অনেকের মনেই একটা প্রশ্ন আছে, সেটা হল, "অনলাইন ইনকাম" কি সত্যিই সম্ভব?" ক্রমবর্ধমান নিত্য নতুন টেকনোলজির এই যুগে সবকিছু যখন আস্তে আস্তে অনলাইনকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে, তখন কেন সম্ভব নয়! কিন্তু, কথা হচ্ছে টাকা ইনকাম যদি ডুল্যন্সার/স্কাইল্যন্সারের কয়েকটি অ্যাকাউন্ট খুলে সমানে মাউসের উপর অত্যাচার করলেই হয়ে যেত কিংবা ডেসটিনিতে লোক ঢুকানোর জন্য গলায় টাই ঝুলিয়ে ভদ্র ভাষায় ভিক্কা চাইলেই হয়ে যেত তাহলে তো বাংলাদেশের সবাই বড়লোক হয়ে যেত! টাকা ইনকাম এত সোজা একটা জিনিস না। এর জন্য শ্রম দিতে হয়, সময় দিতে হয়, কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। বিভিন্ন লিংকে মাউস দিয়ে ক্লিক করাকে যারা এতদিন অনলাইন ইনকাম হিসেবে ধরত, নিজেদেরকে ফ্রীল্যন্সার হিসেবে সগর্বে ঘোষণা করত-সেই সব ডুল্যন্সার/স্কাইল্যন্সার বাহিনীর সবাই যে এখন তাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের দেখলে লজ্জায় মুখ লুকায়-সেই কথা এখন সবার জানা আছে। অবশ্য, তাদের পুরাপুরি দোষ দিয়েও লাভ নাই। কারন হিসেবে আমি বলব, সেইসব অ্যানালগ/ডিজিটাল এমএলএম কম্পানীর প্রতারিত বেশীরভাগই আমাদের বর্তমান তরুন প্রজন্ম বা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছেলে-মেয়েরা। সমস্যা হচ্ছে, কলেজ বা ভার্সিটি পড়ুয়া সবারই কিছু হাত-খরচ আছে। বাবা-মা'র কাছ থেকে আর কতই বা হাতখরচ নেয়া যায়। তাই, তারা যখনই শুনে অমুক জায়গায় এতজন লোক ঢুকাতে পারলে এত টাকা পাওয়া যাবে, অমুক ওয়েবসাইটের অ্যাডগুলোতে ক্লিক করলে এত টাকা দেয়া হবে-তখন সামান্য কিছু ইনকামের আশায় হুজুগে বাঙালীর মত তারা সবাই ঝাঁপিয়ে পরে। তারপর প্রতারিত হবার পর শুধু তারা এটুকুই উপলব্ধি করতে পারে যে তারা তাদের কি মূল্যবান সময়ই না নষ্ট করেছে এতদিন ধরে! কিন্তু, লাখ লাখ টাকার লোভ দেখানো সেই প্রতারক প্রতিষ্ঠানগুলো তো আর বসে থাকে না। কয়েকদিন পরে নিত্য নতুন নাম আর কৌশল নিয়ে হাজির হয়। তাদের মিষ্টি কথায় অতীত অভিজ্ঞতা ভুলে আবারো শত শত তরুন-তরুনি দলে দলে পা দেয় তাদের ফাঁদে। কারন কি?-আমরা হুজুগে বাঙালি। তবে, প্রকৃত কারন কি, কিছু যদি ইনকাম করা যায়...
কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশের বেশিরভাগ কলেজ/ভার্সিটির শিক্ষার্থীদের ইনকামের প্রধান পথ হচ্ছে টিউশনি। বাংলাদেশ অধিক জনসংখ্যার দেশ হওয়ায় বাসায় টিউটর প্রয়োজন এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা যেমন অনেক বেশি তেমনি চক্রবৃদ্ধিহারে তাদের টিউটরদের সংখ্যাও অনেক বেড়ে গেছে। ফলাফলসরূপ, অনেক কলেজ/ভার্সিটির শিক্ষার্থীইকেই বেকার জীবন কাটাতে হচ্ছে। সুতরাং যারা টিউশনি বা হাত খরচ বা ফ্যমিলি থেকে চাপ কমাতে চাবার জন্য ইনকামের কোন পথ পাচ্ছে না-তাদের এমন এক সেক্টর পছন্দ করতে হবে- যেখানে প্রচুর কাজ আছে এবং সেইসব কাজের জন্য দক্ষ লোকদের প্রচুর চাহিদা আছে, যেখান থেকে সম্মানজনকভাবে-গর্বের সাথে ইনকাম করা যায়। এরকমই একটি সেক্টর হচ্ছে ওয়েব ডেভালাপমেন্ট সেক্টর। এখন কথা হচ্ছে, অনলাইনে কীভাবে এই সেক্টরে কাজ করা যায়? আমরা সবাই জানি, বর্তমান যুগ টেকনোলজির যুগ, প্রযুক্তির যুগ। আগেরদিনে মানুষ তার ব্যবসা প্রসারের জন্য বিভিন্ন