মানুষ তো কত কিছুই হারায়।কেহ বিত্ত, কেহ অর্থ, কেহ বিদ্যা, কেহ স্বাস্থ্য, কেহ বন্ধুত্ব, কেহ বা শারীরিক অংগ, কেহ ভালোবাসা আবার কেহবা চারিত্রিক গুণাবলী। সর্বদা আমরা হারাইয়া হারাইয়া যেমন বেদনার্থ হই, তেমনি প্রাপ্তির আখাংকায় পিষ্ট হই। তবে নীতিকথা যাই বলুক মানবসন্তান বোধহয় প্রিয়জন বিয়োগের বেদনায় সর্বাপেক্ষা বেশি পীড়িত হইয়া থাকে।মানব হৃদয়ের অংশজুড়ে বিরাজমান একটি অবয়ব যখন মহাকালের গর্ভে বিলীন হইয়া যায় তখন মনের গভীরে বেদনার বীণ বাজিয়া ওঠে। বিগত কিছু বর্ষকাল ধরিয়া প্রিয়জন হারানোর বেদনা বারংবার হৃদয়ে ক্ষত সৃষ্টি করিয়াছে।
আরম্ভ হইয়াছিল আমার বড় দিদিমণিকে দিয়া। এমন নয়যে এর আগে কোথাও কেহ মৃত্যুবরণ করেননি।কিন্তু স্বজন হারানোর বেদনার বোধোদয় হইবার পর প্রথম আঘাত পাই তাঁহাকে হারিয়ে।একদিন প্রত্যূষে জাগিয়া খবর পাইলাম আমার বড় দিদিমণি গত হইয়াছেন।অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ যেমন হঠাৎ শোকে আঘাত পাইয়া মাতম করিতে পারেন ,আমার কেমন জানি তা হইয়া উঠে না।আজকাল ভাবি ভগবান মনে হয় আমাকে এই গুণখানি প্রদান করিলে ভালোই করিতেন।বিগত স্বজন আর প্রিয় পরিচিত মানুষের স্মৃতিগুলো এভাবে আমায় নিয়ত কাতর করিতে পারিত না। আমার দিদিমণির নিকট তাহার নাতী নাতনী ছাড়া বহির্জগতের অন্যান সকলেই ছিল পাজির পাঝাড়া। মামার বাসায় যখন আসিতাম তখন দেখিতে পাইতাম উনি একটি চেয়ারে সারাটিদিন ধরিয়া বসিয়া থাকিতেন এবং বাইরের যে কেহই খেলিতে আসিতো না কেন,তাহাদের সকলেই ঘরের শান্তি বিনষ্ট করিতেছে বলিয়া বকুনি দিতেন।যবে থেকে কিছু বুঝিতে পারিবার জ্ঞান হইয়াছিল তবে থেকেই দেখিতাম উনি বৃদ্ধা, মৌন,একা। সকলের ভিতরে থাকিয়াও যেন তিনি নিজের সৃষ্ট নিজ জগতেই মত্ত থাকিতেন।প্রাতরাশ গ্রহণের পর একটি সোফাই ছিল উনার দিনযাপনের ক্ষেত্র।স্মৃত বিস্মৃত মন,বার্ধক্যের ভারে শ্রান্ত শরীর নিয়ে একটি কোনে গুটিসুটি করিয়া বসিয়া থাকিতেন,কখনো ঝিমুতেন,কখনো হাত ঠুকে ঠুকে সংগীতের বাদ্য বাজাইতেন। এখন ইচ্ছে হয় জানিতে,তাহার মনে কোন সংগীত গীত হইতো যে উনি এমনধারা তাল তুলিতেন!আমার মামারা প্রতিদিনকার কর্মে গমন করিবার পূর্বে উনার চরণস্পর্শ করিয়া তবেই প্রস্থান করিতেন।মাতার এক অন্যোন্য রূপ ছিলেন তিনি। যতই ঝাপসা আর ভুলে যাওয়া স্মৃতিপট থাকুকনা কেন। তিনি ঠিকই তাহার পুত্রদের চিনিয়া লইতে পারিতেন। মাতৃস্নেহের শক্তি হয়তো দৃষ্টিশক্তির চাইতে অধিকতর বলবান ছিল।