হায়দারাবাদে ভারতীয় আগ্রাসন ও সামরিক অভিযানের দ্বিতীয় দিন অতিবাহিত হলো। ব্যাপক হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছে ভারতীয় সেনারা। বিশেষ করে মুসলমানদের বেছে বেছে হত্যা করছে তারা। অন্যদিকে প্রতিরোধ ব্যবস্থার মধ্যে ঢুকে পড়েছে ভারতীয় তাঁবেদাররা। খোদ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আল ইদরুসের ভূমিকা ছিল বিশুদ্ধ মীর জাফরের। অন্যদিকে নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনের তারিখ পিছিয়ে দেয়া হয়েছে, যাতে ভারত তার হায়দারাবাদ অভিযান সাফল্যের সঙ্গে সমাপ্ত করতে পারে। অন্যদিকে পর্যাপ্ত অস্ত্রের অভাবে তড়পাচ্ছে হায়দারাবাদ। পাকিস্তান থেকে কিছু সাহায্য এল যদিও অনেক পরে। দ্বিতীয় দিনেই হায়দারাবাদের প্রধানমন্ত্রী মীর লায়েক আলী বুঝে গিয়েছিলেন, সামনে এখন মাত্র দুটি পথ। হয় আত্মসমর্পণ না হয় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। সেনাবাহিনী প্রধানের মনের মধ্যে যাই থাক, লায়েক আলী সিদ্ধান্ত নিলেন যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন। যদিও সেনাপ্রধানের কাজকর্মে তিনি ভীত হয়ে পড়েছিলেন।
এই পুরো উদ্বেগাকুল ঘটনাপ্রবাহের সবচেয়ে বড় সাক্ষী মীর লায়েক আলী। তার জবানিতেই শোনা যাক ঘটনার ধারাক্রম :
চলতে থাকল আক্রমণ
আক্রমণ শুরু হওয়ার দ্বিতীয় দিন। ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮। যুদ্ধের কোনো ময়দান থেকেই তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ খবর এলো না। কিন্তু একটি রিপোর্টে জানা গিয়েছিল যে, জালনা নামক অঞ্চল ভারতীয়দের কাছ থেকে পুনর্দখল করা হয়েছে। আমার এই খবর খুব আশ্চর্য লাগছিল। কারণ উত্তর-পূর্বের এই এলাকা আদৌ ভারত দখল করেছিল কি-না এমন কোনো খবর আমি আগে পাইনি। সেনাপ্রধানের মতামত ছিল যে, সেদিন ভারত আর অগ্রসর হবে না। কারণ তারা বিশ্রাম গ্রহণ করবে। তারা নিজেদের পজিশন সম্পর্কে সচেতন হবে এবং প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহের কাজ করবে।
বেলা যতই পার হতে লাগল সব দিক থেকে ভালোমন্দ দুই ধরনের খবরই আসতে লাগল। দিনের মধ্যভাগে দিল্লির রেডিওর সংবাদে বলা হচ্ছিল যে, তারা যুদ্ধের সব ময়দানেই শত্রুর ভারি ধরনের আক্রমণের মুখোমুখি হচ্ছে। আমার কাছে মনে হচ্ছিল যে, এর চেয়ে আশ্চর্যকর এবং হাস্যকর কথা আমি কোথাও কখনও শুনিনি। বরং তারা এটা বললে সঠিক হতো যে, ভারতীয় সেনারা আশ্চর্যরকমভাবে কম প্রতিরোধ শক্তির মুখোমুখি হচ্ছে। তার আগের দিনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, ভারতীয় সেনারা তখনই বীরের মতো যুদ্ধ করতে পারে, যখন প্রতিপক্ষ চুপচাপ বসে থাকে। কিন্তু যখন প্রতিপক্ষ গুলি চালায় তখন তারা