ঘটনার সময়কাল ২০০৪। আমি এস.এস.সি পাস করলাম। কিছুটা কৃতিত্বের সাথেই করলাম। জিপিএ ফাইভ পেলাম। বাবা তো মহা খুশি। আমাদের মত একটা দরিদ্র দেশের বাবা-মায়েদের সব চিন্তা-ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে তাদের সন্তানেরা। সেই সন্তানদের নিয়ে বাবা মায়ের অনেক অনেক স্বপ্ন থাকে। সন্তানদের ধাপে ধাপে দরিদ্র বাবা-মায়ের সেই স্বপ্নগুলো পূরণ করতে হয়। সন্তানরা এস.এস. সি নামক পাব্লিক পরীক্ষা কৃতিত্বের সাথে শেষ করতে পেরেছে মানেই বাবা মায়ের প্রাথমিক স্বপ্নও পূরণ করেছে।
আমার বাবাও তার প্রাথমিক স্বপ্ন-পূরণের আনন্দে আনন্দিত। বেজায় ডগমগ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। অত্যন্ত আবেগাপ্লুত অবস্থা। এর কাছে ফোন করেন, তার কাছে ফোন করেন। কন্যার জন্য সবার কাছে সর্বক্ষণ বেজায় দোয়া প্রার্থণা চলছে! একদিন বাবা আবেগে আপ্লুত হয়ে আমাকে ডেকে বললেন, “বেটি তুই তো আমাকে খুশি করে দিলি! বল তোর কি চাই?”
খুবই আনন্দের লক্ষণ। পিতা কন্যাকে খুশি হয়ে নিজ থেকে উপহার কিনে দিতে চাইছেন। কন্যা কী চাইতে পারে? কী চাওয়ার আছে তার?
পাঠক যে সময়ের কথা বলছি আপনারা জানেন সেই সমটা ছিল ডিজুস-পোলাপানদের দখলে। দখল মাত্র শুরু হয় হয় করছে। মানে ডানা মেলেছে টাইপস অবস্থা। উড়তে এখনো কিছুমাত্র বাকি আছে। ডিজুস পোলাপানরা সময়ের দাবিতে আস্তে আস্তে একটু একটু করে মুঠোফোনে আসক্ত হচ্ছে। বাবা মায়েরাও টেকনোলজির এই অনবদ্য বস্তুটিকে নিরাপত্তার খাতিরে হোক আর আভিজাত্যের বিভায়ই হোক, যেভাবেই হোক না কেন, স্বেচ্ছায় সন্তানদের হাতে তুলে দিতে শুরু করেছেন। আমার বন্ধু-মহলে তখনো কারো কোন মুঠোফোন নেই। তবে বাবা-খালা-মামার থাকায় এ বস্তু যে কি জিনিস তা নিয়ে খুব আগ্রহ কাজ করত। কল রেট ৭ টাকা। এত টাকা দিয়ে কে আমাকে কল করবে? তেমন মানুষ তো নেই! তাছাড়া টি-এন-টি তো আছেই। তাহলে? তাহলে আর কি? সময় হয়ে এসেছে। আস্তে আস্তে সবাই কিনবে। সবার মোবাইল থাকবে, আমার থাকবে না? গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানোর মত ব্যপার-স্যাপার। অতএব, কন্যার একটি মুঠোফোন চাই।
যথারীতি আমি বাবাকে বললাম “বাবা, আমার মোবাইল চাই।”
যেই কথা সেই কাজ। বাবা পারিবারিক সংসদে বিল পাশ করলেন। দেয়া হবে! কন্যাকে কন্যার চাহিদা মত মোবাইলই কিনে দেয়া হবে।
সেই দিনটি ছিল বেশ দূর্যোগপূর্ণ। বাইরে ইলশে গুড়ি ঝরছে। পানিবন্দি অবস্থা। কিন্তু কন্যার তো আর তর সইছে না। কি আর করা! আমার পিতা সেই ইলশে গুড়ি মাথায় নিয়েই তার দুই বেটা-বেটিকে নিয়ে চললেন মুঠোফোন কিনতে। গন্তব্য স্টেডিয়াম মার্কেট। সময় নিয়ে এই দোকান সেই দোকান ঘুরে দেখি। দেখা আর শেষ হয় না। কারন আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল(এখনো আছে) আমার সাধ আর সাধ্যকে নিয়ে। এই দুই বান্দা এত পাপী যে কস্মিনকালেও এরা সমান্তরালে চলে নি। সাধারণ মানের কোন সেটই আমার পছন্দ হয় না। মাল্টিমিডিয়া সেটের অনেক দাম। পিতা কন্যাকে এইটা দেখায়, সেইটা দেখায়, এই দোকানে হাটে, ওই দোকানে হাটে। তাদের এই হাটা হাটির দমকে স্টেডিয়াম মার্কেটের সব দোকানদার তাদের