দৃষ্টিশক্তিকে হয়তো বার্ধক্য খর্বিত করিয়াছিল,কিন্তু মাতৃস্নেহের নিকট তাহা পরাজিত হইয়া যায়। যখন আমার মা মামাবাড়ি যাইতেন,তিনি খুবই আনন্দিত হইতেন। আমার মায়ের কাছে কুশল জানিয়া লইতেন।আমরা বালকেরা কোন কৌতুকে যদি হাসিতাম তবে দেখিতাম তিনিও আমাদের দেখিয়া হাসিতেছেন। তখন না বুঝিলেও এখন সেই মুখখানি স্মরণ করিয়া বুঝিতে পারি যে সেই হাসি কৌতুকের ছিল না,ছিল আনন্দের আর স্নেহের। তাহার নাতী নাতনীরা আনন্দে আছে এই ভাবিয়াই স্নেহাদ্র হৃদয়ে পুলক সঞ্চারণ ঘটিত তাঁর। যখন আমি আর আমার মা চলিয়া আসিতাম তখন তিনি খুবই কষ্ট পাইতেন। অশ্রুবিসর্জন দিয়া আদ্র কন্ঠে বলিতেন,'আবার আইস্যো" বার্ধক্যের যতই কষ্ট হোকনা কেন লাঠিতে ভর দিয়ে শত বারন সত্ত্বেও আমাদের সিঁড়ি পর্যন্ত আগাইয়া দিতেন।আমার সেই দিদিমণি হঠাৎ করিয়া এইই বাস্তব স্পর্শের জগত হইতে কোথায় স্পর্শের বাহিরে চলিয়া গেল।আর আমি পৃথিবীর একস্থানে বসিয়া কিছু ঝাপসা স্মৃতি মানসপটে লইয়া বেদনার পাথর বহন করিয়া বেড়াই।আজো সেই ঘরটিতে মানুষটির শূন্যতা আমায় আহত করে,আমি সেই ঘরে থাকিতে পারিনা বেশিক্ষণ। এখনো সেই ঘর আছে,সেই খাট আছে, ঘরের পাশের বারান্দাটাও রয়েছে ঠিকঠাক। কিন্তু শুধু মানুষটি নেই।নেই তার লাঠি ভর দিয়ে খুট খুট শব্দ নিয়ে হাটা,নেই তার সেই অচেনা অজানা সংগীতের তাল বাজানো। মানুষটি আজ আর নেই।
এরপর অনেকখানি সময় কাটিয়া গেলো।কোন এক বিষাদগ্রস্ত সন্ধ্যা আমার নিকট বার্তা নিয়া আসিল যে আমার পিতামহ এই ধরাধাম ত্যাগ করিয়াছেন।দায়িত্বের চাপে নয়তো কোন এক কারনে আমি কাচের মত ভাঙিয়া পরি নাই সেইক্ষনে । রক্তের বন্ধন হোক আর পূর্বপুরুষের সম্পর্ক হোক তিনি আজ অবধি আমার হৃদয়ে বাচিয়া রইয়াছেন।পরীক্ষার ছুটিতে যখন নিজ গৃহে আসিতাম,সে এক মহানন্দের দিন ছিল।প্রবীণ ব্যক্তি সর্বদা আমার নিকট অভিজ্ঞতা আর প্রজ্ঞার নিদর্শন, তবে এমন মনোভাব আমি বালকবয়সে রাখিতাম না।তিনি সুযোগ পাইলেই আমার সম্মুখে তাহার অভিজ্ঞতার খাতা মেলিয়া ধরিতেন, তাহার দর্শন শাস্ত্র আমাকে ব্যাখ্যা করিতে চাইতেন। বালক আমি এই সকল দেখিয়া ভিরামি খাইয়া খেলার মাঠে পলায়ন করিতাম ।আজকাল সেইসব দিনগুলো বেশ প্রচন্ডভাবেই ফিরিয়া পাইতে ইচ্ছে করে ।আরো কত কি জানিবার ছিলো দাদুর নিকট হইতে । বাড়িতে থাকিলে দাদুর সাথে প্রাতঃভ্রমণে বাহির হইতাম ।