হুড়মুড় করে ভেগে পালায়। যুদ্ধের সব ময়দানেই এমনি দৃশ্য লক্ষ্য করা গিয়েছিল। তখন লক্ষ্য করেছিলাম যে, ভারতীয় বাহিনী যেসব স্থানে ট্যাঙ্ক ছাড়া আক্রমণ করেছে, সেসব স্থানে তারা আগাতে পারেনি। এমনকি তাদের শক্তিশালী আর্মি যখন কি-না আমাদের কিছু স্বল্প প্রশিক্ষিত দুর্বল বাহিনীর মুখোমুখি হয়েছিল, সেখানেও তারা কোনো প্রকারেই অগ্রসর হতে ব্যর্থ হয়েছিল। শুধু তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে তারা আমাদের আক্রমণ মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে পিছপা হয়েছিল। স্বেচ্ছাসেবকদের দুর্বল কিছু দল কেবল স্বল্প কিছু সেনাবাহিনীর সাহায্য নিয়েই অনেক ক্ষেত্রে ভালোভাবে ভারতকে টেক্কা দিয়েছিল। সাদিক আলি খান নামে একজন সাহসী ইঞ্জিনিয়ার জীপে করে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় কিছু ভারতীয় বাহিনী অতর্কিতভাবে তাকে আক্রমণ করে মেরে ফেলে। এসব স্বেচ্ছাসেবকের মতে, অনেক ক্ষয়ক্ষতি এবং হতাহতের খবর পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু কিছুতেই তারা হতাশাগ্রস্ত বা পিছপা হয়নি। তারা একমাত্র যা চাচ্ছিল তা হলো আরও কিছু গোলাবারুদ। তারা সব সম্ভাব্যতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত ছিল।
মূল আক্রমণকারী বাহিনীর একটি অংশ তাদের মূল গন্তব্যপথ থেকে সরে উত্তরের দিকে এগিয়ে যায়। তারা ওসমানাবাদ দখল করে, যা কি-না ছিল অপ্রতিরক্ষিত। খবর পাওয়া গেল যে, ভারতীয় বাহিনী শহরে প্রবেশ করেছে। প্রবেশের আগে তারা সেখানে ভারি গোলাবারুদ নিক্ষেপ করে। শহরে তেমন কোনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই এটা জেনেও তারা এমনটি করেছিল। শহর দখল করার পর সাধারণ জনগণের মধ্যে তারা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। বিশেষভাবে তারা মুসলমানদের খুঁজে খুঁজে বের করে তাদের হত্যা করে। নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে তারা হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। দখল শেষে তারা সেখানে সামান্য কিছু বাহিনী রেখে যায় তাদের অপকর্ম সম্পূর্ণ করার জন্য এবং তারা এগিয়ে যায় ইয়াদসির দিকে। আশা করা হচ্ছিল, সেখান থেকে তারা লাটুর হয়ে বিদরের দিকে অগ্রসর হবে। কিন্তু পরদিন তাদের অগ্রসরের আর খবর পাওয়া যায়নি। বিদরে উঁচু রাস্তায় ছিল ভালো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। আশা করা হচ্ছিল, আমাদের বাহিনী সেখানে শত্রুকে ভালোভাবেই ঠেকিয়ে রাখতে পারবে। নলদ্রাগ দখলের পর আশা করা হচ্ছিল যে, তারা লাটুরের দিকে কোনো ভারি হামলা চালাবে না। এ কথা যখন আমি সেনাবাহিনীপ্রধানকে বলি, আরো বলি যে, সেখান থেকে কিছু সৈন্য এবং ফিল্ড গানকে সরিয়ে বিদর