পুর্বের দুই পর্বঃ
১।আধুনিক স্মার্টফোনের অপারেটিং সিস্টেমের গল্পকথা(পর্ব ০-প্রারম্ভিকতা)
2. আধুনিক স্মার্টফোনের অপারেটিং সিস্টেমের গল্পকথা (পর্ব ১- নকিয়া)
আজকের পর্বে থাকবে অ্যাপলের জনপ্রিয় আইফোন এবং গুগল কতৃক প্রজননকৃত অ্যানরয়েডের অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে কিছু ফাউল প্যাচাল।
অ্যাপলের আইফোন ওস : মোবাইল কম্পিউটিং সিস্টেমে বিপ্লব আনার কৃতিত্ব অ্যাপলকে দিতে হবে ঠিক যেমন পূর্বে এনেছিল পারসোনাল কম্পিউটিং ক্ষেত্রে লিসা নামক গ্রাফিকাল ইন্টারফেস দিয়ে। অ্যাপলের আইফোন রিলিজের পর থেকে অনেক ফোন এসেছে যা বিশেষজ্জ্বরা চিহ্নিত করেছিল আইফোন কিলার হিসেবে যেমনঃ HTC ড্রিম, সনি এরিকসন ব্রান্ডের Xperia, ব্ল্যাকবেরি স্ট্রোম, নকিয়ার N97। কিন্তু এইসব কথিত আইফোন কিলার কোনটিই আইফোনের সমান সাফল্য অর্জন দূরের কথা, আইফোনের কেশাগ্র পর্যন্ত
স্পর্শ করতে পারে নাই। এক আইফোন দিয়ে অ্যাপল স্মার্টফোনের বাজারে ১০% বেশি শেয়ার দখল করে নিয়েছে। শুধু তাই না আইফোন থেকে অ্যাপল স্টোরের মাধ্যমে অ্যাপল অতিরিক্ত ইনকাম করে নিচ্ছে। খুব সংক্ষেপে দেখে আসা যাক আইফোনের অপারেটিং সিস্টেমের পিছনে কি আছেঃ
আইফোনের অপারেটিং সিস্টেমের কোর পার্ট ম্যাক ওস X কোর পার্ট থেকে ধার করা। বলা যেতে পারে,আইফোনের অপারেটিং সিস্টেম ম্যাক ওস X এর মোবাইল সংস্করণ।তবে এই কোর পার্ট কিংবা কার্ণেল এসেছে লিনাক্সের পিতা ইউনিক্স হয়ে এবং নব্বই দশকে অ্যাপল থেকে বহিস্কৃত জবসের চেস্টা এবং বিলিয়নইয়ার রস প্যারটের(এই সেই প্যারট যে ক্লিনটন এবং সিনিয়র বুশের সাথে ইলেকশন করেছিল) টাকায় প্রতিষ্ঠিত NeXT কোম্পানির Nextstep এবং OPENSTEP এর ফসল হিসেবে। অথাৎ ইউনিক্স->Nextstep->OPENSTEP->ম্যাক ওস X->আইফোনের অপারেটিং সিস্টেমের কার্ণেল।ইউনিক্স এবং Nextstep এর মধ্য আরও স্টেপ থাকতে পারে। ম্যাক ওস X এর ডিজাইন এবং প্রোগ্রামিং করা হয়েছে আইবিএমের PowerPC এবং ইন্টেলের x86 মডেলের উপর। কিন্তু আইফোনের প্রসেসর হল মোবাইল উপযোগি প্রসেসর ARM।তাই আইফোনের জন্য লোয়ার লেভেলে অ্যাপলকে আবার হালকা-পাতলা প্রোগ্রামিং করতে হওয়ার কথা ভিন্ন রকম এক প্রসেসরকে ইন্টেগ্রেড করার জন্য। এখানে একটা মজার কথা বলে রাখি অ্যাপল যখন ইউনিক্সবেসড ম্যাক ওস বাহির করে মার্কেটে, তখন লিনাক্সের জনক লিনাস ট্রোভল্ডাস ম্যাক ওসকে রাবিশ প্রোডাক্ট হিসেবে অভিহিত করেছিল। স্টিভ জবস তখন বিনয়ের অবতার সেজে প্রতিউত্তরে বলেছিল," আমার প্রোডাক্ট জঞ্জাল মেনে নিলাম, আপনি আমার সাথে আসুন, একসাথে কাজ করে এই সিস্টেমের আবর্জনাকে দূর করে ফেলি"। বলা বাহুল্য যে, সেই আবেদন প্রত্যাখাত হয়েছিল লিনাস ট্রোভল্ডাস থেকে। লিনাস ট্রোভল্ডাস কতৃক অভিহিত সেই রাবিশের কোর পার্টের অংশ ব্যবহৃত হয়েছে ব্যবসায়িক ভাবে বিপ্লব বইয়ে দেওয়া আইফোনের অপারেটিং সিস্টেমের কার্নেল হিসেবে। আচ্ছা এখানে অনেকক্ষণ কার্ণেল/'কোর পার্ট' ইউনিক্স লাইক সিস্টেম নিয়ে কথা বললাম, একটা চার্ট দিয়ে দিলে খারাপ হয় না, যেখানে থাকবে ইউনিক্সের সন্তান,নাতি-পুতি অথার্ৎ মিনিক্স,লিনাক্স,সোলারিজ,ম্যাক ওস এক X.