লেপের তলায় ঠান্ডা হাত গুজিয়া দিয়া ঘুম ভাঙিইয়া দিয়া বলিতেন, ' উঠে পরো দাদুভাই ,উঠে পরো দাদুভাই কত বেলা হয়ে গেলো'।এমন আদর ফেলিয়া তিনি কোথায় যে হারাইয়া গেলেন তা আমি ভাবিয়া পাই না।বাড়ি হইতে আসিবার ক্ষণে প্রতিবার তিনি আমাকে জড়াইয়া কান্নাকাটি করিতেন , যেন তাহার শরীরের কোন একটি অঙ্গ পুরো শরীর ছাড়িয়া কোথায় জানি প্রস্থান করিতেছে ।আমি এতোসব বুঝিয়া পাইতাম না,কিন্তু এখন বুঝিতে পারি ।শুনিয়াছি ১৯৯১ এর প্রলয়ঙ্করী ঘুর্ণিঝড়ে জলোচ্ছ্বাসের সময় আমাকে কাঁধে লইয়া বুক সমান পানিতে দাড়াইয়া ছিলেন ।এতোখানি ঋনের বোঝা চাপাইয়া দিয়া হঠাৎ এমন নাই হইয়া যাওয়া সহজে মানিয়া লওয়া যায় না। তাহার মৃত্যুর দু-তিন দিন পূর্বে বাড়ি আসিবার কালে আমায় বুকে জড়াইয়া বিলাপ করিতেছিলেন এই বলিয়া যে তাহার সময় ফুরাইয়াছে আর দেখা হইবে না । কে জানিত এই কথাগুলোই প্রস্থর-কঠিন বাস্তব হইয়া আমায় আঘাত করিবে । যদি জানিতাম এই বিশ্ব সংসারে এটাই ছিল আমার সইত তাহার শেষ আলিঙ্গন । যখন খাটিয়া স্কন্ধে লইয়া শশ্মানযাত্রায় ছিলাম তখন পেছন হইতে শবযাত্রার কীর্ত্তনের সকরুণ সুর আজো আমার হৃদয় খামছে ধরে , শ্বাসনালী আবদ্ধ হইয়া যায় দলা পাকাইয়া উঠা কস্টে । সেই কীর্তনের সুর যেন গাথা হইয়াছিল হৃদয়ের সকল বিষাদ দ্বারা। আজো বাড়ি গেলে মনে হয় আমার আগমনী বার্তা শুনিয়া আমার অপেক্ষাতে সিঁড়িতে বসিয়া থাকিতে দেখিবো, চরণস্পর্শের পর আবার সেই আলিঙ্গন পাবো । হয়তো রাতে ঘুমানোর সময় দাদুর আকুল প্রার্থনার শব্দ কানে আসিবে ,” হরে মুরারে মধুকৈটভারে গোপাল গোবিন্দ মুকুন্দ সোরে .........” । এমনি আকুল আবেদন, মনে হইত যে আয়ুরেখা ধরিয়া উনি হাঁটিয়া আজিকার দিনে পৌঁছলেন , তাহার সমস্ত প্রিয়জনের শান্তি কামনায় এক অসীম আকুতি করিতেছেন ।
এই বৎসর ঈদের দিন ভোরবেলা চোখ মেলিয়াই যে বাক্যটি আমার শ্রবণে আসে তাহা হলো আমার আরেক দাদু [আমার ঠাকুরমার ভাই] ধরাধাম ত্যাগ করিয়াছেন । আমার ঠাকুরমা তার স্নেহের ছোটভাইকে হারাইয়া করুন ভাবে বিলাপ করিতেছিলেন । প্রিয় অনুজের মৃত্যু সংবাদ যারপরনাই দুঃখের বিষয় ।