প্রতিরক্ষায় অথবা যছিরাবাদের পেছনে পাহাড়ি এলাকার প্রতিরক্ষা আরো শক্তিশালী করার জন্য ব্যবহার করা হোক, তখন তিনি আমার সঙ্গে একমত হলেন না। তিনি আমাকে বোঝালেন যে, যদি এমনও হয় যে, ভারত বাহিনী বিদরের প্রতিরক্ষা ভেঙে সেখানে প্রবেশ করে, তবে সেখান থেকে রাজধানীতে যাওয়ার অনেকগুলো পথ রয়েছে এবং আমাদের বাহিনীর পক্ষে সম্ভব হবে না এটা ঠিক করে নির্ণয় করা যে, তারা কোন পথে এগুচ্ছে এবং সব পথেই সেনা মোতায়েন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। শেষ পর্যন্ত আমি তার সঙ্গে একমত হয়ে তাকে তার মতো কাজ করতে দিলাম।
বিকালের দিকে খবর এল, ভারতের ট্যাংক যুক্ত মূল বাহিনীর যে অংশ নলদ্রাগ পার করে দালাম হয়ে হুসনাবাদের দিকে এগোচ্ছিল, তারা তাদের দিক পরিবর্তন করে উত্তরে কালিয়ানির দিকে এগোচ্ছে। তাদের এই চাল ছিল পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত এবং কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। ম্যাপে দেখা গেল, তাদের পথে বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে এবড়ো-থেবড়ো এবং অসমতল রাস্তা, যা দিয়ে ট্যাংক কিংবা অন্যান্য যানবাহন সহজে যাতায়াত করতে পারবে না। তাহলে কালিয়ানির দিকে তাদের এগোনোর মতলবটা কী? কালিয়ানির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের কোনোই ব্যবস্থা ছিল না। আমরা কেবলই অনুমানের ওপর নির্ভর করছিলাম যে, সেখানে কী হচ্ছে।
সেদিন বিকালে আমি নিজামের সঙ্গে ছিলাম। আমরা একটি দুঃসংবাদ পেলাম। একদম উত্তরপূর্বে আওরঙ্গবাদ শহরটি ভারতীয় বাহিনী দখল করেছে। খবরটি শুনে আমরা দু’জনেই এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেলাম। নিজামের চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। আমিও ভেতরে একই ব্যথা অনুভব করছিলাম। কিন্তু ভেতরের বেদনা আমি বাইরে সেভাবে প্রকাশ করতে পারছিলাম না। আমি আর্মি হেড কোয়ার্টারে চলে গেলাম। জানতে পেরেছিলাম যে, জালনা এখনও আমাদের হাতে আছে।
কিন্তু ভারতের দুটি মোটোরাইজড বাহিনী এই শহরের দিকে এগিয়ে আসছে উত্তর এবং পূর্ব থেকে। বুঝতে পেরেছিলাম যে, হয় রাতের মধ্যে অথবা পরদিন জালনা ভারতের হাতে চলে যাবে। অন্য একটি দল এগিয়ে আসছিল বীর-এর দিকে, বীর-এর ফলাফলও একই দাঁড়াবে।
আমাদের সেনাপ্রধান একটানা ছত্রিশ ঘণ্টা ধরে তার ডেস্কে কাজ করে যাচ্ছিলেন। আমি তাকে বিশ্রাম নেয়ার উপদেশ দিলাম এবং সব নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে তুলে নিলাম। আর্মি চিফকে জানালাম যে, শুধু যদি খুব গুরুতর কিছু ঘটে তবেই তাকে ডেকে পাঠাব।
