ব্রিটেনে আমার পরিচিত মানুষের পরিধি খুব কম। তারপরও এর মধ্যেই কয়েকজন ব্রিটিশ মেয়ের সাথে কাজ করতে হয়। এদের প্রতি আমার আগ্রহও কম নয়। তাই ভালোভাবেই এদের লক্ষ্য করি। এখানে আসার পর প্রথম কিছু অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমার কাছে ব্রিটিশ মেয়ে মানেই মদ-গাঁজা, সিগারেট আর যাবতীয় খারাপ নেশায় আচ্ছন্ন বলে মনে হতো। কিন্তু সবাই নিশ্চয়ই এমন না।
আমার মতে, কারো গাড়ি চালানো দেখে তার চরিত্র সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়। আমি এখন যে কম্পানিতে কাজ করি সেখানকার নিয়ম বেশ সুন্দর। যেখানেই কাজ হোক না কেন কম্পানি থেকে যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। এ কারণে ব্যাপারটা মিলিয়ে নেওয়ার চান্স পাচ্ছি।
১.
আমাদের সাথে কাজ করে ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভূত এক মেয়ে, জ্যোতিন্দর। তার চেহারা আমাদের মতো। কিন্তু সে যদি গলা থেকে একটা চি শব্দ করলেও সেটা শুনেও বুঝা যায় যে সে বৃটিশ।
জ্যোতিন্দরের সঙ্গে পরিচয়টাও বেশ মজার। আমি ভাবতেও পারিনি যে সে মেয়ে। অফিস থেকে বলা হয়েছিলো যে জ্যোতিন্দরের সঙ্গে দেখা করে তারপর কাজে যেতে হবে। ফোন নাম্বারটাও পেয়ে গেলাম। কিন্তু ফোন না করে আমি তাকে এসএমএস পাঠালাম যে, সকাল দশটার সময় তার সাথে টেসকোর সামনে দেখা হবে। তার একটা গাড়ি আছে। সময়মতো সে গাড়ি নিয়ে হাজির। কিন্তু আমি ওকে দেখে চমকে উঠলাম। আরে এ তো দেখি জলজ্যান্ত মেয়ে। ছেলেটা গেল কোথায়? পরে মনে হলো এই মেয়েই জ্যোতিন্দর হতে পারে।
জ্যোতিন্দরের গাড়ি চালানোটা সবচেয়ে বেশি উপভোগ করি। সাধারণত সে গাড়ি চালায় সিট বেল্ট না বেধেই। জিজ্ঞাসা করলে বলে, সিট বেল্টে সে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে না (কমফোর্ট ফিল করে না)। তার গাড়িটা হচ্ছে নিল রঙের পিউশো (Peugeot)।
প্রথমদিনই দেখি তার ড্রাইভিংয়ের ক্যারিশমা। রাস্তার পাশের সাইন বোর্ডে গাড়ির স্পিড নির্দেশক বৃত্তটা নির্দেশ করছে, এখানে গাড়ির সর্বোচ্চ গতি থাকার কথা ৩০ মাইল। সেখানে সে নিশ্চিন্তে ৪০ মাইল স্পিডে গাড়ি টানছে। কিছুক্ষণ পরে ক্যাঁচ.. করে স্পিডটা কমিয়ে ফেললো একেবারে ৩০ এর নিচে। সামনে তাকিয়ে দেখি স্পিড ক্যামেরা। আরেকবার এক বড় রাস্তা থেকে বামে মোড় নেয়ার কথা। সেখানে ভুলে একটু সামনে চলে গিয়েছিলো। পরে আবার সেই বড় রাস্তাতেই যেভাবে ব্যাক গিয়ারে গাড়িটা চালালো তাতে ওর প্রতি আমার ভক্তি শ্রদ্ধা অনেক বেড়ে গেলো।
