খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম ঘটনা সত্যি। বাসায় চোর-ই এসেছিলো, এবং বেশ অনেক জিনিষই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ল্যাপটপ আর ক্যামেরা যে রুমে ছিলো সেটা ফাঁকা ছিলো, কিন্তু যে ব্যাপারটা সবচেয়ে অবাক করার, সেটা হলো বেডরুমে ঘুমন্ত মানুষের বালিশের নিচ থেকেও মোবাইল নিয়ে গেছে চোর। আরও যে ব্যাপারটা অবাক করার সেটা হলো, একেবারে নিখুঁত চুরি যাকে বলে, কোনদিক দিয়ে যে এসেছিলো আর কোনদিক দিয়ে গেছে, তার একটা ক্লু পর্যন্ত নাই।
আমরা যখন হারানো জিনিষগুলো খুজছিলাম, তখনই বাসার দারোয়ান এসে জানালো নিচতালায় নির্মাণাধীন পাশের বাসার একপাশে একটা ব্যাগ পাওয়া গেছে, সেটা আমাদের কিনা। ব্যাগটা খুজে দেখা গেলো ভেতরে থাকা ছবি আর অন্যান্য কাগজপত্র আমাদেরই। তারমানে চোর যাওয়ার আগে সম্ভবত ছাদ থেকে এসব ফেলে দিয়ে গেছে! এর আগে কখনো এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি আমরা কেউ, পুরাই স্পীকার হয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকাতে লাগলাম।
থানা-পুলিশ-জিডি
চুরি যেহেতু হয়েই গেছে প্রথমে আমরা রওনা দিলাম নিকটস্থ থানার উদ্দেশ্যে। তখন সকাল আটটার মতো বাজে। থানা প্রায় ফাঁকা, ওসি সাহেব ভোর পাঁচটায় বের হয়েছেন তখনো আসেননি। এটা সেই অবরোধের সময়কার ঘটনা। তখন শহরে কিছুক্ষণ পরপরই গোলাগুলি আর ককটেলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমরা অপেক্ষা না করে দায়িত্বে থাকা অফিসারকে দিয়েই জিডি করিয়ে নিলাম। সামনে থেকে নথির পাহাড় সরিয়ে তিনি লিখতে শুরু করলেন। (এই জিডিটাও সম্ভবত পরিচিতির কারণেই সম্ভব হয়েছিলো, কারণ এর আগে এক রিলেটিভ এই থানাতেই ছিনতাই এর শিকার হওয়ার জিডি করতে এসে হেনস্থা হয়েছিলেন।)
যাহোক, একজন দারোগাকে দায়িত্ব দেয়া হলো তদন্তের কাজ করার জন্য। বেশ মোটাসোটা মানুষ, পেটমোটা দারোগা বললে যে অবয়বটা চোখের সামনে ভাসে হুবহু সেরকম। বেশ কিছুক্ষণ ধরে আমরা তাকে পুরা ঘটনাটা বুঝালাম, সন্দেহের ব্যাপারগুলো জানানো হলো তাকে। তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে সবকিছু শুনলেন। এরপর আন্তরিক গলায় আমন্ত্রন জানালেন দুঃচিন্তা না করে চা খাওয়ার জন্যে। আর জানালেন কিছুক্ষণ পরেই তিনি নিজে স্পট দেখতে আসবেন। আমরা তার কথা শুনে আশ্বস্ত হয়ে থানা থেকে বের হলাম।
ওই যে আগেই বললাম, এই ধরণের পরিস্থিতির মুখোমুখি আমরা আগে কখনো হইনি। নাহলে হয়তো আন্দাজ করতে পারতাম যে থানা পুলিশের পর্ব এখানেই শেষ। ওই দারোগার সাথে আর কখনোই দেখা হয়নি আমাদের। তিন চারদিন পর থানা থেকে ফোন দিয়ে আমাদের জানানো হলো মামলা ফাইল করা হয়েছে, আমরা যেন জিডির কপিটা এসে নিয়ে যাই।
ফোনটা রাত আটটার দিকে এসেছিলো, আমরা তখনই ছুটলাম থানার উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে জিডির কপি নেয়ার সময় তারা জানালো যেহেতু মোবাইল চুরি হয়েছে, জিডির কপি নিয়ে ডিবি অফিসে গেলে তারা IMEI নাম্বার দিয়ে ফোন ট্রেস করে ফেলতে পারবে। আর এখন যেহেতু পুলিশ মাঠে একটু ব্যস্ত তাই এইসব ছোট ছোট মামলার তদন্তকাজ একটু দেরি হচ্ছে। এবার আর চা টা কেউ সাধলো না