পশ্চিমে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তখন আরও কিছু সংবাদ এসে পৌঁছেছে। পূর্বের রুটে দুটি খাল ছিল যা সেচের জন্য ব্যবহার করা হতো। আমার আদেশে সেখানে বোমা বিস্ফোরণ করে খালের সাহায্যে রাস্তা বন্ধ এবং চলাচলের অযোগ্য করে দেয়া হয়েছিল। এর ফলে বেশ কিছু ট্যাঙ্ক এবং যানবাহন সেখানে আটকা পড়েছিল। ভারতীয় বাহিনীর অন্য ইউনিটগুলো হুজুরাবাদ-মিরিয়াগুদা রাস্তা দিয়ে এগিয়ে এসে মুসির পাথর দিয়ে বাঁধাই করা রাস্তা পার হয়ে এগিয়ে আসছিল। মুসির পাথরে বাঁধাই করা বাঁধের পূর্ব কূল রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনী তেমন কোনো কাজেই আসল না। এমনকি তাদের কাছ থেকে কোনো খবরই পাওয়া গেল না। যে বাহিনীটা এগিয়ে আসছিল তাদের সামনে তখন দুটি পথ ছিল। তারা চাইলে উত্তরের দিকে গিয়ে নলখোন্দা পার করে নাকরিকালে গিয়ে তাদের মূল বাহিনীর সঙ্গে একত্রিত হতে পারত, যারা সুরিয়াখাত হয়ে এগিয়ে আসছিল। অথবা আরও পূর্বে এগিয়ে গিয়ে যেসব রাস্তা রাজধানীর দিকে চলে আসে তার মধ্যে যেকোনো একটি হয়ে এগিয়ে যেতে পারত। কিন্তু দ্বিতীয় দিন রাতেও তাদের অগ্রগতির তেমন কোনো খবর পাওয়া গেল না। অপরদিকে আমি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের একটি দলকে দায়িত্ব দিলাম মুসি নদীর ওপর দিয়ে যে সেতু সুরিয়াখাত-নাকরিকাল রাস্তায় মিশেছে তার কিছু তোরণ ধ্বংস করে দিতে। তারা সেতুটির প্রধান দুটি তোরণ ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছিল। ব্রিজ ধ্বংস সত্ত্বেও যাতে তারা নদী পার করতে না পারে সে জন্য হিমায়েত সাগর লেকের যে বাঁধটি ছিল তার ফ্লাড গেট খুলে দিতে বললাম।
সন্ধ্যায় নিজামের সঙ্গে সাক্ষাত্ করে আর্মি হেডকোয়ার্টারে চলে গেলাম। সেখানে দেখতে পেলাম যে, আর্মি কমান্ডার কয়েক ঘণ্টা বিশ্রামের পর তার ডেস্কে ফিরে এসেছেন। কাসেম রিজভীর সঙ্গে যোগাযোগ হলো এবং আমি তার কাছে প্রথমবারের মতো কিছু রাজাকার প্রস্তুত করে দিতে বললাম। কারণ দক্ষিণ এবং পশ্চিম শাখায় আর কোনো বাহিনী উপস্থিত ছিল না। তার জবাব ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। তিনি বললেন, যত দরকার তত পাঠানো হবে, কিন্তু তাদের কিছু অস্ত্র সরবরাহ করতে হবে। তিনি বিভিন্ন জায়গা ঘুরে এসেছিলেন এবং বলেছিলেন, রাজাকারদের চারটি ব্যাটালিয়ন প্রস্তুত আছে প্রয়োজন মোতাবেক যে কোনো স্থানে যুদ্ধের জন্য। শুধু তাই নয়, রাজাকারদের প্রথম ব্যাটালিয়নের মধ্যে ছিল তার দুই ছেলে এবং তিনি আমাকে বলেছিলেন, দলটি যে কোনো বিপদের মোকাবিলা করতে প্রস্তুত।