ছবিঃ ইউনিক্সের বংশধারা(উইকিপিডিয়া থেকে ধারকৃত)। লিংক(বড় করে দেখার জন্য)ঃView this link
কিন্তু প্রশ্ন আসতে পারে,অ্যাপলের এই জনপ্রিয়তার পিছনের কারণতো অন্য কিছু।হুমম, আইফোনের অনন্যা উইজার ইন্টারফেস তথা মাল্টিটাচস্ক্রীন এই জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। অ্যাপলের এই মাল্টিটাচস্ক্রীনের পিছনে আছে অপারেটিং সিস্টেমের একটি পার্ট, রয়েছে দখলদারিত্বের গল্প এবং জবসের ভবিষ্যত দর্শন। ২০০০ সালের আগে FingerWorks নামক একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আমেরিকার দেলওয়ার স্টেটে যাদের গবেষণা এবং উৎপাদন ছিল মাল্টিটাচস্ক্রীন বেসড ইলেকট্রনিক প্যাড এবং কি বোর্ড। অ্যাপল ২০০৫ সালে এই কোম্পানি কিনে নেয়। এখানে একটা কথা বলে রাখা উচিত, অ্যাপল মোবাইল বিজনেসে আগমন শুরু হয় মটোরালার ROKR E1 মাধ্যমে, ROKR E1 মোবাইলে অ্যাপলের আইটিউন ইন্টিগ্রেটেড ছিল। কিন্তু ROKR E1 ব্যবসায়িক সাফল্য আশানুরুপ না হওয়াতে অ্যাপল AT&T এর সাথে যৌথ উদ্যগে নিজস্ব ফোন তৈরির পদক্ষেপ নেয়। AT&T অ্যাপলকে হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার তৈরির স্বাধীনতা প্রদান করে। তার ফলশ্রতিতে ম্যাক ওসের কার্ণেল এবং FingerWorks এর মাল্টিটাচস্ক্রীনকে সুন্দরভাবে কম্পোজ করে অ্যাপল তৈরি করে সাড়া জাগান মডেল আইফোন। আইফোনের অপারেটিং সিস্টেমে মাল্টিস্ক্রীনের জন্য আলাদাভাবে একটি লেয়ার তৈরি করা হয়েছে যার নাম কোকোয়া টাচ লেয়ার। এত সাড়া জাগান একটি ফোন, যার জন্য সাধারণ ব্যবহারকারীরা রাতের পর রাত লাইনে দাড়িয়ে থাকে ফোনটি ক্রয় করার জন্য, সেই ফোনটি সমোলচনামুক্ত নয়। প্রথম দূর্বলতা মনে হয়েছে, জাভা সাপোর্ট না করা(সান এবং অ্যাপলের আলাপ চলছে এই ব্যাপারে)। দ্বিতীয় হচ্ছে, অ্যাপলের দখলদারি মনোভাব, আমার ভার্সিটির জুনিয়র এক ভাই যে একজন ভাল মোবাইল প্রোগ্রামার ও, কথা প্রসঙ্গে বলল অ্যাপলের আইফোনের API ওয়েলডকুমেন্টেড না,প্রোগ্রামিং সেন্স থেকে সে আরও কিছু দূর্বলতার কথা বলল। হয়ত আরও দূর্বলতা আছে,যারা অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলাপ করে অথবা ওস নিয়ে কাজ করে তারা বলতে পারবে ভাল।
অ্যাপলের কামান থেকে সম্ভবত নেক্সট গোলা বাহির হতে যাচ্ছে অ্যাপল ইন্টারনেট ট্যাবলেট,যা হতে পারে ইন্টেলের অ্যাটম বেসড প্রসেসরের উপর।
ছবিঃ অ্যাপল ট্যাবলেট(গুজবে যে ছবি নেটে এসেছে)
