াদের সাথে যোগাযোগের কাজটি করেছিলেন জুলিয়ান নামের একজন কাউন্ট। যুদ্ধযাত্রার আগে একাধিকবার উমাইয়া সেনাপতি মুসা ইবনে নুশাইর সাথে বৈঠক করে যুদ্ধে আরবদেরকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি। এমনকি, তারিকের বাহিনী যে জাহাজগুলোতে করে উপকূলে এসেছিলো সেগুলোও ছিলো জুলিয়ানের দেয়া।
ঠিক কি কারণে জুলিয়ান এই মীরজাফরী-টা করেছিলো, তার পেছনে বেশ কিছু কাহিনী প্রচলিত আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে যে কাহিনীটা সবচেয়ে রসালো সেটা এমন :
শিল্পীর তুলিতে কাউন্ট জুলিয়ানের কন্যা ফ্লোরিডা
রাজার প্রতি আনুগত্যের প্রতীক হিসেবে জুলিয়ান তার শিশুকন্যা ফ্লোরিডাকে পাঠিয়েছিলো রড্রিকের রাজদরবারে। প্রথা অনুযায়ী, যৌবনে পদার্পণের পর সসম্মানে পিতার কাছে ফেরত আসার কথা ছিলো তার। কিন্তু রড্রিক সেই মেয়েটির সম্ভ্রমহানি করে এবং একটা পর্যায়ে সে পালিয়ে জুলিয়ানের কাছে ফেরত আসে। এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতেই নাকি এতকিছু করেছিলো কাউন্ট জুলিয়ান।
উপরের কাহিনীটা এসেছে আরব ইতিহাসবিদদের বর্ণনায়, আদতে এমন কিছু ঘটেছিলো কিনা তা এখন নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল। তবে গৃহযুদ্ধ যে এখানে একটা বড় ফ্যাক্টর ছিলো তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, নাহলে একই সময়ে বিতাড়িত রাজ পরিবারের সদস্যদেরকেও তিনি গোপনে নিজ প্রাসাদে আশ্রয় দিতে যাবেন কেন?
মুর উপজাতির কথা
আরবে রাশেদুন খেলাফতের পতন ঘটে ৬৬১ সালে। ক্ষমতায় আসে উমাইয়ারা। ততদিনে খেলাফতের পরিধি মিশর ছাড়িয়ে এসে পৌঁছেছে আফ্রিকার উত্তর প্রান্তে। সেখানে গিয়ে তারা স্থানীয় এক জাতির সংস্পর্শে আসে, যারা পরিচিত ছিলো ‘বারবার’ বা ‘মুর’ নামে। এদের সাথে উমাইয়াদের একটা কৌশলগত জোট দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো।
খুব অল্প সময়ের ভেতর তাদের একটা বড় অংশ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। শুধু তাই না, উমাইয়াদের পক্ষে সামরিক অভিযানেও সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে শুরু করে স্বাধীনচেতা হিসেবে পরিচিত এই গোত্রটি। স্পেন জয় করতে তারিকের যে বাহিনী আইবেরিয়া উপকূলে নেমেছিলো, তাদের প্রায় সবাই-ই ছিলো মুর যোদ্ধা।
দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করলো জাহাজ…
যোদ্ধাদের বহনকারী জাহাজগুলো স্প্যানিশ উপকূলে নোঙ্গর করার পর একটা ঘটনা ঘটান তারিক। যার কারণে তিনি ইতিহাসে এতোটা বেশী আলোচিত হয়েছেন। মাল খালাস করার পর তিনি অধীনস্থ যোদ্ধাদেরকে নির্দেশ দেন জাহাজগুলো পুড়িয়ে ফেলতে। সেনাপতির নির্দেশ পালন হয় সাথে সাথেই, আগুন লাগিয়ে দেয়া হয় সবগুলো জাহাজে।
দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো জাহাজগুলো…
