এই লেখাটা প্রথম আলোতে ছাপা হ্ইছিল।
অটিস্টিক শিশু
ডা. আহমেদ হেলাল ছোটন
দর্শকপ্রিয় চলচ্চিত্র 'রেইন ম্যান' এ বিশ্বখ্যাত অভিনেতা ডাস্টিন হফম্যান একজন অটিস্টিক এর চরিত্র রূপায়ণ করে, একজন অটিস্টিক মানুষের বিভিন্ন লণ নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। যারা চলচ্চিত্রটি দেখেছেন তারা অটিজম সম্পর্কে অবশ্যই কিছুটা ধারণা পেয়েছেন। আর আমাদের আশেপাশে হয়তো আমরা এমন কিছু শিশু কখনও দেখে থাকি যারা নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকে, সামাজিকভাবে আর দশটা শিশুর মত বেড়ে উঠেনা এবং আচরণগত অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। এ ধরণের রোগ লণ থাকলে তাকে বলা হয় অটিজম। অটিজম এক ধরণের রোগ আর যেসব শিশু এ রোগে আক্রান্ত হয় তাদের বলা হয় অটিস্টিক শিশু। শিশু অবস্থাতেই এ রোগ লণ প্রকাশ পায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুর বয়স ৩ বছর হবার আগেই অটিজমের লণ গুলো প্রকাশ পায়। অটিস্টিক শিশুর েেত্র সাধারণত যে সমস্ত অস্বাভাবিকতা দেখা যায় তা হলো-
এক.
►স্বাভাবিক একটি শিশু যেভাবে বেড়ে ওঠে, যেভাবে সামাজিক সম্পর্কগুলোর সাথে ধীরে ধীরে যোগাযোগ তৈরি করে সেই প্রক্রিয়া অটিস্টিক শিশুর েেত্র দেখা যায় না।
►সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন প্রক্রিয়ায় শিশুর গুণগত ঘাটতি থাকে। বাবা মা বা প্রিয়জনের চোখে চোখ রাখতে, মুখভঙ্গি ও শারীরিক অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে নিজের চাওয়া বা না-চাওয়া বোঝাতে সে অপারগ হয়।
►সমবয়সী শিশুদের সাথে তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেনা - অমিশুক প্রবণতা থাকে।
►কোনো ধরণের আনন্দদায়ক বস্তু বা বিষয় সে অন্যদের সাথে শেয়ার করে না- যেমন স্বাভাবিক একটি শিশু কোনো খেলনা হাতে পেলে সেটার দিকে অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কিন্তু অটিস্টিক শিশুর েেত্র এধরণের কোনো খেলনার প্রতি তার নিজস্ব কিছু আগ্রহ থাকলেও সেটা নিয়ে তার কোনো উচ্ছ্বাস থাকে না।
►অটিস্টিক শিশুর বাবা মায়েরা বলে থাকেন- 'আমার বাচ্চা আদর করা পছন্দ করে না!' , দেখা যায় শারীরিক আদর, চুমু দেওয়া, চেপে ধরে কোলে নেয়াটা অটিস্টিক শিশুরা খুবই অপছন্দ করে। তারা কারো কোলে চড়তে পছন্দ করে না।
দুই.
►পরিবেশ ও প্রতিবেশ এর সাথে যোগাযোগ করার মতা গড়ে উঠার বিষয়টি শিশুর গঠনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। অটিস্টিক শিশুর ক্ষেত্রে এই যোগাযোগ তৈরি করার মতা কমে যায়- দেখা যায় ২ থেকে ৩ বছর বয়সে স্বাভাবিক শিশুরা যেসমস্ত শব্দ উচ্চারণ করতে পারে সমবয়সী অটিস্টিক শিশুরা তা পারে না, বাবা মায়েরা বলেন 'আমার বাচ্চাতো এখনো কথা বলা শিখলো না'।
►আবার কোনো ক্ষেত্রে অটিস্টিক শিশুটি স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে হয়ত পারে কিন্তু একটি বাক্য শুরু করতে তার অস্বাভাবিক রকম দেরি হয় অথবা বাক্য শুরু করার পর তা শেষ করতে পারে না।
►কখনো বা দেখা যায় একই শব্দ বার বার করে সে উচ্চারণ করে যাচ্ছে। অটিস্টিক শিশুকে যদি প্রশ্ন করা হয় 'তুমি কি চকলেট পছন্দ করো?' - দেখা যায় এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সে প্রশ্নটিই আবার উচ্চারণ করে -'তুমি কি চকলেট পছন্দ করো?'