আর্মি চিফের অনুরোধে গভীর রাতে আমি সেখান থেকে চলে গেলাম বিশ্রামের উদ্দেশ্যে। আমি অফিসে গেলাম যেখানে আমার কর্মচারীরা মুসতাক আহমেদ, যিনি কি-না করাচিতে অবস্থিত হায়দারাবাদের রাষ্ট্রদূত ছিলেন, তার কাছ থেকে পাওয়া এবং তাকে পাঠানোর জন্য বিভিন্ন গোপন তথ্যের কোডিং এবং ডিকোডিংয়ে ব্যস্ত ছিল। সেই একমাত্র মাধ্যম ছিল, যার দ্বারা বেতার ব্যবহারে বহিঃবিশ্বের সঙ্গে হায়দারাবাদ যোগাযোগ করতে পারত। তার সঙ্গে তেমন কোনো কর্মকর্তা সেখানে ছিল না এবং গোপন তথ্য কোডিং এবং ডিকোডিংয়ের জন্য তিনি তার পরিবারের সাহায্য নিতেন। তার সঙ্গে প্রতি ঘণ্টায় যোগাযোগ করা হতো এবং মীর নাওয়াজ জাং-এর সাহায্যে তিনি হায়দারাবাদের প্রতিনিধিবর্গের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। সবচেয়ে কঠিন কাজটি ছিল মুসতাকের জন্য। তার দায়িত্ব ছিল হায়দারাবাদের ঘটনাবলী এবং খবরাখবর পাকিস্তানের সরকারের কাছে পৌঁছে দেয়া এবং পাকিস্তানি সরকার যেন হায়দারাবাদকে সাহায্য করে সেদিকে লক্ষ্য রাখা। তাছাড়াও তার দায়িত্ব ছিল এটা নিশ্চিত করা যেন সেখান থেকে সাহায্য এবং বিভিন্ন অস্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ঠিকমত এখানে এসে পৌঁছে। তার সঙ্গে কাজ করে আমি এটাই বুঝতে পেরেছিলাম যে, তিনি ছিলেন অসম্ভব পরিশ্রমী। তিনি নিরলসভাবে কাজ করে চলেছিলেন।
হায়দারাবাদ খুব আশাবাদী ছিল যে, জাতিসংঘ দুর্বলের পাশে এসে দাঁড়াবে এবং তাদের সাহায্য করবে। হায়দারাবাদের প্রতিনিধিবর্গ প্যারিসের দিকে রওনা হয়েছিল, যেখানে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। ১৩ সেপ্টেম্বরে সেখানে পৌঁছার কথা, যা কি-না তখন ছিল ভারতের আক্রমণের এক সপ্তাহ আগে। কিন্তু মইন নাওয়াজ জাংকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল যে, যেহেতু কায়দে আজম জিন্নাহ হঠাত্ই মৃত্যুবরণ করেছেন, এমনটি হতে পারে যে, ভারত আগেভাগেই তাদের আক্রমণ চালাবে। আমি জানতাম যে, তারা এক সেকেন্ডেরও অপব্যবহার করবে না। কিন্তু লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করে তারা যখন কায়রো পর্যন্ত পৌঁছেছিল, ততক্ষণে আক্রমণ শুরু হয়ে গিয়েছিল। তিনি সেখান থেকে লন্ডনে দ্রুত পৌঁছার উদ্দেশ্যে অন্য একটি বিমানে করে রওনা দিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য এমনই, তিনি যখন ত্রিপোলিতে পৌঁছেন তখন যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে বিমানটিকে কয়েক ঘণ্টা বিরতিতে থাকতে হয়। শেষমেশ ১৩ তারিখ সন্ধ্যায় দেরি করেই তারা লন্ডনে পৌঁছেছিলেন। সেখান থেকে সবার আগে যে বিমানটি ছাড়বে তাতে করে ১৪ তারিখ সকালে আমাদের প্রতিনিধিরা রওনা হয়েছিল প্যারিসের উদ্দেশ্যে। প্যারিসে নেমেই মইন নাওয়াজ জাং জাতিসংঘের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সব আনুষ্ঠানিকতাকে দ্রুত ছেড়ে শুধু গুরুত্বপূর্ণ কাজের দিকেই নজর দেয়া হচ্ছিল। তাদের পৌঁছানোর পর নিরাপত্তা পরিষদ প্রথম যখন বসবে তার তারিখ ছিল ১৬ সেপ্টেম্বর বিকাল। মাইনের দায়িত্ব ছিল প্রতিনিধিদের পক্ষ হয়ে যখনই প্যারিসে তার দরকার তখনই সেখানে উপস্থিত থাকা।
