ডিসেম্বরের/২০১৫ চার তারিখ গিয়েছিলাম নারায়ণগঞ্জ। আমি আর আমার কলিগ অফিসিয়াল ট্যুরে। সেদিন ছিল শুক্রবার। গুলিস্তান থেকে বিআরটিসি বাস যোগে নারায়নগঞ্জ চাষাড়া স্টেশনে নামি। আমরা আগে থেকেই প্লান করি। নারায়নগঞ্জে ঐতিহাসিক যা কিছু আছে এক নজরে কম সময়ের মধ্যেই দেখে ফেলব। তাই দেরী না করে অফিসিয়াল কাজ সেড়ে ফেলি বেলা বারোটার মধ্যেই। অফিসিয়াল কাজে যে জায়গায় গিয়েছিলাম সেখানকার মানুষজনের সাথে আলোচনা করে জায়গা ঠিক করি কোথায় কোথায় যাব । কারণ আমরা দুইজন মহিলা সেখানকার কিছুই জানিনা এবং আগে থেকে নেট ঘেটে দেখে যেতেও পারিনি।
তো সেদিন আমরা প্রথমে হাজীগঞ্জ দুর্গ দেখতে যাই তারপর শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে কদম রসূল দরগা ঘুরে আসি।
প্রথমেই আমরা ঠিক করলাম হাজিগঞ্জ কেল্লায় যাবো । তারাই আমাদেরকে রিক্সা ঠিক করে দেন এবং রিক্সাওয়ালাকে সব কিছু বুঝিয়ে দেন। তো আর কি!! দিলাম আল্লাহর নাম নিয়ে রওয়ানা। কেল্লা নামটা শুনেই মনে মনে ভাবছিলাম না জানি কত সুন্দর হবে দেখতে...... অদ্ভুত সুন্দর বিশাল কেল্লা। ভাবতে ভাবতেই দশ মিনিটের মধ্যে আমরা সেখানে পৌঁছে গেলাম সেখানে। যে রাস্তা ধরে যাবো সে রাস্তায় পা রাখতেই মনটা খারাপ হয়ে গেলো । আশ্চর্য্য কেল্লায় যাবো অথচ রাস্তাটা এত খারাপ। কিন্তু কেনো? দুইজনেই আলোচনা করছি আর আগাচ্ছি ক্যামেরা গলায় নিয়ে। অবশেষে গিয়ে পৌঁছলাম হাজীগঞ্জ কেল্লার সামনের ফটকে।গিয়েই বুকটা কেঁপে উঠল। কেল্লার প্রতি এমন অযত্ন আর অবহেলা দেখে। ছেঁড়া পলিথিন ছড়ানো ছিটানো চারিদিকে। ময়ল আবর্জনা রাস্তার বেহাল অবস্থা দেখে যারপর নাই মন খারাপ হয়ে গেলো। যাই হোক দুর্গের গেইট পর্যন্ত রিক্সাতেই গেলাম ঝাঁকুনি টাকুনি খেয়ে.......
১। দুর্গের গেইট
হাজীগঞ্জ দুর্গের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত হাজিগঞ্জ কেল্লাটি প্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো স্থাপত্য। এটি শীতলক্ষা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত । এর আরেকটি নাম খিজিরদুর্গ। সপ্তদশ শতাব্দীতে ঢাকা শহরকে রক্ষা করার জন্য তিনটি জলদুর্গকে নিয়ে ট্রায়াঙ্গল অব ওয়াটার ফোর্ট গড়ে তোলা হয়েছিল তারই একটি হলো এই হাজীগঞ্জ দুর্গ;
মুগল সুবাদার ইসলাম খান কর্তৃক ঢাকায় মুগল রাজধানী স্থাপনের পরে জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে দুর্গটি নির্মিত হয়। নদীপথে যাতায়াত করা শত্রুর উপর নজর রাখতে এবং এই পথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নদীর কোল ঘেঁষে স্থাপন করা হতো তাই এমন দুর্গকে নামে পরিচয় দেয়া হতো। এ স্থানগুলো মুঘল আমলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শিলালিপি না থাকায় এর প্রকৃত নির্মাণকাল অনুমান করা যায় না। তবে বেশীর ভাগ মানুষ মনে করেন এটি ১৬৫০ সালে নির্মিত হয়েছিল। আহম্মাদ হাসান দানি তার 'মুসলিম আর্কিটেকশ্চার ইন বেঙ্গল' গ্রন্থে বলেছেন, ইসলাম খান ১৬১০ সালে ঢাকায় রাজধানী স্থাপন করার পর এটি নির্মাণ করেন।
২্। মনমরা হয়ে ঢুকতেই একটা ক্লিক
বর্ণনা পড়তে গিয়ে কেমন জানি মনে শিহরণ লাগছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি হতে পারে যে এখানে না জানি কত প্রাণহানি হয়েছে এবং কত কত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে।
৩। সারি সারি দেয়ালের ফোকর....... অদ্ভুত সুন্দর লাগে আমার কাছে। কেমন জানি আভিজাত্যের ছুঁয়া.... কান্নার সুর অথবা রক্ত চুয়ে চুয়ে পড়ছিল কখনো দেয়াল বেয়ে বেয়ে ।
মুগল সেনাপতি নাথান তার বাহারিস্তান ই গায়বী (১৯৩৬) গ্রন্থে উল্লেখ করেন, সে তার বিশাল সৈন্য বাহিনী সহকারে হাজিগঞ্জে প্রধান ঘাটি স্থাপন করেন। নদী তীরবর্তী স্থানে সেনা ছাউনি স্থাপন করেন। ভুঁইয়াদের বিরুদ্ধে লড়াই তিনি এই এলাকাকে কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি ১৬১০ সালে মুগল রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করার পূর্বেই এই এলাকার সামরিক গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেন। তাই ধারনা করা হয় বাহারিস্তান-ই-গায়বী'র খিজিরপুরই বর্তমানের হাজিগঞ্জ,এবং এর স্থাপনাটি খিজিরপুরের অন্তর্ভুক্ত ছিল যা হয়ত পরবর্তীতে পুনঃ নির্মাণ করা হয়েছিল।
৪। দুপুরের শেষ ভাগে পড়ন্ত রোদে খেলাধূলায় মত্ত শিশু কিশোররা......