তিনজনকে মোটামুটি চিনে ফেলেছে। কিন্তু কন্যার তো কিছুই পছন্দ হয় না। কন্যার ভাই আরো দুষ্ট। সে কন্যাকে মাল্টিমিডিয়া সেটের ফাংশানের কি বিত্তান্ত তা সবিশেষ বর্ণনা করে করে কন্যার মাথা যা খারাপ ছিল তা আরো কয়েক ডিগ্রি বাড়িয়ে দিয়েছে। দরিদ্র পিতার সামর্থের কথা বিবেচনা না করেই কন্যা স্যামসাং কোম্পানির একটা মাল্টি মিডিয়া সেট পছন্দ করে বসে। প্রথমে বেজায় রুষ্ট পরে আনন্দিত হয়েই পিতা নগদ দশ হাজার টাকা খরচ করে কন্যাকে সেই মোবাইল সেটটি কিনে দিলেন।
দশ হাজার টাকা!! পাঠক একটু বলি, আমি মধ্যবিত্ত নই ঠিক, নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। আমাদের ওই সময়ের তিন রুমের একটি ফ্ল্যাট বাসার ভাড়া ছিল সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। দশ হাজার টাকা আমাদের জন্য অনেক অনেক টাকা। বলতে পারেন আমার দরিদ্র পিতা শুধুমাত্র প্রচন্ড আবেগের কারনে এতগুলো টাকা খরচ করে কন্যাকে খুশি করার চেষ্টা করেছেন। শুধুমাত্র বাবা-মায়েরাই পারেন পুত্র-কন্যাকে সাধ্যের অতিরিক্ত কিছু করে এত নির্মল আনন্দ দিতে। অতএব বুঝতেই পারছেন ওই মোবাইল সেটটি আমার জন্য অনেক বেশি কিছু ছিল। অনেক বেশি কিছু।
আমার আলোচ্য গল্প এই মোবাইল সেটটি কে ঘিরে!

বাণিজ্য বিভাগের জন্য সবচেয়ে ভালো কোন কলেজ? আমি বলব সিটি কলেজ। কারন আমাদের সময়ে হাফিজ স্যার ছিলেন। যে যাই বলেন না কেন ভাই বিচার আমি মানি। তবে দুঃখিত, তাল গাছটা আমার! আমার তাল গাছের নাম “ঢাকা সিটি কলেজ”। ইস্ট অর ওয়েস্ট, সিটি কলেজ ইজ দি বেস্ট। অনেক কিছু দিয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি। অনেক বেশি কিছু শিখেছি এই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। তাই সিটি কলেজ আমার কাছে একটা প্রতিষ্ঠানের চেয়েও অনেক বেশি কিছু।
তো এস.এস.সির পর স্বপ্নালু চোখে সিটি কলেজে ভর্তি হলাম। আরামবাগ থেকে বাসে উঠি। নামি কলেজের সামনে। কলেজে নিয়মিত ক্লাস করি। আবার কলেজের সামনে থেকে বাসে উঠি। নামি আরামবাগ। মাঝে মাঝে এ নিয়মে অবশ্য ব্যত্যয় ঘটে। শুনেছিলাম সংগ দোষে নাকি লোহা ভাসে? জায়গায় গিয়ে দেখি, লোহা তো ভাসে ভাসে, সাথে পাথরও ভাসে। আমার দশাও কিছুকাল হয়েছিল সেই রকম। কলেজে আমার সঙ্গে পরিচয় হয় খুব দুষ্টু শ্রেনীর বন্ধুদের। পাঠক এই দুষ্ট মানে কিন্তু খারাপ না। হাতে পায়ে আর কুট-বুদ্ধিতে দুষ্ট। সেই সাথে তারুণ্যের প্রাণ-শক্তিতে ভরপুর। এদের সাথে মাঝে মাঝে কম্পিউটার-স্ট্যাট ক্লাস ফাঁকি দেই। ঘুরে বেড়াই রাইফেলস স্কয়ার, আনাম র্যাং্স, হাট বাজার, কনকর্ড আর্কেডিয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।
যেদিনের কথা বলছি সেদিনো এরকম কিছুই হয়েছিল। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে গিয়েছিলাম হাট-বাজারে। হাট-বাজারের ওপর একটা পার্লার ছিল। মনে হয় ফেমিনা। নাম ভুলে গেছি। বাসায় ফিরতে হলে আবার কলেজের সামনে থেকে অথবা সিটি কলেজের বাম পাশে কলা বাগানের দিকে যাবার বাস স্ট্যান্ডের সামনে থেকে বাসে উঠতে হবে। কলা বাগানের দিকে যাবার বাস সার্ভিসগুলো ওখানে ঐ স্টপেজে এসে দাঁড়াতো। খুবই ঝামেলাপূর্ণ জায়গা। কোলাহল-হট্টগোল মানুষে মানুষে সয়লাব একটা জায়গা। আমি আর আমার বান্ধবি এখানে-ওখানে হাটাহাটি করি। করতে করতে এই চরম বাজে জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। ঠিক দাঁড়ালাম না। বাসের জন্য ছুটোছুটি করতে লাগলাম। বাস পাই না।
