ঘাড় ব্যথা কী ?
আমাদের ঘাড় ৭ টি ভাট্রিবা ( কশেরুকা – ছোট ছোট হাড় ) নিয়ে গঠিত, যেটা মাথার হাড্ডির নিচ থেকে সোজা কাঁধ বরাবর এসে শেষ হয় । দুইটা ভার্ট্রিবার মাঝখানে কিছুটা নরম এক ধরনের ডিস্ক থাকে । এটাকে আমরা ইন্টারভার্ট্রিবাল ডিস্ক বলে থাকি । অনেক সময় এই ডিস্ক বের হয়ে এসে ঘাড় বা হাতের নার্ভে চাপ দেয় ফলে ব্যথা ঘাড় এবং হাতে ছড়িয়ে পরে ।
তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সামনে ঝুকে কাজ করার কারনে ঘাড় ব্যথা হয়ে থাকে , বিশেষ করে কম্পিউটারের সামনে অনেকক্ষন ঝুকে কাজ করলে কিংবা শোয়ায় সমস্যার কারনে কিংবা অনেকক্ষন একটানা কোন দিকে তাকিয়ে থাকলে ঘাড়ের মাসলের উপর অতিরিক্ত চাপ পরে, যার জন্য ঘাড় ব্যথা হতে পারে । অনেক সময় ঘাড়ের সমস্যা থেকে মাথা ব্যথাও হতে পারে । এছাড়া হাড় ক্ষ্য় বা বেড়ে যাওয়ার কারণে নার্ভে চাপ লেগে ভোঁতা টাইপ ব্যথা হতে পারে ।
ঘাড় ব্যথা কী কী কারণে হতে পারে ?
ঘাড়ে ব্যথা অনেক কারণে হয়ে থাকে । তাই ঘাড় ব্যথা চিকিৎসা বা প্রতিরোধ যেটাই করতে চাই না কেন সবার আগে আমাদের জানতে হবে ঘাড় ব্যথা কেন হয়। অনেক কারনেই ঘাড় ব্যথা হয়, নিচে কয়েকটা কারণ দেওয়া হলো –
১। হুইপলাস ইনজুরি; অনেক সময় বাসে বা অন্য কোন গাড়িতে আমাদের বসে থাকা অবস্থায় গাড়ি হঠাৎ করে থেমে গেলে আমাদের ঘাড় সামনে চলে যায় ,পরে আবার পিছনে আসে । এইভাবে ঘাড়ের ভিতরে সিরিয়াস ইনজুরি হয়ে যায় । যেটার জন্য দ্রুত চিকিৎসা দরকার হয় ।
২। সারভাইক্যাল স্পন্ডাইলোসিস বা স্পন্ডাইলাসিস এর কারণে বয়স্কদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঘাড়ে ব্যথা হয়ে থাকে । বিশেষ করে হাড় ক্ষয় বা হাড়ে বেড়ে যাওয়ার কারনে এই সব সমস্যা হয়ে থাকে ।
৩। ঘাড়ে কোন আঘাত পেলে মাসল বা লিগামেন্ট ইনজুরি হলে ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে । অনেক সময় জন্মগতভাবে বা আঘাতজনিত ঘাড় একদিকে বাঁকা হয়ে যায় । এটাকে আমরা টর্টিকলিস বলে থাকি । ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নিলে টর্টিকলিস দ্রুতই ভাল হয়ে যায় ।
৪। আমাদের কাজের পরিবেশ থেকে অধিকাংশ ঘাড়ে ব্যথা হয়ে থাকে । বিশেষ করে একটানা কম্পিউটারে কাজ করলে, কিংবা অনেকক্ষন সামনে ঝুকে কোন কাজ করলে, কিংবা একটানা অনেকক্ষন কোনদিকে তাকিয়ে থাকলে আস্তে আস্তে ঘাড়ের মাসল দুর্বল হয়ে যায় । ব্যথাও কম বেশ স্থায়ী হয়ে যায় ।
৫। এঙ্কাইলাইজিং স্পন্ডাইলাইটিস ,রিউমাটয়েড আর্থাইটিস এবং অস্টিওপরোসিস থেকে ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে ।
৬। অনেক সময় মায়োকার্ডিয়াল ইনফাকশন (হার্ট এর্টাক) থেকেও ঘাড় ব্যথা হতে পারে ।
৬। প্যাথলজিক্যাল কারনেও ঘাড় ব্যথা হতে পারে । যেমন টিবি, ক্যান্সার । তবে প্যাথলজিক্যাল কারণে ঘাড়ে ব্যথা হলে ব্যথার সাথে জ্বর আসতে পারে, কাশি থাকতে পারে, ওজন কমে যেতে পারে, সারাক্ষন ব্যথা থাকতে পারে, রাতে ব্যথা বাড়তে পারে ।
৭। এছাড়া আরও অনেক ইমার্জেন্সী সমস্যায় ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে, যেমন মেনিনজাইটিস , সাবডুরাল হেমরেইজ সহ অনেক কারণেই ঘাড় ব্যথা হতে পারে।
ঘাড় ব্যথাকে কখন সিরিয়াসলি নিবেন ?