জায়গায় অ্যাড দিত। এই নিয়মটা এখনও প্রযোজ্য। আমরা প্রায়ই দেখি রাস্তার সাইনবোর্ডে, পত্রিকায় বিভিন্ন অখ্যাত-বিখ্যাত বিজনেস কোম্পানির বিভিন্ন অ্যাড। তাদের এসব অ্যাডের মূলকথা হচ্ছে তাদের পণ্য সম্পর্কে মানুষকে ধারনা দেয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু, এখন ইন্টারনেটকে বিজনেসের অন্যতম মাধ্যম ধরা হয় যেহেতু কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন ইন্টারনেট ব্যবহার করছে এবং ইন্টারনেট ছাড়া তারা এক মুহূর্তও কল্পনা করতে পারে না। সেইজন্য সব বিজনেস প্রতিষ্ঠানই তাদের সম্পর্কে ধারনা দিতে ইন্টারনেটকে বেছে নিয়েছে। এখন সব প্রতিষ্ঠানই নিজেদের ওয়েবসাইট বানায় যেখানে তাদের সম্পর্কে সব বিস্তারিত তথ্য দেয়া থাকে। শুধু যে, বিজনেস প্রতিষ্ঠানই যে তাদের ওয়েবসাইট বানায় তা না, বিভিন্ন স্কুল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সেবামূলক সংস্থা, হাসপাতাল এরকম অসংখ্য প্রতিষ্ঠান তাদের সেবা সম্পর্কে মানুষকে জানানোর জন্য তাদের ওয়েবসাইট বানাচ্ছে। উন্নত দেশগুলোতে যেসব প্রতিষ্ঠানের একটি প্রফেসনাল ওয়েবসাইট নাই, তাদেরকে খুবই তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখা হয়। এজন্যই তো উন্নত দেশগুলোর একটি মুদি দোকানেরও নিজস্ব ওয়েবসাইট থাকে! নামে ডিজিটাল বাংলাদেশ হলেও এ দেশে আসলে তথ্য-প্রযুক্তির জোয়ার সেরকমভাবে আসেনি এখনও। একেবারেই যে আসেনি তা বলা যাবে না। কিন্তু, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য যথেষ্ট দ্রুতগতিতে আসেনি। কিছু ডিজিটাল ভাব এসেছে তা বোঝা যায়-আগে কোন ট্রেন কখন ছাড়বে তা জানার জন্য কমলাপুর ষ্টেশনে যাওয়া লাগত। কিন্তু, এখন বাসায় বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমরা তা জেনে নিতে পারি; বহির্বিস্বের মত আমাদের দেশেও এখন অনলাইনে কেনা-বেচা, বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ভর্তি নেয়া ইত্যাদি শুরু হয়েছে। অর্থাৎ, আমরা দেখতে পাচ্ছি ইন্টারনেটে বিভিন্ন সেবা/বিজ্ঞাপনের পরিমান দিন দিন বাড়ছেই। এখন, এমনও ব্যবস্থা হয়েছে যাতে বাংলাদেশে বসে একজন স্থায়ীভাবে আমেরিকা, ইংল্যান্ডে চাকরি করতে পারে। সুতরাং, ইন্টারনেট জগতে প্রতিদিন অসংখ্য ওয়েবসাইট তৈরি করার প্রয়োজন হচ্ছে, এসব ওয়েবসাইট কয়েকদিন পরপরই আপডেট করা লাগছে, মেইন্টেইন করা লাগছে, বিভিন্ন সেবা দেয়ার জন্য প্রতিদিন প্রচুর পরিমানে ওয়েব অ্যাপ্লিকেশান তৈরি করার প্রয়োজন হচ্ছে, আপডেট করা লাগছে-এসব অসংখ্য কাজ করার জন্য সারা বিশ্ব আপনাকে খুঁজবে যদি আপনি দক্ষ হন! আপনি ঘরে বসেই ইউএসএ/ইংল্যান্ড/ফ্রান্সের যেকোনো একটা অনলাইন ওয়েবসাইট/অ্যাপ্লিকেশান তৈরি/আপডেট করে দিতে পারবেন। এখন কথা হচ্ছে, ইউএসএ/ইংল্যান্ডর একজন লোক/একটি কোম্পানি কেন বাংলাদেশের একজন ছেলে/মেয়েকে দিয়ে কাজটি করাবে? তাদের দেশে কি দক্ষ লোকের এতই অভাব পড়ল নাকি!? না, সেরকম কিছুই না। তাদের দেশে সংখ্যার দিক দিয়ে আমাদের তুলনায় টেকনোলজিতে প্রচুর দক্ষ জনশক্তি আছে। কিন্তু, ইউএসএর মত দেশে অফিসের শুধু প্রিন্টার দিয়ে প্রতিদিন প্রিন্ট দেয়া একজন লোককে মাসে প্রায় ২ লক্ষ টাকা বেতন দিতে হয় যেখানে এ দেশের মাস্টার্স পড়া একজনকে ৫০ হাজার টাকা বেতন