পাঠক আমি আবার তখন বোরখা পরি। বোরখা পরলেও আমরা তখন ডিজুস জেনারেশান(?!)। বলতে পারেন বোরখায়ও ডিজুস (অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলছি!)। ব্যাকপ্যাক টাইপ্স ব্যাগ নেই না। ডিজুস জেনারেশানের মাইয়াপাইনজরা(?!) কাঁধে আড়াআড়ি করে ব্যাগ নেয়। ব্যাগ আবার হাটার তালে তালে বাম পাশের কোমর ত্যাগ করে পেছনে হাঁটা ধরে। আমার ব্যাগেরো এই ধরণের অত্যন্ত দুঃখজনক অবস্থা। আমি আবার খুব সল্প-সতর্ক মানুষ ছিলাম। আমার এত সাধের মুঠোফোন টি আমি ব্যাগের সর্ব-উপরের পকেটে রেখেছি।
তো হঠাত কি হল, আমি লক্ষ করলাম, আমি এবং আমার বান্ধবি একটা গোলকধাঁধাঁময় ভীড়ের মধ্যে পড়ে গেছি। আমরা বেরুনোর চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না। এর মধ্যেই আমি অনুভব করলাম চারপাশে কি যেন একটা পরিবর্তন হল। সেটা ঠিক কি তা ধরতে পারলাম না। আমার প্রায়ই এই দশা হয়। আমি বুঝতে পারি আমার চারপাশে কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে। তবে পরিবর্তন টা কি সেটা বুঝে উঠতে পারিনা। এ বিষয়ে একটা ছোট গল্প বলার লোভ সামলাতে পারছিনা। গত বছরের কথা। আমি ইন্টার্ণশিপ করছি। মোটামুটি রাস্তায় রাস্তায় থাকি। রাস্তায় রাস্তায় থাকি বলেই হ্যান্ডব্যাগে করে যতসব তল্পি-তল্পা নিয়ে হাটাহাটি করি। এক সন্ধ্যায় হাই কোর্টের সামনে দিয়ে রিকশায় করে আসছি। রিকশায় বসে আছি। দেখলাম আশেপাশে কিছু একটা পরিবর্তন হল। চারপাশ একেবারে ধোঁয়াশা! কি পরিবর্তন হল? পরিবর্তন এই যে আমার কোলে রাখা একমাত্র সম্বল ব্যাগটা সি.এন.জি থেকে মাথা বের করে টান দিয়ে নিয়ে গেল। এই পরিবর্তন টের পেতে আমার বেশ কিছু সময় লেগে গিয়েছিল। মূল ঘটনা বুঝতে আমি অনেকক্ষণ তাকিয়েই ছিলাম। পরে আমার মুখ দিয়ে শব্দ বের হল এবং কিছুক্ষণ পর পর শব্দ বের হতে থাকল, আমার ব্যাগ??? আমার মোবাইল? আমার টাকা? ইন্টার্নির কাগজপত্র? এই হল আমার অবস্থা।
তো যেখানে ছিলাম। সেই আগের জায়গায় ফিরে যাই। হ্যাঁ, আমি এবং বান্ধবি দাঁড়িয়ে আছি কিছু একটা পরিবর্তন টের পাবার আশায়। হঠাত পিছনে ফিরে দেখি আমার ব্যাগের উপরের পকেট টা চাঁদের মত একফালি করে কাটা আর এই কর্ম সমাধান করে আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে কালো লম্বামত একটা ছেলে। বয়স সতেরো কি আঠারো। ঘোর কৃষ্ণকায় গায়ের রঙ, যার এক হাতে আমার সাধের সেট খানা, আর অন্য হাতে একটা ব্লেড! ব্লেড দেখে যতটুকু না ভয় পেলাম তার চেয়ে বেশি অবাক হলাম, কান্ড টা কি করেছে সে? আমার ব্যাগ কেটে ফেলেছে? এই ব্যাগ আমার বড় আপুর (ফুফাতো বোন) উপহার হিসেবে দেয়া। নিজের হাতে ডিজাইন করা এক্সপোর্ট কোয়ালিটির ব্যাগ যেটা আমি ভালো ফলাফলের জন্য উপহার পেয়েছি, সেই ব্যাগ?। সেই ব্যাগ সে কেটে ফেলেছে? আবার আমার মোবাইল হাতে নিয়ে আমারি সামনে দাঁড়িয়ে আছে?