ঘটনাটা বাস্তবে ঘটে থাকতে পারে, অথবা প্রতীকী অর্থেও বলা হয়ে থাকতে পারে। (প্রতীকী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি কারণ এর পক্ষে তেমন কোনো শক্ত প্রমাণ নেই।) যাই হয়ে থাকুক, যোদ্ধাদের প্রতি তারিকের মেসেজ ছিলো খুবই পরিষ্কার – হয় যুদ্ধ করে দেশটা জয় করো, নইলে হেরে গিয়ে মরো। পালানোর কোনো সুযোগ নেই।
রণপ্রস্তুতি
আরব ইতিহাসবিদদের মতে, যুদ্ধটা হয়েছিলো জুলাই মাসের ২৫ তারিখে। তবে তার বেশ কিছুদিন আগেই আরবদের ক্যাম্পের কাছাকাছি এসে পড়েছিলো ভিসিগথরা। যুদ্ধবিদ্যায় পটু সেনাপতি তারিক তার বাহিনীসহ অবস্থান নিয়েছিলেন উঁচু ভূমিতে, ফলে রড্রিকের পক্ষে আচমকা হামলা করার সুযোগ ছিলো না।
যুদ্ধ শুরুর আগের রাতে রড্রিকের শিবির থেকে কয়েকজন লর্ড গোপনে দেখা করেন তারিকের সাথে। তারা রড্রিকের প্রতি নিজেদের অনাস্থার কথা জানিয়ে যুদ্ধের মাঠে রাজার পক্ষ ত্যাগ করার প্রতিশ্রুতি দেন তারিককে।
ক্যাম্পিং এর তিনদিন পর যুদ্ধের নিয়তে দুইপক্ষ জড়ো হতে শুরু করে পঁচিশ তারিখ সকালে। তারিক নিজের বাহিনীকে ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করেন। যেহেতু প্রতিপক্ষের তুলনায় সেনা সংখ্যা অতি নগণ্য, তাই তিনি দলগুলিকে নির্দেশ দেন ‘হিট এন্ড রান’ কৌশলে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতে।
অন্যদিকে তিন লাইনের অশ্বারোহী ইউনিটের পেছনে সেনাপতিদের সহ অবস্থান নেন রাজা রড্রিক। (একটি বর্ণনায় এসেছে রাজাকে বহনকারী রথটি ছিলো পুরোটাই আইভরির তৈরি, আর যুদ্ধে যে ঘোড়ায় রাজা সওয়ার হয়েছিলেন সেটা সাজানো হয়েছিলো মূল্যবান সব রত্নপাথর দিয়ে।) রাজা ও সেনাপতিদের পেছনে অবস্থান নেয় আরও তিন লাইনের পদাতিক বাহিনী।
যুদ্ধ শুরুর আগে তারিক তার যোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে একটা ভাষণ দিয়েছিলেন। তার শুরুটা ছিলো কিছুটা এরকম,
“যোদ্ধাগণ ! তোমরা এখন কোথায় পালাবে? পেছনে তোমাদের অসীম সমুদ্র, আর সামনে শত্রুদের বিশাল বাহিনী। এখন তো শুধু সাহস আর একাগ্রতাই তোমাদের একমাত্র আশা। নিশ্চিত জেনো, এই দেশে তোমরা এতীমের চেয়েও হতভাগা। অস্ত্র শস্ত্রে সজ্জিত বিশাল সৈন্যবাহিনীর বিপরীতে তোমাদের সম্বল শুধু তোমাদের তলোয়ার আর তোমাদের জীবনের মায়া…”
এরপরই বেজে উঠে যুদ্ধের ভেরী। ঘোড়া ছুটিয়ে শত্রুর দিকে তেড়ে যেতে শুরু করে দুপক্ষের যোদ্ধারা।
শুরু হলো সংঘর্ষ
যুদ্ধের একেবারে শুরুতেই আরব তথা বারবার যোদ্ধাদের শক্তিমত্তার একটা ধারণা পেয়ে যান রড্রিক। প্রথম খণ্ডযুদ্ধে ভিসিগথদের শক্তভাবে রুখে দেয় আরবরা। তাদের কৌশলে অনভ্যস্ত ভিসিগথ নাইটরা রীতিমতো কচুকাটা হয়ে ফিরে আসে।
এরপর রড্রিক দুইপাশের ইউনিটগুলোকে নির্দেশ দেন সমন্বিত আক্রমণের। কিন্তু যে ঘটনাটা ঘটে এরপর, তা ছিলো রাজার কল্পনারও বাইরে। একপাশের ইউনিট নির্দেশ মেনে এগুতে শুরু করে, আর অন্যপাশের ইউনিট ঠায় দাড়িয়ে থাকে। রাজার নির্দেশ যেন তারা শুনতেই পায়নি!
