সেদিন বাড়িতে মা আর আমি শুধু বিনিদ্র রাত কাটালাম।মার চোখ ফোলা , চোখের কোল বেয়ে শুকনো জলের দাগ , মুখের কষ বেয়ে রক্ত শুকিয়ে আছে।আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল মা র জন্য।কিন্তু বরাবরের অন্তরমুখী আমি মনের দুঃখ মনেই চাপলাম ।
আগের থেকেই কথা ছিল মা কদিনের জন্য বাপের বাড়ী যাবেন। সেই জন্য মামা দেখি ঐ ভোরেই ট্যাক্সি নিয়ে উপস্থিত।মামার বয়স তখন কতো আর সতের কি আঠারো হবে। মামা মা কে এই অবস্থায় দেখবেন বোধহয় স্বপ্নেও ভাবেননি। ভয়ে বিস্ময়ে হতবাক মামা দাঁড়িয়ে রইলেন।
মা মুখে কাপড় চাপা দিয়ে মুখ ঢেকে গাড়িতে উঠলেন ।ছোটকাকা মামার হাতে কয়েকটা নতুন শাড়ি প্যাকেটে মুড়ে দিলেন।আমি দেখলাম পাড়ার প্রতিবেশীরা ঐ ভোরেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে মার এই বিদায় দৃশ্য দেখছে। আমি আর আমার অসহায় ভাই দুটো বারান্দায় দাঁড়িয়ে মার চলে যাওয়া দেখলাম ।আমাদের বারান্দায় তখন তিন ভাইবোন ছাড়া আর কেউ নেই।এমনকি বাবাও না। মা পরে বলতেন ওরা বোধহয় সেদিন আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল যে আমাকে বাড়ী ছাড়া করবে। তবু তোর ছোটকাকার মনুষ্যত্ব ছিল তাই সেদিন শাড়ী কখানা আমার গাড়ীতে তুলে দিয়েছিল।
মা চলে যাবার পর বাবা আরো যেন চুপচাপ হয়ে গেলেন ।কারোর সঙ্গে বিশেষ কথা বলতেন না।শুধু আমাকেই সমস্ত কাজে ডাকতেন।মেজকাকীমা লুকিয়ে লুকিয়ে আমায় বেশী করে খাবার দিতেন।বলতেন তোর শরীরটা দিন দিন কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে বাবাকে বলিসনা ডাক্তার দেখাতে। কখনও বলতেন বাবা তোকে খুব ভালোবাসেন তুই এখন যা চাইবি ভাশুরঠাকুর তোকে তাই দেবেন । এখন বাবার কাছ থেকে গয়নাগাটি চেয়ে নে ।আমি বাবার কাছে কোনদিন কিছু চাইনি সেই আমি চাইব গয়না !এ হতেই পারেনা।মেজকাকীমার কথায় আমি চুপকরে রইলাম।
ঠাকুমা রোজ ভোরে বাগবাজারের ঘাটে গঙ্গাস্নান করতে যেতেন। আমাকে সঙ্গে নিতেন কাপড় চোপড় ধরবার জন্য। ইদানীং লক্ষ্য করছিলাম ঠাকুমা সারাপথ কার উদ্দেশ্যে গালা গাল দিতে দিতে চলেন ।আমি একদিন জিজ্ঞাসা করলাম এসব কথা কাকে বলছো?ঠাকুমা মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন কাকে আর বলবো শয়তান সতীশ বোস কে বলছি।আমার দাদুর নাম সতীশ বোস। কথাটা শুনে খুব রাগ হলো। মনে মনে ভাবলাম আর কোনদিন তোমার সাথে আসবোনা ।।
রোজ ছটায় বেরিয়ে গজ্ঙ্গা থেকে ফিরতে আটটা বেজে যেত ।তারপর কোনমতে স্নান খাওয়া করে স্কুলে চলে যেতাম।স্কুলে বসে বসে মাকে চিঠি লিখে ডাকে ফেলে দিতাম তাতে মা সব খবর পেয়ে যেত।আজকাল স্কুল থেকে বাড়ী আসলে বিকেলে দাদা বলতো তুইতো ভালো রীডিং পড়িস ঠাকুমাকে রোজ “দত্তা”বইটা পড়ে শোনাবি?