১৫ সেপ্টেম্বর সকালে পশ্চিম থেকে আসা বিপদ আরও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করল। পূর্বে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কোন খবর এল না এবং ভারতীয় মূল বাহিনী যেটা কি-না দালাম থেকে কালিয়ানির দিকে মার্চ করে আসছিল তাদের সম্পর্কেও কোনো খবর জানা যাচ্ছিল না। নিজামকে সেদিন সকালে খুব বিষণ্ন দেখাচ্ছিল। কমান্ডারকেও দেখে মনে হচ্ছিল তার আত্মবিশ্বাস আর আগের মতো নেই। নিজাম পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার মতামত চাইলেন এবং আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে, আমরা নিরাপত্তা পরিষদের মতামত আসা পর্যন্ত ভারতকে ঠেকিয়ে রাখতে পারব কি-না। আমি নিজামকে জবাব দিলাম যে, আমি আশা করি না যে নিরাপত্তা পরিষদ এক সপ্তাহের আগে তেমন কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারবে। কিন্তু ততদিন পর্যন্ত আমাদের যে করেই হোক ভারতের আক্রমণ ঠেকিয়ে রাখতেই হবে। আর্মি চিফ বললেন, পূর্ব থেকে আসা আক্রমণ ততদিন কিংবা তারও বেশি সময় ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু পশ্চিমের অবস্থা নিয়ে তিনি খুব চিন্তিত। কারণ বলতে গেলে সেখানে পাঠানোর মতো আর কোনো সৈন্যই তার কাছে নেই। তিনি বললেন, কিন্তু যাই হোক ভারতকে আরও এক সপ্তাহ ঠেকিয়ে রাখা অসম্ভব নয়।
একটি ছোট বৈঠকের পর এডিসি কর্তৃক জানতে পারলাম, দিল্লিতে রেডিওতে প্রচার হচ্ছে, ভারতের মূল বাহিনী ঐতিহাসিক শহর বিদর-এর কাছে চলে এসেছে। এডিসির কথা বিশ্বাস করতে না পেরে পাশের একটি রুমে চলে গেলাম, যেখানে রেডিওতে দিল্লির খবর সম্প্রচারিত হচ্ছিল। পুরো সংবাদজুড়েই ছিল ভারতীয় বাহিনী হায়দারাবাদে কী করছে তার খবর। শেষে বলা হলো, ভারতের মূল বাহিনী ঐতিহাসিক শহর বিদর-এর কাছে চলে এসেছে। আমি আমার ডেস্কে ফেরার পরপরই সেনাপ্রধানের একটি কল পেলাম। তিনি বললেন, খবর পাওয়া গেছে কালিয়ানী-বিদর রাস্তা ধরে বিশাল ভারতীয় বাহিনী এগিয়ে আসছে। কালিয়ানি-বিদর সড়কের নাম শুনে আমি অবাক হলাম। ম্যাপে লক্ষ্য করে দেখলাম, সেখানে কোনো কালিয়ানি-বিদর সড়ক বলে কিছু নেই। দ্রুত ফোন লাগালাম প্রধান ইঞ্জিনিয়ারকে। তিনি জানালেন, সেখানে একটি নতুন রাস্তা করা হয়েছিল, যা কি-না নতুন মানচিত্রে ছাপা হওয়ার কথা। আমি হতবাক হলাম। আমি জানতাম না যে, কালিয়ানি-বিদর সড়ক নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং তা ব্যবহারের উপযোগী। কিন্তু সেনাবাহিনী প্রধান এ সম্পর্কে আরও কম জানতেন। এমনকি সেনাবাহিনী রিকনসেন্স এবং ইন্টেলিজেন্স পর্যন্ত এটা সম্পর্কে জানত না। দেখা গেল যে, জানত শুধু ভারতীয় বাহিনী!