►৩ বছরের কম বয়েসী শিশুরা তার বয়সের উপযোগী নানা রকম খেলা স্বতস্ফূর্তভাবে নিজেরাই তৈরি করে খেলে -কিন্তু অটিস্টিক শিশুরা এরকমটি করে না।
তিন.
►বিশেষ ধরণের আচরণ বারবার সে করতে থাকে। হয়ত হাত দোলাতে থাকে বা আঙুল নাড়াতে থাকে।
►আওয়াজ পছন্দ করে না।
►তারা রুটিন মেনে চলতে ভালোবাসে। দৈনন্দিন কোনো রুটিনের গড়বড় হলে অটিস্টিক শিশুরা মন খারাপ করে। রাতে ঘুমাবার আগে হাত মুখ ধুয়ে, কাপড় বদল করে বিছানায় যাওয়ার অভ্যাস হয়তো প্রায় সব শিশুরই থাকে কিন্তু কখনো এর ব্যত্যয় ঘটলে সাধারণ শিশুরা কিছু মনে না করলেও অটিস্টিকদের বেলায় দেখা যায় তারা খুবই মন খারাপ করে। পারিপার্শ্বিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন তারা সহ্য করতে পারে না।
►কোনো কোনো অটিস্টিক শিশু কোনো কারণ ছাড়াই দেখা যায় হঠাৎ করে রেগে উঠে বা ভয়ার্ত হয়ে যায়।
►অটিস্টিক শিশুদের মধ্যে পঁচিশ শতাংশের খিঁচুনি থাকতে পারে।
উপরের লন গুলির মধ্যে যে কোনো কোনোটি সাময়িক সময়ের জন্য স্বাভাবিক শিশুদের মধ্যেও থাকতে পারে- তাই একটি লণ দেখেই বাবা মায়েরা যেন ভেবে না বসেন তার শিশুটি অটিস্টিক। আর একজন অটিটিস্টক শিশুর মধ্যে যে উপরের সবগুলো লণ একসাথে থাকবে তাও নয়। আবার বাবা মায়েদের এটাও খেয়াল রাখতে হবে যে এ ধরণের কয়েকটি লণ তার সন্তানের মধ্যে বেশি দিন ধরে দেখা যাচ্ছে কিনা- যদি তা হয় তবে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপণ্ণ হতে হবে।
সমীক্ষায় দেখা যায় বিশ্বের প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে একজন অটিজমে আক্রান্ত হয়। মেয়ে শিশুদের তুলনায় ছেলে শিশুদের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা প্রায় চার গুন বেশি। বর্তমান সময়ে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এবং আমাদের দেশেও অটিজম অত্যন্ত আলোচিত একটি বিষয়। কিন্তু অটিজম কেন হয় তার সুস্পষ্ট কারণ এখনো আবিষ্কার হয়নি। তবে জেনেটিক প্রভাব এ রোগের উপর আছে। সাধারণ যে কোনো শিশুর চাইতে যাদের ভাই বা বোন অটিস্টিক তাদের এরোগ হবার সম্ভাবনা প্রায় ৫০ গুণ বেশি। ধারণা করা হয় ক্রোমোজম নম্বর ৭ এর অস্বাভাবিকতার সাথে অটিজমের সম্পর্ক আছে। গর্ভাবস্থার বা সন্তান জন্মাবার সময় জটিলতা হলে অটিজম হবার সম্ভাবনা বাড়ে বলে মনে করা হয়। স্বাভাবিক শিশুদের বেলায় সাধারণত দেখা যায় চার বছর বয়সের মধ্যেই তারা অন্যদের বিশেষ করে সমবয়সীদের চিন্তাধারা সম্পর্কে ধারণা করতে শেখে- কিন্তু অটিস্টিক শিশুরা এ বয়স থেকে নিজের ভেতর গুটিয়ে যায়, অন্যরা কি করছে- বা ভাবছে এ সংক্রান্ত চিন্তা করার মতা তাদের থাকেনা।