দিলেই সে খুসিতে রাজি হয়ে যেত। আর এ কারনেই ইউএসএ/ইংল্যান্ড/অস্ট্রেলিয়া থেকে বড় বড় কোম্পানির লোকেরা সবসময় নজর রাখছে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের মত দেশগুলোর দক্ষ ছেলেমেয়েদের উপর। তারা তাদের মিলিয়ন ডলারের কাজগুলো অনলাইনের মাধ্যমে এসব দেশ থেকে করিয়ে নিচ্ছে ১০০-১,০০০ ডলারে। এভাবে অনলাইনের মাধ্যমে স্যলারির বিনিময়ে কোন একটি প্রজেক্ট/জব সম্পূর্ণ করাকেই আউটসোর্সিং/ফ্রীল্যান্সিং বলে। এখন কথা হচ্ছে, আপনার সাথে সেইসব কোম্পানির যোগাযোগ হবে কীভাবে বা তারা আসলে কীভাবে জানবে যে, আপনি তাদের কাজ করার জন্য পারফেক্ট? এ যোগাযোগের জন্য বিভিন্ন ইন্টারন্যাশনাল জব মার্কেটপ্লেস তৈরি হয়েছে যেমনঃ ওডেস্ক, ফ্রীল্যান্সার, ইল্যান্সার ইত্যাদি। এর মধ্যে ওডেস্ক সারা বিশ্বব্যাপি সচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। এখানে প্রতিদিন হাজার হাজার জব পোস্ট হয়। দক্ষ ছেলেমেয়েরা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী বিভিন্ন জবে অ্যাপলাই করে এবং বায়াররা(যারা জব দেয়, তাদেরকে ওখানে বায়ার বলে) তাদের জবের জন্য উপযুক্ত কাউকে পেলেই উপযুক্ত পারিস্রমিকে তাকে জবটি দিয়ে দেয়। আর এ কারনে এতক্ষনে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আমি আপনাদের যেই "অনলাইন ইনকাম" বিষয়ে ধারনা দিতে চেষ্টা করেছি, সেই অনলাইন ইনকাম মোটেও শুধু হাতখরচের ব্যবস্থা করার জন্য না, বরং আপনার ধারনারও বাইরে অনেক বেশিকিছু। ওয়েব ডেভালাপমেন্ট সেক্টরে আপনি যদি সত্যিই দক্ষ হতে পারেন-তাহলে আপনাকে কখনোই বসে থাকতে হবে না-গ্যরান্টি। কারন তখন আপনি চাকরির জন্য খোঁজাখুঁজি করবেন না। বড় বড় কোম্পানির লোভনীয় চাকরিই আপনাকে খুঁজে নিবে। আর এই সেক্টরে যে কেউই তার সুবর্ণ ক্যারিয়ার গরতে পারবে। আর শিক্ষার্থী থাকা অবস্থাতেই যদি আপনি বিশাল এই সেক্টরের ইন্টারন্যাশনাল পরিধিতে প্রবেশ করতে পারেন, তাহলে আপনার কয়েকটি লাভ হবে। একে তো যেই হাতখরচের জন্য আপনি এতটা মরিয়া ছিলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি ধারনার বাইরে ইনকাম করতে পারবেন ঘরে বসেই, দ্বিতীয়ত যারা আন্ডারগ্র্যজুয়েসন/ গ্র্যজুয়েসন শেষ করে জব মার্কেটে পা রাখবে, তাদের চেয়েও আপনি তখন অনেক বেশি অভিজ্ঞ থাকবেন, অনেক উপরের লেভেলে থাকবেন।
বস্তুত, সোসিয়্যাল কমিনিউটির কারনে অনেকেই এখন অনলাইনে টাকা উপার্জন নিয়ে কম বেশি ধারনা রাখেন। তারা যদি কষ্ট করে এতক্ষণ এই লেখাটা পড়ে থাকেন-তাহলে হয়ত নতুন কিছুই শিখলেন না। কিন্তু, অল্প কয়েকজনেরও যদি এ সম্পর্কে আগে স্বচ্ছ ধারনা না থাকে এবং তারা যদি এই লেখা পড়ে অনলাইনে সত্যিকারভাবে আয় করা নিয়ে একটু হলেও স্বচ্ছ ধারনা লাভ করতে পারে-তাহলেই এই লেখার সার্থকতা। আজ এই পর্যন্তই। পরবর্তীতে হাজির হব ওডেস্কের পরিচিতি নিয়ে।
এই লেখাটি প্রথম প্রকাশ হয়েছিল আমাদের ফেসবুক পেজে । পেজটিতে আপনারা আউটসোর্সিং, ওডেস্ক, ওয়েব ডিজাইন/ডেভালাপমেন্ট ইত্যাদি যে কোন বিষয়ে সাহায্য লাগলে/ প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন। সাধ্যমত চেষ্টা করব সাহায্য করতে। আউটসোর্সিং এবং ওডেস্ক নিয়ে আজকের প্রথম আলো পত্রিকার রিপোর্টটি পড়ে দেখতে পারেন। ভাল লাগবে।
২য় পর্ব