হাজীগঞ্জ দুর্গটি সম্পূর্ণ ইট দ্বারা নির্মিত আর প্লাস্টার করা হয়েছে তার উপর। সেখানে গিয়ে দেখলাম লাল লাল ইটগুলো খসে পড়ছে। অদ্ভুতভাবে কালের সাক্ষী হয়ে যেনো শুধু বেঁচে আছে ল্যাংড়া হয়ে। দুর্গটিতে বৃত্তাকার ছয়টি বুরুজ আছে। যার তিনটি বেশ বড় ও সমমাপের। বাকি তিনটি তুলনামূলক ছোট ও সমান । পাঁচ কোণাকারে নির্মিত এ দুর্গের বাহুগুলো এক মাপের নয় এবঙ পূর্ব পশ্চিমে লম্বা দুর্গটির আয়তন আনুমানিক ২৫০ বাই ২০০ ফুট। দুর্গের কোণগুলোতে কোণগুলোতে কামান বসানোর জন্য যে বুরুজ নির্মাণ করা হয়েছিল। দক্ষিণ - পূর্ব কোণের বুরুজের সামনে একটি সাত ধাপের পিরামিড কামান প্লাটফর্ম রয়েছে। সেখানে গেলেই সবাই দেখতে পারবেন।
৫। খসে পড়ছে প্লাস্টার আর রক্তিম ইটের সারি সারি.... গাঁথনি .. দেখে সভ্যতার দুয়ারে মন উঁকি দেয়।
দুর্গের দেয়ালগুলো বেশ উঁচু প্রায় ২০ ফুট এবং পুরু ।সমগ্র দুর্গ প্রাচীর এবং বুরুজ অসংখ্য বড় বদ্ধ পদ্মপাপড়ি নকশার দ্বারা সুশোভিত। দুর্গ প্রাচীর লাগোয়া একটি পায়ে হাটার উপযোগি প্রাচির রয়েছে ।
সে প্রাচীর ধরে আমরা পুরো দুর্গ ঘুরে বেড়িয়েছি। অন্য রকম ফিলিংস মনের মাঝে। এতটাই ভাল লাগছিল সেখানে গিয়ে আবার মুর্হুমুহু মনখারাপের দল এসেও মনে বাসা বাঁধছিল। কারণ দুর্গের র্দুদশা দেখে sad ।
৬। থোকা থোকা দেয়ালের ফোকর যেখান দেখে শত্রুদের উপর হামলা করা হতো..
কিছুটা উঁচু এই দুর্গের প্রবেশ তোরণের বাইরের দিকে প্রায় ১৮টি ধাপের সিঁড়ি রয়েছে। আবার তোরণ থেকে দুর্গ চত্বরের ভেতরে নামতে রয়েছে সিঁড়ির ৮টি ধাপ। দুর্গের পূর্ব-দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় দুটি বুরুজ জায়গা আছে। আরও একটি বুরুজ রয়েছে দক্ষিণ পাশে।
৭। সিঁড়িতে বসে আড্ডায়রত উঠতি তরুণরা..... (আমার ছবিতোলা দেখে ওরা অনেক হাসাহাসি করছিল তাই দিলাম ক্লিক)
তা ছাড়া উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম কোণায় ছোট দুটি বুরুজ অংশ আছে, যেখানে এক সাথে কয়েকজন বন্দুক বসিয়ে গুলি চালাতে পারত। দুর্গের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে রয়েছে চৌকো একটি ওয়াচ টাওয়ার আছে যা আমরা স্বচক্ষে দেখে আসলাম। এখন এটি ধ্বংসপ্রায় হলেও টাওয়ারে ঢোকার জন্য একসময় এতে ছিল ছোট্ট একটি পূর্বমুখী দরজা আর ভেতরে ঠিক মাঝখানে একটি মোটা গোল পিলার লাগোয়া ঘোরানো সিঁড়ি।
৮। ওয়াচ টাওয়ার......