পরিশেষে, আইফোন এখনও মোবাইলের বড় মার্কেট চায়নাতে প্রবেশ করে নাই, শীঘ্রই হয়ত করবে।চায়না প্রবেশের পর আইফোনের মার্কেট শেয়ার আরও বাড়বে। তবে অ্যাপলের সবচেয়ে বড় দূর্বলতা হচ্ছে আমাদের মত দেশে(ভারত সহ) অ্যাপলের বড় কোন বেস নেই, যা পরবর্তীতে অ্যাপলকে মার্কেট শেয়ার আরও বাড়ানোর কোন সুযোগ তৈরিতে বাধাই সৃস্টি করবে।আইফোনের যে অনন্য বৈশিস্ট্য মাল্টিটাচস্ক্রীন তা আজ হোক, কাল হোক অথবা পরশু হোক অন্য কোম্পানির স্মার্টফোনে আসবে এবং আসাটাই স্বাভাবিক। তাই অ্যাপলকে একটু কোয়ালিটির দিকে কোম্প্রোমাইজ করে হলেও মনে হয় তৃতীয় বিশ্বের দিকে নজর দেওয়া উচিত। তবে অ্যাপল মনে হয় সবসময় চায় তার তৈরি প্রোডাক্ট একটু অন্যশ্রেণীর কাছেই থাকুক।আমরা গরীবরা হয়ত দূর থেকে দেখেই বিস্মিত হব অ্যাপলের উদ্ভাবনে।
গুগল কতৃক প্রজননকৃত অ্যানরয়েডঃ এখানে একটা টার্ম ব্যবহার করেছি প্রজননকৃত, অধিকৃত/মালিকানা না। গুগল অ্যানরয়েড ডেভেলাপ করলেও, এমনকি সফটওয়্যার টুলের উপর গুগলের কন্ট্রোল, তার উপরে লেটেস্ট ভার্সন অ্যানরয়েড 1.5 গুগল কতৃক রিলিজ করা হয়েছে, তার পরেও অ্যানরয়েডের রয়েছে সিম্বিয়ান অর্গানাইজেশনের মত ওপেন হ্যান্ডসেট এলিয়েন্স(OHA) সমথির্ত গ্রুপ। সিম্বিয়ান অর্গানাইজেশনের জীয়নকাঠি যেমন নকিয়ার হাতে এই অর্গানাইজেশনের গুরুভার তেমন গুগলের কাধে। একটা মজার ব্যাপার হল - কিছু কিছু কোম্পানি সিম্বিয়ান এবং OHA দুইটিরই মেম্বার যেমনঃ সনি-এরিকসন,স্যামসাংগ,ভোডাফোন।
আইফোনের যেমন জন্মকথায় জড়িয়ে আছে দখলদারিত্বের কথা অ্যানরয়েডের পূর্বকথায় সেই অধিগ্রহণ। গুগল ২০০৫ সালে অ্যানরয়েড নামেই এক কোম্পানি কিনে নেয়। তারপর এই সদ্য দখলকৃত কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনেকেই গুগলে চলে আসে। সেইসব শীর্ষ কর্মকর্তাদের একজন হল এন্ডি রুবিন।গুগলের দখলদারিত্বের পরে রুবিনের উপরে দায়িত্ব পরে গুগলের মোবাইল অপারেটিং সিস্টেম টিমকে লিড দেওয়ার। মজার ব্যাপার হল অ্যানরয়েড টিমের এই টিম লিডার এন্ড্রি রুবিনের কর্মজীবন শুরু হয়েছিল অ্যাপলের মাধ্যমে। অ্যাপলের আইফোন রিলিজ হওয়ার পর থেকেই মার্কেটে হুলস্থুল গুজব চলতে থাকে, অ্যাপলের পর আরেক কম্পিউটার ইন্ডাস্ট্রির জায়ান্ট গুগল মোবাইল মার্কেটে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে। সেই গুজবের ডালা-পালায় কেউ কেউ হবু গুগলের ফোনের নাম ও দিয়ে দেয় G-Phone.(G-mail থেকে G-Phone কিনা জানি না)।
ছবিঃ এন্ডি রুবিন এবং পাশের স্ক্রীনের মধ্য তার প্রোডাক্ট অ্যানরয়েড ইন্টারফেস
ছবিঃ গুজবে উঠে আসা G-Phone