অটিস্টিক শিশুদের মধ্যে ১০-২০% শিশু চার থেকে ছয় বছর বয়সের মধ্যে মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠে, এবং সাধারণ স্কুলে স্বাভাবিক শিশুদের সাথে পড়ালেখা করতে পারে। আরো ১০-২০% শিশু স্বাভাবিক শিশুদের সাথে পড়তে পারে না, তারা বাসায় থাকে বা তাদের জন্য প্রয়োজন হয় বিশেষায়িত স্কুল ও বিশেষ প্রশিণের; বিশেষায়িত স্কুলে পড়ে, ভাষা সহ বিভিন্ন ধরণের প্রশিণ গ্রহন করে তারা সমাজে মোটামুটি স্থান করে নেয়। কিন্তু বাদবাকি প্রায় ৬০% অটিস্টিক শিশু, সব ধরণের সহায়তা পাওয়ার পরও স্বাধীন ভাবে, এককভাবে জীবন অতিবাহিত করতে পারে না- তাদের জন্য প্রয়োজন হয় দীর্ঘ দিনের- প্রায় সারা জীবনের জন্য অন্যের উপর নির্ভরতা। বিশেষ আবাসনে, বিশেষ নার্সিং কেয়ার এর প্রয়োজন হয় তাদের।
সাধারণত তিনটি বিষয়ের উপর ল্ক্ষ্য রেখে অটিস্টিক শিশুর চিকিৎসা দেয়া হয়- প্রথমত, অস্বাভাবিক আচরণ পরিবর্তনের জন্য শিশুর বাবা মাকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন; যাতে তারা বাড়িতে শিশুর আচরণগত পরিবর্তণ করতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। আচরণের পরিবর্তণ হলে পরিবার ও সমাজে ভবিষ্যতে শিশুটি স্বাভাবিক ভাবে জীবন যাপন করতে পারবে। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও মনোবিদগণের পরামর্শ জরুরী। দ্বিতীয়ত, বিশেষায়িত স্কুলের মাধ্যমে অটিস্টিক শিশুকে একদিকে যেমন প্রথাগত শিক্ষা প্রদান করা হয় তেমনি ভবিষ্যতে তার জন্য উপযোগি যে কোনো পেশাগত প্রশিণ দেয়া হয়। তৃতীয়ত, প্রয়োজন অনুযায়ী রোগলক্ষণ অনুযায়ী কিছু ওষুধ প্রদান ও সাইকোথেরাপিও প্রয়োজন হতে পারে- তবে তা অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী।
যে পরিবারে একজন অটিস্টিক শিশু রয়েছে সে পরিবারের সদস্য বিশেষ করে বাবা-মায়ের জন্য প্রয়োজন বিশেষ সেবা-পরামর্শ। তারা যেন অটিস্টিক শিশুটিকে নিজেদের বোঝা মনে না করেন অথবা শিশুর অটিজমকে লুকিয়ে না রেখে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও বিশেষায়িত স্কুলের সাহায্য গ্রহণ করেন সে বিষয়ে সকলেরই সচেতনতা প্রয়োজন। আমাদের দেশেও এখন বেশকিছু প্রতিষ্ঠান অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে প্রশংসনীয় কাজ করে যাচ্ছে, আসুন আমরা সকলেই সচেতন হই- এগিয়ে আসি এই একটু পিছিয়ে পড়া অটিস্টিক শিশুদের সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনতে।
অটিস্টিক শিশুদের জন্য ভালোবাসা
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০০৮ রাত ১:৪৩