রড্রিক সাথে সাথেই বুঝতে পারেন সর্বনাশ হয়ে গেছে। আর তারিকও দেরি না করে নিজের একটি ইউনিটকে সাথে নিয়ে সোজা রওনা দেন রড্রিক বরাবর। এই অসম যুদ্ধ শেষ করার যে একটাই উপায়, সেটা খুব ভালো মতোই জানা ছিলো তার। ভিসিগথদের তরফ থেকে কোনো প্রতিরোধ আসার আগেই চরম ক্ষিপ্রতায় রাজাকে ঘোড়া থেকে ফেলে দেন তারিক। তারপর নিজেই বধ করেন রড্রিককে।
ভিসিগথদের শক্ত ফ্রন্টলাইন ভেঙ্গে তারিক পৌছে গেলেন রড্রিকের সামনে…
অন্যদিকে, অবস্থা নড়বড়ে হলে কি হবে রড্রিকের পক্ষে যুদ্ধরত সৈন্যদের সংখ্যা তখনো আরবদের প্রায় দ্বিগুণ। তুমুল যুদ্ধে প্রাণহানি ঘটছিলো দুতরফেই। কিন্তু রড্রিকের মৃত্যুর সংবাদটা ছড়িয়ে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে পেছাতে শুরু করে ভিসিগথরা। কোণঠাসা অবস্থায় অনেকেই নদীতে ঝাপ দিয়ে অন্য পাড়ে ওঠার চেষ্টা করতে থাকে। আর বারবার যোদ্ধারা দ্বিগুণ উদ্যমে তাদের বধ করতে শুরু করে।
ভিসিগথ বাহিনীর চার ভাগের তিন ভাগ সেনা প্রাণ হারায় এই যুদ্ধে, এক ভাগ কোনোমতে পালাতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে উমাইয়াদের বাহিনীর অর্ধেক অর্থাৎ প্রায় সাড়ে তিন হাজার সৈন্য মৃত্যুবরণ করেছিলো এই যুদ্ধে।
শেষকথা
তারিকের স্পেন জয়ের খবর খলীফার কাছে পৌঁছালে তিনি আরও সৈন্য সহকারে মুসা বিন নুশাইরকে পাঠান। (একটি বর্ণনায় এসেছে তারিক ছিলেন একজন মুক্ত দাস, এবং মুসা ছিলো তার মনিব।) এসময় পর্যন্ত তারিক স্পেনের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। পরবর্তীতে তারিক ও মুসার যৌথ অভিযানে স্পেনের উত্তরের একটি প্রদেশ ছাড়া বাকী অংশ উমাইয়া খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়। আর ভিন্ন ভিন্ন সেনাপতিদের নেতৃত্বে ৭৩২ সাল পর্যন্ত চলেছিলো আরবদের এই অগ্রযাত্রা।
আইবেরিয়া উপকূলের যে প্রণালীতে তারিক জাহাজ ভিড়িয়েছিলেন, পরবর্তীতে তার নাম রাখা হয় জিবাল-তারিক। আরবরা তো সেই কবেই চলে এসেছে স্পেন ছেড়ে, কিন্তু ‘জিব্রালটার’ নামটা এখনো থেকে গেছে, এক অসীম সাহসী সেনাপতির যুদ্ধজয়ের স্মৃতি নিয়ে।
এখনো সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে জিব্রালটার পাহাড়
--
(পড়ার সুবিধার্থে পোস্টটা একটু কাটছাট করা হয়েছে। আরেকটু ডিটেইলে পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন )