আমরা চাই সবাইকে নিজের মতো করে দেখতে। সবাই যেন আমারই প্রতিচ্ছবি হবে। আমার কথা শুনবে। যা বলবো তাই করবে। যেভাবে দেখাবো সেভাবেই দেখবে। যেভাবে চালাবো সেভাবেই চলবে। এটা আমাদের মনের অভ্যন্তরীণ স্বৈরতান্ত্রিকতার প্রকাশ।
যেমন- কিছু স্বামী স্ত্রীকে খোঁটা দেয়-'তোমার রান্না আমার মায়ের মতো না!!"
-- আরে ভাই, মা কে মায়ের জায়গায় রাখেন। স্ত্রীকে তার জায়গা দিন। স্রষ্টা তো দুজনকে আলাদা মানুষ বানিয়েছেন, একই রান্না আশা করেন কেন? মায়ের রান্না উৎকর্ষ লাভ করতে অবশ্যই একটি সুনির্দিষ্ট সময় লেগেছে। স্ত্রীকেও সে সময়টুকু দিতে হবে। বরং আপনার স্বীকৃতি ও উৎসাহ স্ত্রীর রান্নাকে ভিন্ন মাত্রার স্বাদের অধিকারী করবে।
আবার কিছু স্ত্রী স্বামীকে তুলনা করতে থাকেন তার বাবা কিংবা ভাইয়ের সাথে। বাবার আদর আর ভাইয়ের মমতা কি স্বামীর কাছ থেকে আশা করা উচিত? আসলে প্রত্যেকটা সম্পর্কের নিজস্ব কিছু স্বতন্ত্রতা আছে। একটি সম্পর্কের সাথে অন্য সম্পর্ককে জড়িয়ে ফেলা ঠিক নয়। ভাইয়ের কাছে যে দাবি করা যায়, সেটা স্বামীর কাছে একই ভাবে করা যায় না। আবার স্বামীর কাছে যে দাবি করা যায়, সেটা কোনভাবেই ভাইয়ের কাছে করা যায় না। বাবার আর্থিক সমৃদ্ধি আর সামাজিক মর্যাদা একদিনে তৈরী হয়নি। স্বামীর ক্ষেত্রেও একই রকম। তিনিও একটা সময় সে মানের আর্থিক সমৃদ্ধি ও সামাজিক মর্যাদা লাভ করবেন।
# বিয়ের পর ছেলের পরিবার ভাবতে থাকে মেয়েটাকে নিজেদের করে নেয়া গেলো কিনা? আবার মেয়ের পরিবার ভাবতে থাকে ছেলেটা আমাদের হাতে এলো কিনা? এ নিয়ে চলে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ। সব কাজেই পারস্পরিক প্রভাব বিস্তার আর জিততে চাওয়ার নেতিবাচক প্রতিযোগিতা হতে থাকে। ভিন্ন পরিবারের, ভিন্ন সংস্কৃতির একটা ছেলে/ মেয়ে আপনার ছেলে/মেয়ের মত হয়ে যাবে এটা ভাবা কি অযৌক্তিক নয়? বরং পরস্পরের মধ্যকার সাদৃশ্য বা মনোগত মিলগুলোকে স্বীকৃতি দিয়ে লালন করলেই তো সম্পর্ক মজবুত করা সম্ভব।
# বাবা-মা ছেলে মেয়ের নাম রাখেন নিজেদের নামের সাথে মিল রেখে। কারণ? ছেলেটা/ মেয়েটা আমার মত হবে। রিক্সা ড্রাইভার চায় তার ছেলে হোক ট্রাক ড্রাইভার। মুদি ব্যবসায়ী চান সন্তান হবে বড় আড়তদার বা সুপার শপের মালিক। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার চান সন্তান হবে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার। এমবিবিএস ডাক্তার চান সন্তান হবে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। এডভোকেট চান সন্তানকে বার এট ল পড়াতে। আসলে পৃথিবীর বিখ্যাত ব্যক্তিদের প্রায় শতভাগ বাবা কিংবা মায়ের মত হন নি। হয়েছেন তার নিজের মতো। বাবা মায়ের পেশাগত পরিচয়, সামাজিক পরিচয় এমনকি ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে গিয়ে তারা নিজেদের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। কারণ প্রত্যেক মানুষকে স্রষ্টা নিজস্ব গুণাবলী এবং স্বত্তা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। যারা নিজেদের স্বতন্ত্র গুণাবলীকে আবিস্কার করতে পারেন তারাই অমর হন। মৌলিক মূল্যবোধের জায়গাগুলোকে অক্ষুন্ন রেখে অন্য বিষয়ে সন্তানকে নিজস্ব পছন্দ ঠিক করার সুযোগ দান করা উচিত।
