একদিন মামা এসে মা কে নিয়ে যেতে চাইলেন। বোধহয় দাদুর অসুখটা বেড়েছিল, কিম্বা দাদু মা কে দেখতে চাইছিলেন। ঠিক হল আজ নয় পরদিন ভোরে মামা আসবেন, এসে মা কে নিয়ে যাবেন। সেদিন রাতে আমাদের বাসায় যে ঘটনা ঘটল তা আমার স্মৃতিতে আজও টাটকা হয়ে আছে। চোখ বুঁজলে আজও সেই রাতটার হাড় হিম করা স্মৃতি আমাকে নির্মম ভাবে ঘিরে ধরে ।
আমি সেদিন পড়তে পড়তে বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হটাত একটা চেঁচামিচিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। মা গোপীকে ভাত খাওয়াচ্ছিলেন, ও লেবু দিয়ে ভাত মেখে খেতে ভালোবাসতো। বারবার লেবু চাইছিল আর ঘ্যান ঘ্যান করছিল। মা ওকে বোঝাতে লাগলেন আজ এমনি খেয়ে নাও বাবা, লেবু তো নেই, কাল তোমাকে লেবু এনে দিতে বলব। এবার ও কাঁদতে লাগলো ওর জামা ছিঁড়ে গেছে নতুন জামা দিতে হবে। এমনিতেই ছোটোবেলা থেকে ও একটু শৌখিন ছিল, তাছাড়া ওর জামা বেশীদিন টিঁকতো না তাড়াতাড়ি ছিঁড়ে যেত। মা আবার ওকে বোঝাতে লাগলেন হবে, পরে হবে। ও নাছোড়বান্দা কাঁদতে লাগলো বায়না করতে লাগল।
মার বোধহয় ধৈর্য্য চ্যুতি ঘটছিল, ও বলতে লাগল বাবাকে কিনে দিতে বলো, মা ওকে কিছুতেই বোঝাতে না পেরে বলে উঠলেন কি করে বলব, বাবা তো তোমার একার বাবা নয় সে সবার বাবা। যখন সবার ছিঁড়বে তখনই পাবে। এই কথা বলা মাত্র ঠাকুমা ছুটে এসে মার চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে গিয়ে মারতে লাগলেন। আকস্মিক ঘটনায় আমি আর অন্যান্য ভাইবোনেরা হতভম্ব হয়ে গেলাম। মা হাতে ভাত মাখা অবস্থাতেই ঘরে বসে কাঁদতে লাগলেন। এই সময় বাবা বাড়ীতে ফিরলেন।
ঠাকুমা, পিসীমা দুজনে মিলে বাবার কাছে সমস্ত বলতে লাগলেন। মা কোন প্রতিবাদ না করে চুপ করে ঘরেই বসে রইলেন, ভেবেছিলেন সব শুনে বাবা ন্যায্য বিচার করবেন। যে মা কোনো রা কাড়েন না সে কথা বলেছে কত দুঃখে সে কথা নিশ্চয়ই বুঝবার চেষ্টা করবেন। বাবা এসে কিন্তু মাকে বলতে লাগলেন এসব কথা বলে তুমি মায়ের অপমান করেছ, যাও মার পায়ে ধরে ক্ষমা চাও। মা বললেন কেন আমি ক্ষমা চাইব? আমিতো কিছু অন্যায় করিনি। এইভাবে মা কে কোনোদিন বলতে শুনিনি। মা বললেন উনি মা না সতীন, সব সময় আমার সাথে সতীনের ব্যবহার করছেন। মার বোধহয় সব সহ্যের বাঁধ ভেঙ্গে গিয়েছিল দেখছিলাম কোথায় সেই নিঃশব্দে সর্বংসহা মা!