আগেই বলেছিলাম ওর কথাবার্তা পুরোপুরি ব্রিটিশদের মতো। এ কারনে সে যখন বন্ধুদের সাথে ফোনে কথা বলে সেটা বেশ উপভোগ্য হয়। কথাবার্তার অনেক অংশ জুড়ে থাকে বিভিন্ন ইংলিশ গালি আর স্ল্যাং। ব্রিটিশরা যেমন আমাদের ইংরেজি কথাবার্তা সহজে বুঝতে পারে না তেমন সেও আমাদের কথা সহজে বুঝতে পারে না। বারবার বলে বুঝিয়ে দিতে হয়।
একবার এক ড্রাইভার বাম পাশে সিগনাল দিয়েও যাচ্ছিলো না। এ কারনে সে আপনমনে বলছে ফািং ড্রাইভার। আমি তখন ওর পাশের সিটে বসে লজ্জায় বাচিনা। কিসের মধ্যে কি।
কিছুক্ষণ পর সে গাড়িতে বসেই আরেক ফ্রেন্ডের সাথে ফোনে কথা বলছে। যার মধ্যে সেই স্ল্যাংটা অনেকবার ব্যবহার করলো। পরে বুঝলাম ওর এসব কথাবার্তা, স্ল্যাং ব্যবহার খুবই স্বাভাবিক বিষয়।
সে গাড়ির গতি খুব বিপজ্জনকভাবে বাড়া কমা করে কিন্তু হাইওয়েতে স্পিড লিমিট অতিক্রম করে না। ব্রিটেনে গাড়ির গতিসীমা সর্বোচ্চ ৭০ মাইল (ঘণ্টায় ১১২ কিলোমিটার) রাখার নিয়ম। সে সাধারণত এর বেশি গতিতে চালায় না।
গাড়িতে সে সবসময় ইংরেজি গান শুনে। তার বন্ধুদের সাথেও ইংরেজিতে কথাবার্তা বলে। তবে অন্যান্য বৃটিশ মেয়েদের মতো সে সিগারেট খায় না। অন্যান্য নেশা করে কিনা তা জানতে পারিনি এখনো।
২.
জেনিফার নামে দ্বিতীয় মেয়ের সাথে পরিচয় হলো বেশ মজা করেই। জেনিফার একজন খাটি ব্রিটিশ মেয়ে। অফিসের শিডিউলের ব্যাপারে ওর সঙ্গে ফোনে অনেকবার কথা হয়েছিল কিন্তু তখনো দেখা হয়নি। একবার জেনিফারের দায়িত্ব পড়লো আমাকে গাড়িতে করে কাজে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ফোনে জেনিফারের সঙ্গে কথা বলে দেখা করার জায়গা ঠিক করলাম।
নির্দিষ্ট সময়ের কয় মিনিট পর দেখি এক মেয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে হাত বের করে "হ্যালো গাইস” বলে একটা চিৎকার করলো। বুঝলাম জেনিফার এসে গেছে। এখানে রাস্তায় গাড়ির জানালা দিয়ে হাত বের করাটা বা হাত দিয়ে কোনো সিগনাল দেয়া পুরোপুরি নিষিদ্ধ। কিন্তু জেনিফার এই কাজটা প্রায়ই করে।
আমরা দুই জন ছিলাম। দেখা হওয়ার পর জেনিফার জানালো তোমাদের জন্য আমি আজকে কিছু এশিয়ান মিউজিক নিয়ে এসেছি। রাস্তায় যাওয়ার সময় এগুলো গাড়িতে শুনবো। সে বিভিন্ন হিন্দি সিনেমার গান বাজানো শুরু করলো। বুঝলাম এই অত্যাচারে আমার গাড়িতে ঘুমানোর প্ল্যানটা আজকে মাঠে মারা যাবে। আমাদের গন্তব্য ছিলো বাসা থেকে ১৩০ মাইল দূরের এক শহর -ব্রিজেন্ড।
বুঝলাম জেনিফার হিন্দি গানের বিশাল ভক্ত। কয়েকটা গানের সঙ্গে সে গলাও মিলালো। আমি এতো তাড়াতাড়ি অতোটা সহজ হতে পারি না। তবে ওর পাশে বসে হিন্দি গানের সঙ্গে ওর গলা মেলানো দেখে বেশ মজা পাচ্ছিলাম। সে গাড়ির গিয়ার চেঞ্জ করার সময় আমাকে একটা কিল দিয়ে বললো, তুমি কথা বলছো না, খালি হাসছো, ব্যাপারটা কি?
