গল্পটা হয়তো বেশ পরিচিত। ধনী ব্যবসায়ী অমরনাথ মল্লিকের একমাত্র মেয়ের এনগেজমেন্ট। অনুষ্ঠানের কলরব শেষে সবাই যখন বিদায় নিল, তখন হাজির হলেন দাপুটে এক পুলিশ ইন্সপেক্টর। নাম তিনকড়ি হালদার। বাড়িতে আছেন মিসেস সুতপা মল্লিক, তাদের পুত্র অরিন মল্লিক, কন্যা রিনিতা মল্লিক এবং হবু মেয়ে জামাই রজত দত্ত। তিনকড়ি জানালেন, কোন এক বস্তিতে আজ রাতেই একটি মেয়ে আত্মহত্যা করেছেন এবং তার কাছে পাওয়া ডায়রীতে এদের সবার কথাই উল্লেখ আছে, তাই তিনি এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমেই প্রত্যেকের কাছে প্রত্যেকের অজানা অধ্যায়গুলো উন্মোচিত হলো। এই পরিবারের সবাই নানা ঘটনার মাধ্যমে মেয়েটিকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করেছে। তিনকড়ি বিদায় নেয়ার পর দেখা গেল রেখে যাওয়া ডায়রীতে কিছুই লেখা নেই এবং খোঁজ নিয়ে জানা গেল এই নামে কোন পুলিশ অফিসার নেই এবং কেউ আত্মহত্যাও করেনি। কিন্তু কে এই তিনকড়ি হালদার?
‘অ্যান ইন্সপেক্টর কলস’ নামের নাটকটি লিখেছিলেন ব্রিটিশ নাট্যকার জে বি প্রিস্টলি। সেই ১৯৪৫ সালে। অনেকগুলো গল্পকে এক সুত্রে বেধে দেয়া দুর্দান্ত ও টানটান উত্তেজনাময় কাহিনী। নাটকটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। নাটকের প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল ১৯৪৫ সালেই, রাশিয়ার মস্কো থিয়েটারে। এরপর ইউরোপ আমেরিকার নাট্যমঞ্চ, চলচ্চিত্রে, টেলিভিশনে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে হাজির হয়েছে এবং হচ্ছে ‘অ্যান ইন্সপেক্টর কলস’। আগ্রহীরা এই সাইটে [http://www.aninspectorcalls.com/] ঢু মারতে পারেন। এই সাইটে ২০১১ ও ২০১২ সালে নাটকটি কোথায় কোথায় মঞ্চায়িত হবে তার তালিকা পাওয়া যাবে।
প্রথম প্রদর্শনের ২০ বছর পর ১৯৬৫ সালে কোলকাতায় এই নাটক অবলম্বনে নির্মিত হলো চলচ্চিত্র ‘থানা থেকে আসছি’। ইতিমধ্যে অজিত গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিচালনায় এটি কোলকাতার থিয়েটারেও মঞ্চায়িত হয়ে গিয়েছে। ৪৫ বছর পরে ২০১০ সালে পরিচালক সারণ দত্ত সেই চলচ্চিত্রটি একই নামে পুনঃনির্মাণ করলেন। গত শতকের শেষ দশকের শেষ দিকে বিটিভি-তে এই নাটকটি ‘নিঃশব্দ ঘুণপোকা’ নামে প্রচারিত হয়েছিল। পরিচালনায় ছিলেন মাহবুবা বেগম হেনা।
দুটি প্রশ্ন সামনে রেখে চলচ্চিত্রটির আলোচনা করা যেতে পারে। এক. এই সময়ে এই চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রাসঙ্গিকতা কি? দুই. দুই চলচ্চিত্রের মূল চরিত্রকে তুলনা করা। অথবা এটা বে-ইনসাফ হতে পারে ভেবে, সারন দত্তকে দায় মুক্তি দিয়ে নতুন করে আলোচনা করা। সেই যাইহোক পুরানো চলচ্চিত্রকে নতুনভাবে নির্মাণের প্রবণতা দোষের নয়, নতুন কিছুও নয়। এই প্রবণতা হলিউড, বলিউড, বাংলাদেশ সবখানে আছে। হলিউডের মুভির বিশাল একটা অংশ, একই সাথে বলিউডেও শুরু হয়েছে¬ পুরানো চলচ্চিত্রকে নতুনভাবে নির্মাণ অথবা অনুপ্রাণিত নির্মাণ। এর প্রধান উদ্দেশ্য বাণিজ্য। সারণ দত্তের কম বাজেটী এই নির্মাণ ততটা বাণিজ্য সফল নয়।
ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ধারী এক যুবতী কাহিনীর কেন্দ্রে থাকলেও চলচ্চিত্রের মূল আকর্ষণ রহস্যের উদঘাটনকারী রহস্যময় পুলিশ ইন্সপেক্টর। ১৯৬৫ সালে হীরেন নাগের পরিচালনায় উত্তম কুমার সেই চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যিনি বাংলাভাষী দর্শকদের কাছে মহানায়ক, বাঙালী এখনো তার কাতাঁরে কাউকে ভাবতে পারে না। আর এইবারের ‘থানা থেকে আসছি’-তে সেই তিনকড়ি হালদারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন সব্যসাচী চক্রবর্তী। অনেকের মতে, এ যেন বিদ্রোহ। কিন্তু কেন এটা বিদ্রোহ? নাকি, উত্তম কুমারকে নিয়ে আমাদের মধ্যে ট্যাবু আছে।
আবার কাহিনীতে ফেরা যাক। না, শেষ পর্যন্ত দেখা যায় বস্তির সন্ধ্যা মন্ডল নামের সেই মেয়েটা আত্মহত্যা করেছে। একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর তদন্তে আসছেন। তাহলে সেই তিনকড়ি হালদার কে? এই প্রশ্নের উত্তরটি না দিলে কি চলছিল না, জানিয়ে দিতে হলো এই রহস্যময় পুলিশ ইন্সপেক্টর হলো আমাদের বিবেক। প্রশ্ন হলো, হঠাৎ কি হল যে, একই পরিবারের সবাই ভূত আক্রান্ত হবার মত বিবেক আক্রান্ত হল।
মোটাদাগে কিছু মেসেজ পেতে পারি এই চলচ্চিত্র থেকে। যেমন-টাকা পয়সা মানে খারাপ, বড়লোক মানে খারাপ। মানে যেরকম সরলকরণ হয় আর কি? পরস্পরের কুকর্ম নিয়ে পরিবারের সদস্যরা যখন বিতর্কে লিপ্ত তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে কুকুরে ঘেউ ঘেউ, বড্ড বেশি হয়ে গেল না। প্রাসঙ্গিক হতে পারে জটিল-কুটিল এই সময়ে বিবেকের মর্ম । শয্যা ও ধর্ষন দৃশ্য দুটি অন্যভাবে দেখানে যেতো। এই দৃশ্য দুটি চলচ্চিত্রের পরিচ্ছন্নতাকে নষ্ট করেছে।
আমরা সিনেমার সাধারণ দর্শকরা সিনেমা বলতে অভিনয় আর গল্পকে বুঝি। খুব সাদামাটা একটা গল্পকে টেনে নিতে পারে ভালো অভিনয়। যদিও এই চলচ্চিত্রের প্রাণ তার টানটান কাহিনী। প্রতিটি চরিত্রের মধ্যে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য অনেক অভিজ্ঞতাকে একই কেন্দ্রে টেনে এনেছে। রিনিতা চরিত্রে শ্রাবন্তী ব্যানার্জি ছাড়া বাকী সবার অভিনয় বেশ মানসম্মত। শ্রাবন্তীর অভিনয়ে মেকিভাব প্রচন্ড। অরিন চরিত্রে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় ভালো অভিনয় করলেও তার চেহারার কিশোর সুলভ ভাবকে যথেষ্ট কাজে লাগাতে পারেন নাই। তার ছোট্ট মুখে রাগের