তাহার সুশ্রী মুখে এক প্রচন্ড ব্যাথাতুর অবয়ব ফুটিয়া উঠিয়াছিল তা এই কলমের আঁচড়ে আবদ্ধ করা যাইবে না । দিনশেষে ঠাকুরমা মৌন হইয়া এককোণে বসিয়া রইলেন আর চক্ষু মেলিয়া বাহিরের অন্ধকারের দিকে তাকাইয়া কি জানি মনে মনে ঠাহর করিতে চাহিতেছিলেন । হয়তো শৈশবে দিদির স্নেহের ছোট ভাইয়ের সাথে দুষ্টুমি , পিতার শাসন হইতে দিদির রক্ষা , রাখি – ভাই ফোঁটার মত ভাই বোনের উৎসব গুলোর মধুর স্মৃতি। যে ভাইকে লইয়া সে স্মৃতি, তার দেহ আজ ভষ্ম হইয়া পরিয়া আছে । স্বামী ,ভাই ,বোন হারানো কষ্টের ভার আজ চাপিয়া বসিয়াছে মনে । নিয়তি বড়ই শক্তিমান।
কিছুদিন পূর্বে আমি সেই দাদুর শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম । আমার পাশে বসিয়া আমার অনুজ সহোদর নানা রকম বিচিত্র ক্রীড়ায় মত্ত ছিল আর নানা প্রকার প্রশ্ন করিয়া বকবক করিতেছিল । তাহার শিশু মনে এই বোধটুকু ছিলনা যে একটি শোকাবহ আচারিক অনুষ্ঠানে কি প্রকার আচরণ করিতে হয় । আমি ভাবিতেছিলাম আমার দাদুর শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে আমার এই দাদু তদারকি করিয়াছিলেন , আজ তাহার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে আমি উপস্থিত । হয়তো একদিন আমি হারাইয়া যাইবো , আমার শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে অন্যকেহ তদারকি করিবেন ।
একদিন হারাইয়া যাইবে আমার ঘাসের ডগায় শিশির কণার স্পর্শ ,হারাইয়া যাইবে বিকেলের কন্যাসুন্দরী আলোয় শহুরে পথে আমার হেঁটে বেড়ানো ,হারাইয়া যাইবে ক্রীড়াঙ্গনে সখাদের সহিত কাটানো সময় ,হারাইয়া যাইবে শীতের সকালে এক পৌঢ় ও এক বালকের হাতের মুঠোয় হাত রেখে ভ্রমন করা ।কালের ঘোড়ায় চড়িয়া একটি সকাল আসিবে যখন সকল লেনদেন মিটাইয়া এই সংসারে আমার আনাগোনা বন্ধ হইবে । আমার বাটি হইতে আমার পায়ের শেষ ছাপটুকুও মিলিয়া যাইবে । আর আমি সকলের মত ভাসিয়া যাইবো একমুঠো ছাই হইয়া লাখো কোটি মানুষের স্মৃতি নিয়ে বয়ে চলা কোন নদীতে।তাহার কিছুকাল পরে হয়তো আবার কলম আঁচড় কাটিবে কোন শুভ্র কাগজের বুকে নদীর নাম হয়তো কর্ণফুলী হইতে পাল্টাইয়া হইয়া যাইবে গঙ্গা,ভাগিরতী,করতোয়া,নীল,মিসিসিপি,টেমস ,যমুনা,পদ্মা বা অন্য কিছু। ভাষা হইবে ভিন্ন , মানুষ হইবে ভিন্ন কিন্তু বেদনার কাতরতা হইবে একই। লিপিবদ্ধ হইবে অন্য এক শোকগাথা।
রাত বাড়িতেছে , হাজার বছরের পুরনো সেই রাত । হাজার বছর ধরিয়া আমায় বৃদ্ধ করিয়া চলিতেছে এই সংসার । আবার নতুন করিয়া কবে শুরু হইবে সব?
হরি দিনতো গেল সন্ধ্যা হল পার করো আমারে ।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুন, ২০২১ রাত ১২:১৭