ভালো রীডিং পড়তে পারি শুনে আমিও পরম উৎসাহে ঠাকুমাকে বই পড়ে শোনাতাম।সকালের ঘটনায় ঠাকুমার ওপর রাগ ছিলই সেদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরলে আমাকে আড়ালে ডেকে মেজকাকীমা বললেন তুই কি বোকা রে নিজের পড়া ফেলে রেখে এসব করছিস। তুই যাতে পড়া করার সময় না পাস সেজন্য ওরা এসব ফন্দী এঁটেছে তা বুঝিসনা? এবার দেখিস পরীক্ষায় ফেল করবি।এবার আমার চোখ খুলল ।আমি ঠাকুমাকে বললাম আমি তোমার সাথে আর গঙ্গাতেও যেতে পারবোনা আর বই পড়েও শোনাতে পারবোনা আমার পড়া আছে।
মা বাড়ী থেকে চলে যাবার পর রান্না নিয়ে বেশ একটা সমস্যার সৃষ্টি হল। অত লোকের রান্না কেউ আর করে উঠতে পারেনা ।ছোটকাকা একের পর এক ঠাকুর নিয়ে আসতে লাগলেন কিন্তু কেউই দুএক দিনের বেশী টিঁকলো না। এবার ছোটকাকা এক রান্নার ঠাকুর আনলেন যে অফিসে চাকরী করে। ঠিক হলো ঠাকুর ভোর বেলা এসে সকাল ন টার মধ্যে রান্না করে দিয়ে অফিসে চলে যাবে আবার বিকেল পাঁচ টায় অফিস থেকে ফিরে রাতের রান্না করবে।এওদু এক দিনের বেশী টিঁকলো না। এবার রান্না করতে এল একটা বউ।ঠিক হল সে তার মেয়ে সহ থাকবে খাবে আর রান্না করে দেবে। বউটার মেয়েটা আমারই বয়সী ।নাম ছবি । ছবির মা্ মাঝে মাঝে আলু সেদ্ধ করে আমাকে বলত একটু ছাড়িয়ে দেনা মা ।ছবিও ওর মাকে টুকটাক সাহায্য করতো। আমিআলু সেদ্ধ ছাড়িয়ে দিতাম ।ছবির মা খুসী হত।
একদিন কাকীমা আমায় ডেকে বললেন তোর পড়াশোনা নেই?সময় নষ্ট করে এইসব কাজ করতে আসবিনা।আসলে কাকীমা আমায় খুব ভালো বাসতেন।তাই আমার ক্ষতি সহ্য করতে পারতেন না।ছবির মাও বেশীদিন টিঁকলোনা। মা যাবার পর থেকে এবাড়ীতে কত যে রান্নার লোক এল গেল তার ইয়ত্বা নেই।যেভাবেই হোক মায়ের অভাব এবাড়ীতে বেশ প্রকট হয়ে উঠল।আমার থেকে দেড় বছরের ছোট গোপী ।ও ছিল শান্ত সব সময় চুপচাপ।কিন্তু ছোট ভাই গৌর তখন ছয় সাত বছরের। ওর মুখটা দেখে আমার খুব কষ্ট হত।ওর মত দস্যি ছেলেও কেমন মনমরা হয়ে থাকতো।এক দিন আমায় চুপিচুপি বলল দিদি মা র জন্য তোর মন কেমন করে?আমার মার জন্য কান্না পায় ।অসহায় আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলাম। বাবা অফিস থেকে ফিরলে বাবাকে বললাম বাবা গৌর বলছিল মার জন্য ওর কান্না পায়। বাবা খানিক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন ও ছোট ওর কান্না পেতেই পারে।