অতঃপর সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে নিজস্ব ব্রান্ডের কোন ফোন রিলিজ না করেই গুগল ওপেন হ্যান্ডসেট এলিয়েন্স(OHA) নামক এক অর্গানাইজেশনের জন্ম দেয়। সেই অর্গানাইজেশনে মোবাইল ইন্ড্রাস্টির চিপ মেকার থেকে শুরু করে অপারেটররা পর্যন্ত সদস্য হয়। নতুন গঠিত অর্গানাইজেশনের ফ্ল্যাগশিপ হয় অ্যানরয়েড যার অধিকাংশ কোড EPL লাইসেন্সের মাধ্যমে ফ্রি হিসেবে গণ্য। পরবর্তীতে এই অর্গানাইজেশনের ছায়ায় HTC হার্ডওয়্যারে নির্মিত হয় G1/HTC DREAM।
ছবিঃ HTC DREAM
ছবিঃগুগল হেডকোয়ার্টারে অ্যানরয়েডের লোগো।
অ্যানরয়েড অপারেটিং সিস্টেম লিনাক্সের উপর নির্ভর করে তৈরি করা হলেও গ্রাফিকাল ইন্টারফেস লিনাক্সের X উইন্ডোজের মত না অথাৎ আমরা লিনাক্সপ্রেমিরা যে রকম GNOME অথবা KDE গ্রাফিকাল ইন্টারফেসে পেয়ে থাকি অ্যানরয়েডে সেরকম পাচ্ছি না। অ্যানরয়েডে প্রোগ্রাম লেখার জন্য গুগল সফটওয়্যার ডেভেলাপমেন্ট কিট রিলিজ করেছে যেখানে প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ হল জাভার মত কিন্তু জাভার ফুল লাইব্রেরি ব্যবহার করা হয় না বরং
অ্যানরয়েড উপযোগি লাইব্রেরি প্রদান করেছে গুগল। কিছু হালকা-পাতলা সমালোচনা আছে এই অ্যানরয়েডের বিপক্ষে। তারপরেও অনেক ম্যানুফাকচারের কাছে হাই ইন্ড ফোনের জন্য অ্যানরয়েড ওয়েলকাম। এইসব ম্যানুফাকচার কোম্পানি(সনি-এরিকসন, স্যামসাংগ,এলজি,HTC) পূর্বে উইন্ডোজ ব্যবহার করত হাইইন্ড ফোনে তারা একটু একটু করে অ্যানরয়েডের দিকে পা দিচ্ছে।
২০০৮ এর সেপ্টম্বরে প্রথম মার্কেটে আসে অ্যানরয়েড সমৃদ্ধ ফোন HTC DREAM। এই একবছরে মার্কেটে এসেছে অথবা আসতে যাচ্ছে এগারটি ফোন। এরমধ্য সর্বশেষ মটোরোলা কতৃক রিলিজকৃত ক্লিক/ডেক্সট MB220 মটোরোলাকে একটু স্বপ্ন দেখাচ্ছে কিছু মার্কেট শেয়ার বৃদ্ধির। মটোরোলা এই সেটে অ্যানরয়েডের উপর যোগ করেছে মটোব্লর নামক একটা সফটওয়্যার লেয়ার যা মূলত সোশ্যাল নেটওয়ার্ককে একসুতায় গাথার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, অথাৎ এই ফোনের ব্যবহারকারিকে আলাদাভাবে ফেসবুক,মাইস্পেস অথবা টুইটারের মত সাইটে লগইন করতে হবে না।
ছবিঃ মটোরোলা ক্লিক/ডেক্সট MB220
মার্কেটে গুজব আছে সনি-এরিকসনের নেক্সট Xperia X3 আসবে অ্যানরয়েড বেসড,X3 তে সনি-এরিকসন ব্যবহার করবে আপকামিং অ্যানরয়েড-২। কারণ এই পরবর্তী অ্যানরয়েড ভার্সনে মাল্টিমিডিয়া সুবিধা ভাল থাকবে এবং সেই সাথে সনি-এরিকসন উইন্ডোজকে(Xperia আগের দুই ভার্সনের অপারেটিং সিস্টেম)ডিভোর্স দেওয়ার সব সরঞ্জাম মজুদ করছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ১২:৪১