# মুসলমানরা চান সবাই মুসলমান হয়ে যাক, হিন্দুরা চান সবাই হিন্দু হয়ে যাক। একই রকম অন্য ধর্মের লোকেরাও। কিন্তু স্বয়ং স্রষ্টা বলে দিয়েছেন ' আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য আলাদা বিধান ও স্পষ্ট পথনির্দেশ প্রদান করেছি। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তোমাদের এক উম্মাহ বা জাতিতে পরিণত করতে পারতেন। (কিন্তু তিনি তা করেন নি)। কারণ তিনি তোমাদের যে পথনির্দেশ ও বিধান দিয়েছেন তার আলোকেই তোমাদের পরীক্ষা করতে চান। -সুরা মায়েদা-৪৮
# রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রমও একই রকমের। সবাইকে নিজের দলের কর্মী বানানোর জোর জবরদস্তিমূলক প্রচেষ্টা। বিরোধিতাই যদি না থাকলো তাহলে সংশোধন ও সংস্কারের পথ যে বন্ধ হয়ে যাবে, এটা তারা ভাবেন কি?
# মতবাদগুলোর কথা ভাবুন। নারীবাদীদের ইচ্ছে হলো- সবাই নারীবাদী চিন্তা চেতনা পোষণ করুক। আবার পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার লোকজন চায় সব নারীবাদীরা উচ্ছন্নে যাক। পুঁজিবাদীরা চায় সমাজতন্ত্রের বিনাশ। সমাজতন্ত্র চায় পুঁজিবাদের ধ্বংস। সমন্বয় করতে চাওয়ার লোক খুবই কম।
অর্থাৎ সব ক্ষেত্রেই মতের পার্থক্য থাকবে। চিন্তা -চেতনা, আদর্শের পার্থক্য থাকবে। রুচি, সংস্কৃতি, পছন্দ- অপছন্দের পার্থক্য থাকবে। কিন্তু ভিন্নতাকে বৈচিত্র্য হিসেবেই গ্রহণ করা উচিত। এত পার্থক্য আছে বলেই এত রঙের সৃষ্টি, এত স্বাদের সৃষ্টি, এত গন্ধের সৃষ্টি। সবগুলো মিলেই সুন্দর পৃথিবী। কালো না থাকলে সাদার গুরুত্ব থাকতো না। আবার করলার স্বাদ তেতো না হলে রসগোল্লার মিষ্টি স্বাদকে আমাদের কাছে সুস্বাদু লাগতো না।
ভলতেয়ার বলেছিলেন- তোমার সাথে আমার মতের পার্থক্য থাকতেই পারে। কিন্তু তোমার মত প্রকাশের সুযোগ করে দেয়ার জন্য আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত। কোন মত/চিন্তা যদি সার্বিকভাবে অকল্যাণ, নির্যাতন বা ষড়যন্ত্রমূলক না হয় তবে তাকে স্বাগত জানানো উচিত। একই সাথে কারোরই উচিত নয় জোর করে নিজের মত অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়া। ভিন্ন আকৃতি ও কাজের পাঁচটি আঙুল নিয়েই সুন্দর একটি হাত তৈরী। সুতরাং পারস্পরিক বৈষম্যকে ফোকাস না করে সাদৃশ্যকে ফোকাস করতে পারলে আমরা শান্তির পথে এগোতে পারবো।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:৩৩