একদিন স্কুলে ক্লাশ চলছে ।দ্বারোয়ানএসে খবর দিল বড়দি আমায় নিচে ডাকছেন।আমার তো ভয়ে মুখ শুকিয়ে চুন।ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে নিচে গেলাম।দেখি বড়দি মামার সাথে কথা বলছে ।বড়দি আমায় দেখে বললেন ,এঁকে তুমি চেনো ?আমি মাথা নেড়ে বললাম হ্যাঁ উনি আমার মামা।বড়দি আমাদের কথা বলতে দিয়ে চলে গেলেন। মামা বল্লেন তোরা কেমন আছিস?আমি মামাকে গৌরের কথা বললাম ।মামা বল্লেন তোকে একটা কাজ করতে হবে ।পকেট থেকে একটা কাগজের ঠোঙা বার করে আমার হাতে দিয়ে বললেনএতে সুপুরী পড়ানো আছে ।তুই বাবাকে রোজ একটু করে দিবি। এতে কি হবে মামা ?আমি জিজ্ঞাসা করলাম।এটা খেলে তোর বাবার মার কথা মনে পড়বে ।বুঝলাম একটা গুরু দায়িত্ব দেওয়া হছ্ছে আমাকে। আমিযত্ন করে সুপুরীরঠোঙাটা নিলাম। মামা চলে গেলেন।আমি ক্লাশে আসতেই দিদি জানতে চাইলেন কে আমাকে ডাকছিলো।দেখলাম ক্লাশের সবাইও বেশ উৎসুক চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে। তাড়াতাড়ি বললাম অন্য ক্লাশের মেয়েকে ডাকতে এসে দ্বারোয়ান ভুল করে আমায় ডেকে নিয়ে গেছিল।
মামার কথামত বাবা অফিস যাবার সময় আমি রোজ বাবাকে সুপুরী দিতে লাগলাম ।ঠাকুমার বোধহয় সন্দেহ হচ্ছিল। ঠাকুমা আমায় জিজ্ঞাসা করছিলো রোজ বাবাকে কি দিই ।আমি কাটা সুপুরী গুলো লুকিয়ে ফেললাম । বাবা দেখলাম ঠাকুমার ওপর রেগে উঠলেন। ঠাকুমাও দেখলাম বাবাকে আর ঘাঁটালেন না। এতে আমারও সুপুরীর মাহাত্ম সম্বন্ধে একটা বিশ্বাস জন্মালো।
আমার পরের ভাই গোপী একদিন দেখি খাটের তলায় বসে কি করছে। আমি ডাকতে বেরিয়ে এসে আমায় বলল ও নাকি খাটের তলায় বসে মন্তর দিয়ে পয়সা বার করছিল ।আমায় মুঠো খুলে অনেকগুলো খুচরো পয়সাও দেখাল।আমাকে মন্তরটা শিখিয়ে দিল।এর পর আমি খাটের তলায় বসে ঐ মন্তর কতবার পাঠ করলাম কিন্তু কিছুই পেলামনা। কিছুদিন পরে ঐ খুচরো পয়সার রহস্য ভেদ হল।ছোটকাকা নাকি গোয়ালাকে দেবেন বলে দুধের দাম হিসাব করেখুচরো পয়সা টেবিলে সাজিয়ে রাখতেন।ছোটকাকা লক্ষ্য করছিলেন টাকা রোজই কিছুনা কিছু কমছে। তাই ছোটকাকাও তক্কেতক্কে ছিলেন। একদিন গোপী আর মেজকাকার ছেলে মদন হাতে নাতে ধরা পড়ল। আর একদিন দেখি গোপী খাটের তলায় বসে কি খাচ্ছে ।আমি জিজ্ঞাসা করায় বলল ,আজকে মামা স্কুলে এসে আমাকে অনেক খাবার দিয়ে গেছে। যাতে কেউ দেখতে না পায় তাই খাটের তলায় বসে খাচ্ছি ।আমি বললাম গৌরকে একটু দিলিনা ।ও বলল গৌরকে দিলে কি হত।কেউ দেখে ফেলতে পারতো।মামা আমাকে বলেছে লুকিয়ে লুকিয়ে খেতে।
আজকাল বাবার কাছে প্রায় প্রায় মায়ের কথা বলি । বাবা দেখি চুপ করে থাকেন ।এই সময় আমার শরীরটা বেশ খারাপ হল।রোজই গা গরম জ্বর জ্বর ভাব।ডাক্তার দেখে ভাত বন্ধ করে দিলেন।রুটি মুড়ি এসব খেতে বললেন।আমার ভাত খেতে এমনিতেই ভালো লাগতোনা।মাছ মাংস রান্না হলেও আমি সেই এক মুঠোর বেশী খেতে পারতামনা। ছোটকাকা লাঠি হাতে করে আমায় ভাত খাওয়াতেন। তাই ভাত বন্ধ করে মুড়ি খেতে বলায় খুব খুশী হলাম। মুড়ি পকেটে করে নিয়ে স্কুলে সরস্বতী পুজোর ফাংশান দেখতে গেলাম।আমি বোধহয় রক্তশূন্য হয়ে যাচ্ছিলাম ।