এ ব্যাপারটি ছিল তখন পর্যন্ত আমার জন্য সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার। বিদর ছিল একটি সাপ্লাই বেস এবং সেখানে কোন প্রতিরক্ষা বাহিনী ছিল না বললেই চলে। কালিয়ানি থেকে বিদর-এর রাস্তা ছিল এমন যে, সেখানে অল্পসংখ্যক প্রতিরক্ষা বাহিনী থাকলেই সেটা পার করা ভারতের জন্য খুব কঠিন হয়ে যেত। কিন্তু সেখানে এখন সহজেই ভারত সেই রাস্তা পার হয়ে বিদরে চলে এসেছে। এই রাস্তা ধরে আসার ফলে ভারতীয় বাহিনী লাটুর-বিদর পথে যে বাঁধযুক্ত উঁচু রাস্তা ছিল সেখানে আমাদের কঠিন নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে এড়িয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তারা পৌঁছে যাবে সুরক্ষিত হুসনাবাদের কাছে। খুবই একটি জটিল সমস্যা দেখা দিল। বিদর ছিল জহিরাবাদ থেকে বারোমাইল দূরে, অন্যদিকে জহিরাবাদ থেকে হুসনাবাদের দূরত্ব ছিল চল্লিশ মাইলের বেশি। সেনাপ্রধান এর চেয়েও অনেক সহজ পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি। এই কঠিন অবস্থা কি তিনি সামাল দিতে পারবেন?
খুব তাড়াহুড়ার মধ্য দিয়ে আর্মি সিনিয়র এবং জেনারেল স্টাফদের একটি মিটিং ডাকা হলো। তখন বলতে গেলে লাটুর ইউনিটটি আর আমাদের হাতে নেই। বিদর ছাড়া সেখান থেকে সরে যাওয়ার জন্য তাদের আর কোনো পথ বাকি ছিল না। তখন প্রশ্ন শুধু একটিই; হুসনাবাদের ব্যাটালিয়নদের জহিরাবাদে নেয়া সম্ভব কি-না? যেখানে তারা জহিরাবাদ-হায়দারাবাদ সড়ক প্রতিরক্ষায় কাজ করবে। সেখানে এমন কিছু স্থান ছিল যেখান থেকে প্রতিরক্ষা করার জন্য কিছু সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যেত।
আর্মি কমান্ডারের মতামত এমনটি ছিল যে, পঞ্চাশ মাইল দূরত্ব এক রাতে অতিক্রম করার মতো শক্তি ও উদ্যম তাদের মধ্যে নেই। কিন্তু জেনারেল স্টাফের জুনিয়র কর্মকর্তাদের মতে, এটি তেমন অসম্ভব কোনো ব্যাপার ছিল না। তর্কে বলা হয়েছিল যে, ভারতীয় বাহিনীও তখন খুব ক্লান্ত থাকবে এবং হুসনাবাদের সৈনিকদের পথ তারা রুখে দাঁড়াতে পারবে না। শেষ সিদ্ধান্ত ছিল আমার, আমি আদেশ করলাম যাতে হুসনাবাদের সৈনিকরা ২৫ পাউন্ডার গান এবং অন্যান্য ভারি অস্ত্র নিয়ে জহিরাবাদের সব হাহারি অঞ্চলে অবস্থান করে। আমি আরও আদেশ দিলাম যাতে বিদর থেকে যতখানি সম্ভব সরঞ্জামাদি নিয়ে সেখান থেকে সরে পড়া হয়। তখন প্রশ্ন এমন হয়ে দাঁড়াল যে, যদি ভারতীয় বাহিনী বিদর থেকে জহিরাবাদের রাস্তা দিয়ে না এসে অন্য কোনো রাস্তা দিয়ে আসে, তখন কী হবে? যদি এমনটি হয় তবে খুব বড় বিপদে পড়তে হবে। কিন্তু সবকিছুর প্রতিরক্ষা আমাদের সম্ভব না। আর্মি কমান্ডার আমার সঙ্গে একমত ছিলেন, যেহেতু সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা রয়েছে যে, ভারত জহিরাবাদ-হায়দারাবাদে রাস্তা দিয়ে এগোবে, সেহেতু সেখানেই আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।