মার সোচ্চার প্রতিবাদে হতভম্ব বাবা ঘরের দরজা বন্ধ করে মার মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করতে লাগলেন। যতই রাত বাড়তে লাগল মার গলা ততোই স্পষ্ট শোনা যেতে লাগল মা খুব চেঁচাচ্ছেন , আর কিসব বলছেন, কাঁদছেন। বাইরে মেজকাকীমাও বসে বসে কাঁদতে লাগলেন, কিছু খেলেন না। অনেকক্ষণ পর বাবা হান্টার হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বাবা বোধহয় মাকে খুব মেরেছিলেন, দেখি মার মুখ বেয়ে রক্ত পড়ছে, তখন ও মা কাঁদছিলেন। বাইরের পড়শীরা জানলা খুলে দেখবার চেষ্টা করছিল। কাঁদতে কাঁদতে গোপীও ঘুমিয়ে পড়েছিল। হটাৎ চেঁচামিচিতে জেগে উঠে ও মাকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগল। ভয়ে দিশেহারা হয়ে বলতে লাগল চলো মা তুমি আর আমি এখান থেকে চলে যাই। বাবা শুনে বলল হ্যাঁ তা যাবে না পড়াশুনো না করে ভিখিরি হয়ে থেকো, ও বলল হই হব , আমি আমার মায়ের কাছে থাকবো। এই বলে মাকে জড়িয়ে ধরলো।
আমি চুপ করে সব দেখছিলাম, বাবা হটাৎ আমার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত গলায় বললেন কিরে তুই ও কি চলে যাবি ? এবার আমি কিছু বলতে পারলাম না।ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম।আমি বুঝতে পারছিলাম আমার আশঙ্কাই ঠিক।ওরা সবসময় বাবা আর মার মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাতে চাইতো ওরা সে ব্যাপারে সফল হয়েছে।
একদিন রাতের বেলা হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে আমি দেখেছিলাম পিসিমা মার ঘরে কি একটা যেন ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গেল। আমিসেসময় ঠাকুমা আর পিসিমার কথোপকথন শুনেছিলাম।ঠাকুমা খুব চাপা স্বরে পিসিমাকে বলছেন ,যে জিনিষটা এনেছিস ওতে একদম বিচ্ছেদ হয়ে যাবে!কিন্তু এরকমটা দরকার ছিলনা ।আমি বলছিলামকি দুজনের মধ্যে ঝগড়া ঝাঁটি অশান্তি হল এই পর্যন্ত।ছেলেটা আমাদের ঠিকমত দেখলেই হল। পিসিমা বললেন দ্যাখোনা এ একেবারে মোক্ষম ওষুধ ।খুব কাজ দেবে। তুমিও যেমন,আরে বিচ্ছেদ না হলে কি বিধবা মা বোনকে সারা জীবন দেখবে ভেবেছ?সেদিন ভোর রাতেউঠে আমি আঁতিপাতি করে খুঁজে মার ঘরের মেঝেতে একটা থলথলে মত জিনিষ কুড়িয়ে পেয়েছিলাম।আমি সেটা তুলে সোজাছুঁড়ে ফেলেদিয়েছিলাম জানলা দিয়ে একেবারে ঘরের বাইরে। কাউকে কিছু বলিনি ।এতড় একটা বিপদের হাত থেকে মাকে বাঁচাতে পেরে মনে খুব আনন্দ হয়েছিল। তবু মাকে কিছু বলিনি।এখন মনে মনে ভাবছিলাম ওষুধটা তবে এতই জোরালো । শুধু কিছুক্ষণ সময় ওখানে পড়েছিল তাতেই কাজ হয়ে গেল।
আমি কাঁদতে কাঁদতে মার মুখটা দেখলাম ।চোখ দুটো ফুলে প্রায় ঢেকে গেছে ।মুখের কষের রক্তের দাগ শুকিয়ে গেছে। আমার আরো কান্না পেল। মনে পড়ল একবার ঠাকুমার অশান্তি সহ্য করতে না পেরে মা চাকরটাকে দিয়ে বাজার থেকে কি একটা জিনিষ আনিয়ে খুব সন্তর্পনে তাকে তুলে রাখলেন। চাকর টাকে জিনিষটা আনতে মা দু টাকা দিয়েছিলেন সেটা আমি শুনেছিলাম ।দুটাকা দামের কি জিনিষ ওটাদেখতেই হবে। আমার খুব কৌতূহল হল। মা যেই চান করতে গেলেন ওমনি আমি টুলের ওপর উঠে তাক থেকে কাগজের ঠোঙাটা পাড়লাম। তার মধ্যেকার দলা পাকানো জিনিষটা কি ঠিক বুঝতে পারলামনা। কিন্তু মা ওটা কেন এনেছেন সেটা কিছুটা আঁচ করতে পারছিলাম। কিছুক্ষণ আমি বেশ ধন্দে পড়ে গেলাম ।কি করবো ,মা এখুনি চলে আসবেন । যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। জিনিষটার দাম আছে –২ টাকা।কিন্তু মায়ের জীবন।ভাবলাম মায়ের জীবন বড় না ২টাকা বড়।তারপর জিনিষটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম পাশের বাড়ীর পাঁচিলের ওধারে ।মা চান করে এসে জিনিষটা আঁতিপাতি করে খুঁজেও না পেয়ে শেষে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন এখানে একটা ঠোঙা ছিল্, কোথায় গেলরে?আমি বললাম ওটা আমি ফেলে দিয়েছি। মা কান্না ভেজা গলায় বললেন আছ্ছা তুই আমায় শান্তিতে মরতেও দিবিনে ?
এখন মায়ের এই লাঞ্ছনা দেখতে দেখতে আমার এসব কথা মনে হতে লাগলো। সেদিন মা মরে গেলে এসব হতে পারতো না।আমি মার মুখের দিকে চাইলে মা বললেন তোকে নিয়ে আমি কুঁড়ে ঘরে থাকবো ,তোকে সুখী করবে এমন ছেলের সাথে বিয়ে দেবো। নাইবা থাকলো তার টাকা পয়সা ।আমি সন্তর্পনে মার চোখের জল মুছিয়ে দিতে লাগলাম । এভাবে সারারাত কথা আর কান্নার মধ্যে দিয়ে ভোর হয়ে এল।