অধিকাংশ ঘাড়ে ব্যথাই সিরিয়াস কিছু না, হালকা কিছু এক্সারসাইজ করলে দুই এক সপ্তাহের মধ্যে ভাল হয়ে যায় । তবে চিকিৎসক দেখিয়ে ঘাড় ব্যথার কারণ নির্নয় করে চিকিৎসা করলে ঘাড় ব্যথা কোন ব্যাপার না । তবে অনেক সময় আমরা অবহেলা করে ঘাড় ব্যথাকে সিরিয়াস করে পেলি । তবে প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসক দেখালে অনেক সময় কোন পরীক্ষা নিরীক্ষা লাগে না । কারন এক্সরে এম আর আই এর চেয়ে আপনাকে দেখে আপনার সমস্যার কথা শুনে ডায়াগনোসিস করা অনেক সহজ হয় এবং সঠিক ডায়াগনোসিসও হয় । কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এক্সরে আসলে ডিজেনারেটিভ চেইঞ্জ আসে, যেটা সমস্যা থাকলেও আসতে পারে , না থাকলেও আসতে পারে । তাই শুধু রেডিওলজিক্যাল পরীক্ষার উপর নির্ভর করে ডায়াগনোসিস করলে সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সঠিক হয় না ।
তবে ঘাড়ের ব্যথার সাথে জ্বর থাকলে কিংবা ওজন কমে গেলে কিংবা রাতের দিকে ব্যথা বেড়ে গেলে ঘাড় ব্যথাকে সিরিয়াসলি দিতে হবে । এছাড়া যেহেতু হার্টের ব্যথা ঘাড় বা হাতের দিকে যেতে পারে, সেহেতু বুকের বামদিকে ব্যথা হলে সাথে ঘাড় বা হাতে ব্যথা থাকলে জরুরি ভিত্তিতে কার্ডিওলজিস্ট দেখাতে হবে বা হাসপাতালে যেতে হবে ।
ঘাড় ব্যথার কি কি চিকিৎসা আছে ?
ঘাড়ের ব্যথার অনেক ধরনের চিকিৎসা আছে । প্রথমে জানতে হবে কি ধরনের ঘাড়ে ব্যথা । হালকা ব্যথার ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপিস্ট বা জেনারেল ফিজিশিয়ান যথেষ্ট ।
সারভাইক্যাল স্পন্ডাইলোসিস, আঘাতজনিত ঘাড়ে ব্যথা কিংবা কাজের পরিবেশের জন্য যেইসব ঘাড়ে ব্যথা হয় সেই ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপিস্ট আপনার বেস্ট চয়েজ ।বরং এইসব ক্ষেত্রে ওষুধ খেয়ে লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি । তীব্র ব্যথার ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপির পাশাপাশি আপনি একজন অর্থোপেডিক বা নিউরোমেডিসিন বা মেডিসিন বিশেষজ্ঞ দেখিয়ে ওষুধ খেতে পারেন ।
যদি প্যাথলজিক্যাল কারনে ঘাড়ে ব্যথা হয় অর্থাৎ ব্যথার সাথে জ্বর হয়, ওজন কমে যায়, রাতের দিকে ব্যথা বেড়ে যায় সেই ক্ষেত্রে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ আপনার বেস্ট চয়েজ ।
ঘাড়ে ব্যথা হলে কোথায় যাবেন প্রথমে ?
ঘাড়ে ব্যথা হলে প্রথমে কোথায় যাবেন? ফিজিওথেরাপি ডাঃ (বিপিটি) ? এমবিবিএস ডাঃ ? বিশেষজ্ঞ ডাঃ ? অর্থোপেডিক ? নিউরোমেডিসিন? মেডিসিন ? রিউমাটোলজিস্ট ?ফিজিক্যাল মেডিসিন ? বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্ট ? অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে ঘাড় ব্যথা হলে কোথায় যাবেন ? উপরোক্ত চিকিৎসকের যাকে আপনার পছন্দ হয়, তার কাছেই যেতে পারেন । উনি যদি ভাল চিকিৎসক হয়, প্রয়োজন হলে অবশ্যই আপনাকে অন্য বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠাবেন ।
ঘাড়ের ব্যথায় ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা কিভাবে কাজা করে ?