আমি আমার ডেস্কে ফিরে এলাম। ঘটনাগুলো এত ত্বরিতগতিতে এগিয়ে আসছিল যে, কোনো প্লান তৈরি করার সময় পাওয়া যাচ্ছিল না। নিরাপত্তা পরিষদও কি তাদের মতামত তেমনি দ্রুত প্রস্তুত করতে পারবে এবং তাদের কোনো মতামত আদৌ কি কোনো কাজে আসবে? যদি এমনি হয় তবে সামনে দুটি পথ থাকবে, একটি হলো ভারত যদি কোনো যৌক্তিক শর্ত দেয় তবে তা মেনে নিয়ে ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে এবং ভারত যদি আমাদের আত্মসমর্পণ অথবা দাবিতে কোনো সাড়া না দেয় তবে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করে যাওয়া এবং দ্বিতীয়টি হলো তখনই সব অস্ত্র পরিত্যাগ করে ভারতের আক্রমণ ঠেকানোর কোনো প্রচেষ্টা না করে অপেক্ষা করতে হবে। আমি প্রথমটি বেছে নিয়েছিলাম।
১৫ তারিখের বিকালে ভারতীয় নেতাদের উদ্দেশ করে আমার আকুতিমূলক একটি বাণী রেডিওতে প্রচার করা হয়। আমি মুসতাক আহমেদকে খবর পাঠিয়েছিলাম, তিনি যেন পাকিস্তান সরকারকে অনুরোধ করেন, তারা যেন ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং ভারতকে সামনে আর কোনো রক্তপাত ঘটানো থেকে বিরত থাকার জন্য বলে। পরিস্থিতি সাপেক্ষে তারা যেমন শর্ত দিতে চায় তেমনি শর্ত যাতে তারা পেশ করে। আমার আবেদন রেডিওতে বেশ কয়েকবার প্রচার করা হয়। কিন্তু গভীর রাত পর্যন্ত দিল্লি রেডিওতে তার কোনো জবাব সম্প্রচার করা হলো না।
সেদিন সন্ধ্যায় আমি নিজামের সঙ্গে দেখা করেছিলাম, তার মনের অবস্থা ঘণ্টায় ঘণ্টায় পরিবর্তিত হচ্ছিল। আমাকে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, নিরাপত্তা পরিষদের কাছ থেকে এখনও কোনো ধরনের আশা রাখার মত পরিস্থিতি আছে কি-না। সেদিন সকাল থেকেই আমি কোন খবরই পাইনি। সুতরাং তাকে বলার মতো আমার কাছে তেমন কিছুই ছিল না। আমি তখনও মনে করছিলাম যে, এখনও হয়তো আশা আছে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব আমাদের আশা রাখতে হবে।
পশ্চিম এবং দক্ষিণ যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থা তেমন একটা সুবিধার দেখাচ্ছিল না, কিন্তু পূর্বের মতো এত খারাপও আবার ছিল না। গভীর রাতে আমি আর্মি হেডকোয়ার্টারে গেলাম। দেখলাম আর্মি কমান্ডার তখন ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। জেনারেল স্টাফরা যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। রাতারাতি পরিস্থিতিতে তেমন কোনো পরিবর্তন হবে না বুঝতে পারলাম। মুসতাক আহমেদ বিমানে করে কিছু শক্তিশালী ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী অস্ত্র পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলেন। বিমান থেকে সেসব বিশাল আকৃতির অস্ত্র নামিয়ে জোড়া লাগাতে অনেক সমস্যা হচ্ছিল এবং শেষ পর্যন্ত সেগুলোকে আর্মি হেড কোয়ার্টারেই আনা হলো। আমি নিজে সেগুলো পরিদর্শন করে দেখছিলাম। তখন মনে মনে ভাবছিলাম, যদি আর কিছুদিন আগে এগুলো পাওয়া যেত। যাই হোক, সেগুলোকে খুব দ্রুত পশ্চিমে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া হলো। যেখানে কি-না প্রকৃতপক্ষে কোনো বড়সড় বন্দুক-কামানই ছিল না।
Click This Link