শত্রুদের ওপর নজর রাখার জন্য এই ওয়াচ টাওয়ারটি ছাড়া দুর্গের ভেতর আর কোনো স্থাপনার অস্তিত্ব নেই। এবং সম্ভবত এখানে তেমন কোনো স্থাপনা কখনো ছিলও না। এর ফলে সৈন্যরা এখানে তাঁবু ফেলে অবস্থান করত বলেই ধারণা করেন ইতিহাসবিদরা।
৯্। ওয়াচ টাওয়ারের বাহিরের দিকটা.....
বর্তমানে দুর্গটি অত্যন্ত অবহেলায় পড়ে আছে। গরুছাগলের চারণ ভুমিরূপে কেল্লাটি ব্যবহৃত হচ্ছে। নানান বয়সের শিশু কিশোররা মেতে উঠে সেখানে খেলাধূলায়।
১০। কি সুন্দর সবুজ মাঠ খুব ইচ্ছে করে এখানে সারা বিকেলটা বসে থাকি আকাশের হাত ধরে......
সময়ের ব্যবধানে এক সময়ের যুদ্ধক্ষেত্র খিজিরপুর দুর্গটি এখন নিরব নিস্তব্ধ হয়ে যেনো অঝোরে কাঁদছে। খসে পড়চে ইট দুর্গের দেয়াল হতে। চুরি হয়ে যাচ্ছে হয়তো গেছে অনেক মূল্যবান স্থাপত্য। যে স্থাপত্য আমাদের ইতিহাসের পাতায় স্থান পেতো। দখল হয়ে গেছে দুর্গের আশেপাশের জমি। দুর্গের সামনে গড়ে উঠেছে অন্যান্য স্থাপনা।
১১। অন্যান্যা স্থাপনা দুর্গের বাহিরে...... ফটকের সামনে
যার ফলে হাজীগঞ্জ কেল্লার সৌন্দর্য ক্ষুন্ন হয়ে ম্লান হয়ে গেছে ইতিহাস। দিনের পর দিন বছরের পর বছর যাচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে এর কোন সংস্কারের কাজ করা হচ্ছে না। এভাবে যদি এমন স্থাপত্যগুলোকে আমরা গলা টিপে হত্যা করতে থাকি তবে একসময় এমন স্থাপনা বা দুর্গ ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে রূপকথার গল্প বলেই মনে হবে।
১২। প্রাচীর
আমি চাই হাজীগঞ্জ দুর্গটির সংস্কার হোক। সরকারের সুদৃষ্টি পড়ুক দুর্গটি ঘিরে।
১৩। প্রাচীর ঘেঁষে হেঁটে যাওয়ার রাস্তা........ হাঁটতে মজাই লাগছিল সেদিন।
আমাদের ফটো তোলা দেখে ওদের অনেক কৌতহল মনের ভিতর । আমি বললাম শুন বাচ্চারা ছবি তুলবে ওরা এক কথায় রাজী হয়ে যায়। কি সুন্দর স্নিগ্ধ হাসি হাসি মুখগুলো। আল্লাহ ওদের হাসি ধরে রাখুন ।
১৪। পড়ন্ত বিকেলের এক ঝাঁক তরুন
১৫। পড়ন্ত বিকেলের সোনালী রোদ্দুর মাঠটিকে হলুদ করে দিয়ে যায় যেনো,,,,,,,,
১৬। দুর্গের একাংশ
১৭। দুর্গের গেইট থেকে একটা ক্লিক...... তখন বিকেল ছিল
১৮। কিশোরের লাফ দেয়া হঠাৎ বন্দি হয়ে যায় ক্যামেরায়........
১৯। প্রাচির
২০। প্রাচির ঘেঁষে রাস্তা
২১। ভিতরের প্রাচির
২২। দুর্গের বাহিরের পরিবেশে একটা ক্লিক.......
২৩। সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত প্রাচীরগুলো......
২৪। দুর্গে ঢুকার গেইট......
২৫। দুর্গে বাহিরে প্রাচীর ঘেঁষে ক্রিকেট খেলায় রত বাচ্চারা......
২৬। দুর্গের বাহিরে দুই তরুণের আড্ডা.....বিকেলের পড়ন্ত রোদে
২৭। দুর্গের বাহিরে এভাবেই ময়লা আবর্জনা জায়গায় জায়গায় পড়ে আছে......। বের হয়ে আসলাম দুর্গ ছেড়ে.........
সেখান থেকে বের হয়ে আমরা রওয়ানা হলাম কদম রসূল দুর্গ দেখার উদ্দেশ্য।আগামী পর্বে থাকলে কদম রসূল দরগা পরিদর্শনের ছবি আর কথা । সেই পর্যন্ত ভাল থাকুন। কষ্ট করে পড়ার জন্য ধন্যবাদ আল্লাহ হাফেজ।
তথ্যসূত্র : বাংলা উইকিপিডিয়া থেকে ।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মার্চ, ২০১৬ দুপুর ১২:১৬