ঘাড়ের ব্যথায় ফিজিওথেরাপি কিভাবে কাজ করে । এটা প্রশ্ন হয়তো আমাদের মনে আসতে পারে । সব ব্যথায় ফিজিওথেরাপি কাজ করবে না, বিশেষ করে প্যাথলজিক্যাল পেইন ( যেমন টিবি, ক্যান্সার, হার্টের ব্যথা প্রভূতি ) থেকেও ঘাড়ে ব্যথা আসতে পারে । এই সব ব্যথায় ফিজিওথেরাপি কাজ করে না । তবে মেকানিক্যাল পেইনে ফিজিওথেরাপি অনেক ভাল কাজ করে । মেকানিক্যাল পেইনে সরাসরি ফিজিওথেরাপিস্টের কাছে এলে আপনার খরচ অনেক কমে যাবে এবং ব্যথার ওষুধ খাওয়া থেকেও রেহাই পাবেন । মেকানিক্যাল পেইন হল সাধারনত ডিস্ক প্রলাপসজনিত ব্যথা, আমাদের কাজের পরিবেশের জন্য সৃষ্ট ব্যথা মাসল স্পাজম জনিত ব্যথা, মাসল ইনজুরি জনিত ব্যথা প্রভূতি ।
ফিজিওথেরাপি কিভাবে ঘাড় ব্যথা ভাল করে ? মেকানিক্যাল পেইনের ক্ষেত্রে অনেক সময় আমরা ব্যথার ভয়ে নড়াচড়া করি না, ফলে ঘাড় শক্ত হয়ে যায়, মুভমেন্ট কমে যায়, মাসল দুর্বল হয়ে যায় । ফলে আস্তে আস্তে পেইন স্থায়ী হয়ে যায় । এই সব ক্ষেত্রে একজন ফিজিওথেরাপিস্ট ম্যানুয়াল ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে মুভমেন্ট ফিরিয়ে আনে, স্ট্রেনথদিং এক্সারসাইজের মাধ্যমে মাসলকে শক্তিশালী করে । ফলে ব্যথা ঘুরে ঘুরে আসে না । এছাড়া ডিস্ক প্রলাপজনিত ব্যথার ক্ষেত্রেও ফিজিওথেরাপি গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা রাখে । ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে ডিস্ক রিডাকশন করা যায় । অনেকে হয়তো মনে করেন ফিজিওথেরাপি মানে হিট তাপ এবং কিছু ইলেট্রোথেরাপি যেমন- শর্টওয়েব, আইএফটি, আল্ট্রাসাউন্ড এইসব যন্ত্রপাতি । আসলেই তা নয় , ফিজিওথেরাপি অনেক বড় বিষয় । ইলেক্ট্রোথেরাপি ফিজিওথেরাপির একটা পার্ট মাত্র । একজন ফিজিওথেরাপিস্ট আপনাকে এসেস করে , আপনার সঠিক ডায়াগনোসিস করে চিকিৎসা দিবেন, একজন ফিজিওথেরাপিস্টের হাতই পারে আপনাকে সম্পূর্ন ভাল করতে ।
বাসায় কিভাবে ঘাড়ে ব্যথার চিকিৎসা করবেন ?
হালকা ব্যথার চিকিৎসায় বাসায় করতে পারেন । হালকা গরম পানির সেক দিতে পারেন । তবে লক্ষ্য রাখবেন ঘাড় আবার পুড়ে যেন না যায় । এছাড়া আঘাত জনিত ব্যথার ক্ষেত্রে বরফকে কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে ১০ মিনিট দিতে পারেন, তবে গরম সেক ভুলেও দিবেন না । সম্ভব হলে আপনার নিকটবর্তী ফিজিওথেরাপিস্ট দেখাতে পারেন ।
সাময়িকভাবে ব্যথা কমানোর জন্য নিচের ব্যায়ামটি করতে পারেন । সোজা হয়ে চিত হয়ে শু্যে পরুন, একটা তোয়ালকে রোল করে ঘাড়ের নিচে দিন । এবার থুতনিতা নিচের দিকে চাপ দিন, ১০ সেকেন্ড ধরে রাখুন । এইভাবে ১০ বার করে দিনে ৩ বার ক্রুন । প্রয়োজনে হাত দিয়ে থুতনিকে নিচের চেপে ধরুন ।
লিংকে ঘাড়ে ব্যথার এক্সারসাইজের ভিডিও আছে । দেখতে পারেন । http://www.youtube.com/watch?v=FDy2usGnsfE
ধন্যবাদ
ডাঃ সাইফুল ইসলাম
প্রতিষ্ঠাতা ও কো-অর্ডিনেটর , ভিশন ফিজিওথেরাপি সেন্টার
হাউজ ২৩, লেক ড্রাইভ রোড, সেক্টর ৭ , উত্তরা , ঢাকা ।
মোবাইল- ০১৯৩২৭৯৭২২৯
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০২০ সকাল ১১:২১