মুহূর্তের মধ্যেই আমার ভেতরে কি যেন একটা ভর করল। আমি সেই ব্লেডধারিকে ভয় পাবার বদলে প্রচন্ড-প্রচন্ড পরিমাণে রেগে গেলাম। কন্ঠে ও শরীরে এক অসুরিক শক্তি। আমি দ্বিধা-ভয় সব ভুলে কপ করে সেই ছেলের হাত ধরে বসলাম।
সেই সাথে তারস্বরে তীব্র চিৎকার,“ওই আমার ব্যাগ কাটছিস কেন? বল? সেট নিছিস কেন? সেট দে বলতেছি। সেট দে।”
এভাবে দে দে দে বলে আমি সমানে চিৎকার দিয়ে তার হাত ঝাঁকাচ্ছি! পাঠক এই পর্যায়ে বলি, আমি ছিলাম অতি শিষ্টাচারী এবং বিনয়ী মানুষ। “অপরিচিতজনকে আপনি বলাই শিষ্টাচার” এই কথাটি খুব ভালোভাবে জানতাম এবং মনে রাখতাম। অপরিচিত ছোট কারো সাথে পরিচয় হলেও আমি প্রথম ধাক্কায় তাকে আপনি বলে সম্বোধন করতাম। ছোটদের পর্যন্ত তুমি বলতাম না। সেখানে এই খাম্বামত ছেলেকে হাত চেপে ধরে আমি তুই-তুকারি করছি। কি ভয়াবহ! আমি নিজেই আমার সেই কন্ঠস্বর শুনে তাজ্জ্বব! একেবারে বস্তি-বেটিদের মত গলার স্বর ও আচরণ যেন মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা! কি ভয়ংকর! আর যেখানে আমি নিজেই আমার এই আচরণে-কন্ঠস্বরে তাজ্জ্বব বনে গেলাম সেখানে সেই বেচারার কথা কি আর বলব? সে কি কখনও ভাবতে পেরেছিল বোরখা পরা হ্যাংলা মত একটা মেয়ে তার হাত চেপে ধরে এই কান্ড করবে? গলা ফাটিয়ে তারস্বরে চিৎকার দিয়ে সিটি কলেজ মাথায় তুলবে? পুরো ঘটনার আকস্মিকতায় লোকজনও থ! কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছেলেটি যা বোঝার বুঝে ফেলেছে। সে তার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। আমার সেটটি সে হাত থেকে ফেলে দিয়েছে। আমি সেট নেবার আশায় তার হাত ছেড়ে দিতেই এক দৌড়ে সে পগাড় পার! আমিও ছোঁ মেরে আমার সেট নিয়ে সেখান থেকে কলেজের সামনের দিকে হাটা দিলাম। পেছন থেকে লোকজনের চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছিল। আমার বান্ধবি বলে যাচ্ছে তানি এইটা কি করলি তুই? আমার মাথা কিছুক্ষণের জন্য শুণ্য হয়ে গেল। তারপর আমি আবার আমার স্বাভাবিকতায় ফিরে এলাম। কয়েক মুহুর্ত আগে ঠিক কি হয়েছিল কেন হয়েছিল সে বিষয়ে ঐ মুহূর্তে আমার মাথায় আর কিছুই কাজ করছিল না। আমি আমার এত সাধের সেট ফিরে পেয়েছি, আজকের দিনের জন্য এই যথেষ্ট।