এরপর গেলাম ডিবি অফিসে

অন্ধকার কানা গলি। ছোট একটা মাঠ পেরিয়ে জীর্ণ একটা ক্লাব ঘরের মতো বাড়ি। সামনে অনেকগুলো গাড়ি সাইড করে রাখা। বারান্দায় লোকজন চুটিয়ে ক্যারাম খেলছে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি ডিবি অফিসের সামনে। ভেতরে ঢুকতেই অফিসার চেয়ার ছেড়ে একেবারে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। ঠিক যেন আমরা আর কোনো জন্মে উনার বস হয়ে জন্মেছিলাম! বিগলিত ব্যস্ত সমস্ত হয়ে আমাদেরকে বসালেন। ভালো চেয়ার ছিলো না বলে বাবাকে বললেন উনার চেয়ারেই বসতে (আমাকে বললে আমি ঠিকই যেয়ে বসে পড়তাম)।
আমাদের মুখে চুরির কাহিনী বিস্তারিত শুনে টেবিল চাপড়ে তিনি বলে উঠলেন, আরে এসব কোনো ব্যাপার! IMEI নাম্বার দিয়ে এখনি বের করে ফেলবো চোরকে!! আমাদের সব যন্ত্রপাতী আছে।

আমরা তো তার কথাবার্তা শুনে সেইরকম ইমপ্রেসড! জিডির কপিটা হস্তগত করার সময় হেসে জানালেন থানার কাছ থেকে এরকম ছোটখাটো চুরির মামলার তদন্ত আশা করে কোনো লাভ নাই। বাট উনার কাছে আমরা যখন এসেছি, এই কাজটা এখন হবেই। উনার ব্যাক্তিগত ফোন নাম্বারটা নিয়ে আসলাম, বললেন ফোন করে আপডেট কি হলো জানাবেন।
আমরা খুব খুশী হয়ে সেখান থেকে আসলাম, থানায় না হোক অন্তত এখানে বোধ হয় এসপার ওসপার কিছু একটা হবে। এরপর বেশ কিছুদিন গেলো কোনো খবর নাই।

আমরাই শুরু করে দিলাম তদন্ত!!


এদিকে তাদের জন্যে অপেক্ষা না করে আমরা কাজিনরা মিলে নিজেরা নিজেরাই গঠন করে ফেললাম ছোটখাটো একটা তদন্ত কমিটি।
তার প্রতিবেদনটা সংক্ষেপে দাড়ালো এমন, বাসার বারান্দা আর একটা টয়লেটের দেয়ালে দুইটা ছোট ছোট ফোকর আছে, সেখানে গ্রিল ছিলো না। সম্ভবত তার কোনো একটা দিয়েই চোর ঢুকেছিলো বাসার ভেতর। পাশে বিল্ডিং এর কাজ চলছে, খুব সহজেই সেখান থেকে এখানে চলে আসা যায়। সম্ভবত দুইজন মিলে কাজটা করেছে। একজন জিনিষপত্র পার করে দিয়েছে, আর বাইরে থেকে সে সেটা তুলে নিয়েছে। তারপর সেখানের ছাদে আরামসে ভাগ বাটোয়ারা যা করেছে আর পালানোর আগে ব্যাগটা নিচে ফেলে দিয়ে গেছে।
সেই সন্দেহের জায়গাটার ছবি তোলা হয়েছিলো। এটা সেটা,
বাদ গেলো না জ্বীনের বাদশাহ!