এমনিতেআমার মাজা মাজা রং ।কিন্তু আমায় এখন বেশ ফরসা লাগে।ওজনও খুব কমতে লাগলো ।বারো বছরের মেয়ের ওজন মাত্র ৩৬পাউন্ড।অর্থাৎ ১৫ কেজির মত। ডাক্তার শিঙি মাছের ঝোল খেতে বলেছিলেন।শিঙিমাছে আমারখুব ঘেন্না। আমি কিছুতেই খেতে রাজী হলামনা। ছোটকাকা আমায় মারতে গেলেন ।বাবা ছোটাকাকে বারন করলেন আমায় মারতে।আর একদিন ডাক্তারবাবু আমায় পরীক্ষা করে খুব চিন্তিত হয়ে বাবাকে বললেন।প্রচুর টাকা খরচ করলে তবে মেয়েকে বাঁচানো সম্ভব। আরো কিসব বললেন সেসব আমার মনে নেই। তবে বুঝলাম আমার খুব একটা শক্ত অসুখ করেছে।এসময় ভাত খাইনা মাঝেমাঝেই ইস্কুলে যাইনা।আমায় কেউ বাড়ীতে বকাবকিও করেনা। একদিন স্কুলেআমাদের ক্লাশে দ্বারোয়ান এসে খবর দিল বড়দি আমাকে অফিস ঘরে ডাকছেন।
আমি নীচে গিয়ে দেখি মা।পাড়ার এক বৌদিকে সঙ্গে করে নিয়ে আমায় দেখতে এসেছেন। “আমি মুঙ্গেরে আমার জ্যাঠতুতো দাদার কাছে যাচ্ছি।এখানে বৌদিদের কলকাতার বাসায় এখন আছি ” ।মা বলে চললেন ,বৌদি আমাকে বলল এত কাছে এসেছো যাওনা একবার স্কুলে গিয়ে মেয়ের সাথে দেখা করে এস।মা আমায় বললেন তুই কেমন আছিস রে?তারপরেই আমার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে ছলোছলো চোখে বললেন এত নোংরা জামা পরে স্কুলে এসেছিস কেউ কেচে দেয়নি ?আমি বললাম কে দেবে আমাদের জামাতো তুমি কেচে দিতে। মা শুকনো হেসে বললেন ,তুই খুব ফরসা হয়েছিস। আর এত রোগা হয়ে গেছিস কেন?আমি বলতে লাগলাম যেন মা আমার জ্বর হয়েছে শরীর খারাপ ।আমার এমন অসুখ করেছে ডাক্তার বাবু বাবাকে বলেছেন একদিকে টাকা আর অন্য দিকে মেয়েকে রাখতে হবে ।প্রচুর টাকা আর যত্ন করলে তবে মেয়ে বাঁচতে পারে।আমি এই বলে কাঁদতে লাগলাম।মার সঙ্গে আসা ঐ পাড়াতুতো বৌদি বলতে লাগলেন।এখন তোমার অভিমান করে থাকার সময় নয়।তুমি মুঙ্গেরে না গিয়ে বরং মেয়ের হাত ধরে বাসায় ফিরে যাও।মা মুখে কাপড় চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগলেন। আমি বারবার বলতে লাগলাম ঠাকুমা এখন এখানে নেই।আমি তোমাকে নিয়ে যাব ।যাবে মা তুমি?ঠিক হল কাল স্কুল ছুটির পর মা জিনিষপত্র নিয়ে স্কুলে আসবে আমি মাকে নিয়ে যাব। আমার সারাটা দিন যে কিভাবে কাটল।মা র কথা কাউকে বললামনা। পরদিন স্কুল ছুটি হলে দিদি আমাকে বলল ,চল বাড়ি চল। আমি বললাম তুই চলে যা। আমি পরে যাব।দিদি চলে গেল।আমি স্কুলের সামনের গাছ তলায়বসে থাকলাম মার অপেক্ষায়। আরও কিছুক্ষণ পর মা এল মামীমার সাথে। আমি মা কে নিয়ে বাড়ী যেতে যেতেবলতে লাগলাম ,তোমার কোন ভয় নেই মা ।আমি আছি না।
মম