অভিনয় তাই বেমানান, মেকি। অভিনয় দক্ষতা কি সেটা রজত দত্ত চরিত্রে রুদ্রনীল ঘোষ দেখিয়েছেন। সংলাপের সাথে এক্সপ্রেশন পাল্টানোর কঠিনতম কাজটি অনায়াসে করেছেন তিনি। আর সব্যসাচী? তিনি তিনকড়ি হালদার চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলেছেন সাফল্যের সাথে, এ জন্য তিনি কতটুকু বাহবা পাবেন? আমি বেশী দেবো না,কারণ তার এ কাজটি করে দিয়েছে সন্দীপ রায় ফেলুদা চরিত্রের চরিত্রায়নের মাধ্যমে।উত্তম কুমারের যে ক্যারিয়ার, তাতে এটা অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল। সে তুলনায় সব্যসাচী তো প্রথম থেকে এই করে খাচ্ছেন।
বাহবা পেতে পাবেন পাওলি দাম, তবে মাধবী মুখার্জির ধারে কাছেও না। তার চেহারার অসহায়, সরল, গ্রাম্য ভাব আর নির্বাক অভিনয় দর্শকের বড় পাওনা। দর্শকদের মাঝে কৌতুহল ছুড়ে দিচ্ছিলেন, কখন এই মেয়েটা চলচ্চিত্রের মানুষ ও সমাজের দিকে নৈতিক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে। সে আমাদের কথা শুনিয়েই ক্ষান্ত। সে কারো দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকায় নাই। তার গন্তব্য আর চলচ্চিত্রের গন্তব্য যদি নতুন কোন সুরে বাধা যেত, তবেই আমরা চলচ্চিত্রটির সমসাময়িকতা নিয়ে বিশেষ কোন ভাবনার ফুসরত পেতাম।
চিত্রগ্রাহক শৌমিক হালদারকে ধন্যবাদ জানাতে হয় বস্তির ও তার আশে পাশের বৃষ্টিময় সন্ধ্যা দৃশ্যের জন্য। এই চলচ্চিত্রের দৃশ্য নির্মাণ বলতে এই একটি। আর বাকি সব গতানুগতিক ও আটপৌরে। চলচ্চিত্রের আবহ সংগীতে ইন্ত্রনীল দাশগুপ্ত ভালো করেছেন। ভালো লেগেছে জিৎ গাঙ্গুলীর গতানুগতিক সুরে শ্রেয়া ঘোষালের গানটি। চলচ্চিত্রটিতে কেমন যেন জড়তা ছিল। সারন দত্তকে পুরোপুরি প্রফেশনাল মনে হয় নাই। কোন কোন ক্ষেত্রে হাল ছেড়ে দেয়া ভাব। ইতিমধ্যে অনেকে বলছেন, সারণ দত্ত তার সাহসিকতার পুরস্কার পেয়েছেন, এটা একটা দুর্দান্ত সিনেমা। আসলে কি তাই? এর চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো সারন দত্তকে কেনই বা পুনঃনির্মাণ করতে হল। এই প্রশ্নের উত্তর সমগ্র চলচ্চিত্রের কোথাও নাই। হয়ত বা এই আশা করাটাই ভুল।
আরও কিছু পোস্ট:
সিটি লাইটস - এক সপ্তাহে সাতটি মুভির রিভিউ লেখার ইচ্ছে ছিল। প্রথম দিন চার্লি চ্যাপলিনের সিটি লাইটস । রোমান্স-কমেডি মুভি।
স্পেলবাউন্ড: হিচকক মুভি দু:সাহসিক রিভ্যু
সেপ্টেম্বর ডন এঞ্জেলিনা জোলির বাবার অভিনীত সিনেমা, ধর্ম আর প্রেমের সংঘাত।
হীরক রাজার দেশে - রিভিউ কবিতা: এইটা মোটেও আমার লেখা নয়, আনন্দবাজার না কোন এক পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল সিনেমা মুক্তির পর, তারই কপিপেস্ট। অসাধারণ রিভিউ ।
ইয়ে ... এই পেজখানায় লাইক দিলে আপডেটিত থাকবেন ইনশাল্লাহ