সেই রাতে ডিবি অফিস থেকে ফিরে আমরা গেলাম আরও বড় ডিবি অফিসে। এক জ্বীনের বাদশার দরবারে। আমাদের নানাবাড়ির পাশের গ্রামে এক পরিচিত লোকের উপর কিছুদিন আগে জ্বীন ভর করেছে। সেই জ্বীনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো এই চুরির ব্যাপারে, তিনি জানিয়েছেন, চোর এখনো সবকিছু বেচে ফেলেনি, দুইটা দামী জিনিষ চোরের কাছে এখনো আছে। বিস্তারিত জানতে চাইলে যেনো তাদের বাড়ীতে যাই। আমরা শুনে তো পুরাই থ্রিলড! আরে! কিসের মধ্যে কি চলে আসলো! লাফাতে লাফাতে আমরা চলে গেলাম সেই গ্রামে।
জ্বীনের বাড়ী বলে ভাববেন না কোনো হন্টেড হাউজে চলে গেছি আমরা। ছিমছাম একটা বাড়ী। সামনে বাচ্চারা খেলাধুলা করছে, আমাদেরকে বসানো হলো একটা ঘরে। সেখানে লোকটা শুয়ে ছিলো, আমাদের কথা বলা হলে উঠে বসলো। এরপর জানালো জ্বীন বলেছে কাজটা তারা করে দিতে পারবে। আমাদের কোনো চিন্তা করতে হবে না। এমন অত্যাচার করা হবে যে চোর নিজেই এসে জিনিষপত্র দিয়ে যাবে। আমাদের কাজ শুধু খেয়াল রাখা কখন সে জিনিষটা ড্রপ করে। আমরা আবার খুশী হলাম, হতেই পারে! লোকটা তো আর পুলিশ না যে তার কথা অবিশ্বাস করবো। যাইহোক কিছু টাকা তাকে দিতে হলো বটে, তবে কাজ না হলে সেটা ফেরত দেয়া হবে, সো নো টেনশন।
এরপর আমরা চলে আসলাম। ফেরার আগে তার স্ত্রীর কাছে জানলাম, এশার নামাজের পর শুরু হয় জ্বীন ভর করা। এছাড়া অন্যান্য সময় সে বেশ ভালোই থাকে। আর যেদিন থেকে এই ভর করা শুরু হয়েছে সেদিন থেকে তার সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ আছে। উনারা নাকি নিষেধ করে কাজ করতে। আগে সে ভ্যান চালাতো।
যাহোক চুরির প্রসঙ্গে অলরেডি অনেক কিছুই বলে ফেলেছি। আর কথা বাড়াবো না। এরপর আর একদিন একজন অফিসার স্পটে এসেছিলো অবশ্য। তবে তার মনোযোগ যতটা না চুরির দিকে ছিলো তারচেয়ে বেশি ছিলো বাসার পেছনের একটা কানাগলির দিকে, তার ধারনা শিবির এর পোলাপাইন ককটেল মেরে এই রাস্তা দিয়েই পালিয়ে যায়। (এটা অবশ্য মানতে হবে তার চোখ আছে, কারণ তার ধারনাটা মিথ্যা ছিলো না)
যাহোক, ততদিনে আমরা এই চুরির শকটা কাটিয়ে উঠেছি। বাসার প্রতেকটা দরজায় তালা চাবি সিস্টেম করা হয়েছে, সেই ফোকরগুলোয় গ্রিল দেয়া হয়েছে। আর চুরি যাওয়া জিনিষের ভেতর মোবাইল দুইটা কিনে ফেলা হয়েছে, এখন শুধু ক্যামেরা আর ল্যাপটপ কেনা বাকী। আর সেই ডিবি অফিসারের আর কোনো খোজ পরে পাওয়া যায়নি, মাঝে মাঝে ফোন দিলে প্রথমে চিনতে পারেন না, তারপর বলেন এসব তো অনেক আগের কথা! কাজটা তো করা হয়নি, আচ্ছা দেখছি।
--- ---
এই হলো আমাদের বাসায় চুরি আর তারপরের কাহিনী। যে পরিমাণ জিনিষ খোয়া গেছে তা যোগ করলে মোটমাট এক লাখ টাকার মতো হবে। আর যত অভিজ্ঞতা এই চুরির সূত্রে হলো, তা টাকার হিসাবে কোনোভাবেই পাচ ছয় লাখ টাকার কম হবে না। আল্লাহ না করুক আপনাদের যদি এরকম অভিজ্ঞতা হয়, মানে এরকম ছোটখাটো চুরির – তাহলে পরামর্শ থাকবে ঝামেলা মনে করে থানা পুলিশে দৌড়ানোর এই অভিজ্ঞতাটা মিস করবেন না। তবে যে কাজটা করবে না সেটা হলো, তাদেরকে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখে অথবা তাদের কথার ফুলঝুরি শুনে চোর ধরা বা চোরাই মাল ফেরত পাওয়ার আশা কখনো করবেন না।

(শেষকথা: জ্বীনের বাসা থেকে একদিন ফোন দিয়ে বলা হয়েছিলো চোর জিনিষ রেখে যেতে পারে, আমরা যেনো চোখ কান খোলা রাখি। আমরা সাথে সাথে সেই ডিবি অফিসারের মতো সটান হয়ে বাসায় আতিপাতি করে খোজা শুরু করি। এর কিছুদিন পর ফোন করে জানানো হলো কাজটা অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে, আমরা যেনো টাকাটা ফেরত নিয়ে যাই। টাকা ফেরত নিয়ে আসার সময় তার স্ত্রীর কাছে শুনলাম, কাজকর্ম না করার কারণে তারা বেশ আর্থিক সমস্যার মধ্যে পড়ে গেছে। লোকটা নাকি আগে থেকেই কাজকর্মের প্রতি একটু উদাসীন ছিলো। আমরা তাদেরকে খুব বেশি ঘাটালাম না। শুধু ফেরার আগে আম্মু তাকে উপদেশ দিলেন আবার কাজকর্ম শুরু করার জন্য।)
--
আরও পড়ুন:
যে দশটা শব্দের বানান আমার সবসময় ভুল হয়, আপনার? মিলিয়ে দেখুনতো!