সে জানালো যে, সে নার্সিংয়ের উপর তিন বছরের কোর্স করছে। সে ওই পেশাটাকে বেশ এনজয় করে। আর কয়দিন পর সেখানেই ফুল টাইম কাজ শুরু করবে। জিজ্ঞাসা করলাম তোমার কোর্স ফি কতো? সে জানালো তার কোনো কোর্স ফি নেই। বরং তারা উল্টো পড়ার জন্য টাকা দিচ্ছে। আমি এতো পাউন্ড কোর্স ফি দিচ্ছি শুনে সে বেশ অবাক হলো।
ব্রিটেনে গাড়ির সর্বোচ্চ গতিসীমা ৭০ মাইল হলেও অনেকেই তার চেয়ে ৫-১০ মাইল বেশি গতিতে চালায়। স্পিড ক্যামেরার সামনে আবার গতি ৭০-এর মধ্যে নিয়ে আসে। এতে সাধারণত পুলিশ কিছু বলে না। কিন্তু ১০০ মাইলের ওপর স্পিড বাড়ানো এখানে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। ধরা পড়লে জেলে যেতে হয়। এজন্য লোকজন সাধারণত ১০০ মাইলের উপরে গাড়ির গতি বাড়ায় না। জেনিফার এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তাই ওর গাড়িতে উঠে আমার একটু ভয়ই করতে লাগলো।
মটরওয়েতে জেনিফার খুবই জোরে গাড়ি চালায়। আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে গাড়ির স্পিড ১১০ মাইলে (১৭৬ কিলোমিটার) উঠিয়ে জানালো যে, বেশী গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য গত সপ্তাহেই তার লাইসেন্স থেকে ৩ পয়েন্ট মাইনাস হয়ে গেছে। এইজন্য সে গাড়ির গতি একটু কমই রেখেছে। এদিকে স্পিডমিটারের দিকে তাকিয়ে আমি তো চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় আছে। কি দরকার এতো তাড়াতাড়ি যাওয়ার।
এতো গতিতে গাড়ি চালাতে চালাতে একসময় সে জানালো, তোমরা কি সিগারেট খাওনা?
আমি তাকে জানিয়ে দিলাম, “ আমি এ জিনিস খাইনা"।
সে তবু একটা সিগারেট ধরিয়ে আমাকে সাধাসাধি করতে লাগলো। বলে যে, “তোমরা বড় হয়েছ…”"।
এই ধোঁয়ার মধ্যে আমি কোনো স্বাদ পাইনা জেনে সে বেশ নিরাশ হলো।
জ্যোতিন্দরের সঙ্গে জেনিফারের এদিক দিয়ে বেশ অমিল। জ্যোতিন্দর কোনো কথাবার্তা না বলেই শত শত মাইল গাড়ি চালাতে পারে। কিন্তু জেনিফার পারে না। ক্রমাগত বকবক করতেই থাকে।
বাসায় ফেরার সময় রাস্তার পাশের পুলিশ স্টেশনটা দেখিয়ে জেনিফার বলছিলো, এদের আমি ঘৃণা করি। আই হেট দিস গাইস। জেনিফারের কথায় আবার মজা পেলাম।
ভাবছিলাম, এদের দুজনের চরিত্রও কি তাদের গাড়ির স্পিডের মতোই? জ্যোতিন্দর ছোট রাস্তায় স্পিড লিমিট অতিক্রম করে কিন্তু বড় রাস্তায় করে না। অন্যদিকে জেনিফার কোনো রাস্তাতেই স্পিড লিমিট মানে না। শুধুই নিয়ম ভেঙ্গে যাওয়া....
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০০৮ সকাল ৭:৩৮