দিদি অঙ্কে আর ভূগোলে বেশ ভালো নম্বর পেত ।কিন্তু আর সব বিষয়ে ফেল বা প্রায় ফেল।আমি সব বিষয়ে মোটামুটি পাশ করে যেতাম।মেজকাকাবাবুর ছেলে মধু বররাবরই পড়াশুনায় ভালো ও ফার্ষ্ট সেকেণ্ড হত।আমার পরের ভাই গোপী ছিল একদম ফাঁকিবাজ ।পড়াশুনা একদমই করতো না। যেদিন আমাদের স্কুলে রেজাল্ট বেরোতো মা আমাদের ফেরার সময় হলে বারান্দায় শুকনো মুখে বসে থাকতেন। দূর থেকে আমায় দেখে ইশারায় জিঞ্জাসা করতেন আমি পাশ করেছি কিনা, দিদির খবর কি?আমি ঘাড় নেড়ে বলতাম আমি পাশ করেছি, দিদি ফেল। আর গোপীর যেদিন রেজাল্ট বের হতো মার মুখ দুশ্চিন্তায় অন্ধকার হয়ে থাকতো।মধু যথারীতি ফার্ষ্ট কিম্বা সেকেন্ড হতো আর গোপী টায় টায় পাশ। ফেল অবশ্য করতোনা।মা পড়াশুনা খুব ভালোবাসতেন।ছোট্ট বেলায় বিয়ে হয়ে গেছিল।বিয়ের আগে ঘোড়ার পাতা ফার্ষ্ট বুক পর্যন্ত পড়েছিলেন এসব কথা আমি মার মুখেই শুনেছি।কিন্তু বিয়ের পর আর পড়াশুনা করতে তো পারেন নি।এজন্য মার মনে খুব দুঃখ ছিল।
মা যে একটু আধটু পড়াশুনা জানেন তা আমি টের পেয়েছিলাম। কেননা পরবর্ত্তী কালে আমি মাকে দেখেছি রামায়ন মহাভারত পড়তে ।বাংলায় চিঠি লিখতে আর বাংলা খবরের কাগজ নিয়মিত পড়তে। তবে এসময় কাজের ঠেলায় নিঃশ্বাস ফেলবারও ফুরসত মিলত না।তবু মা এক এক সময় বলতেন, তুই আমায় দেখিয়ে দিলে আমি নিশ্চয়ই অল্প দিনে সব শিখে নিতে পারবো।কিন্তু হায়রে মার এত ইচ্ছা অথচ সারদিন কাজ আর কাজ। মা এতটুকুও সময় পেতেন না।মার স্বপ্ন তাই স্বপ্নই রয়ে গেল।
পূর্ববঙ্গ তখন অশান্ত সবাই এক এক করে এ দেশে চলে আসছে।ঠাকুমা বলতেন, ঋষি অরবিন্দ যখন বলেছেন হিন্দু মুসলমান আবার এক হবে তখন হবেই, অরবিন্দের কথা মিথ্যে হতে পারেনা।সবাই যখন জমিজমা ছেড়ে কিম্বা বিনিময় করে এদেশে চলে আসছে তখন এই বিশ্বাসেই ঠাকুমা গয়েশপুরে ৫০ বিঘে ধানী জমি বাবাকে দিয়ে কেনালেন।বাড়ীর যেসব জায়গা অল্পবিস্তর ভেঙ্গে চুরে গিয়েছিল সেগুলি মেরামত করালেন।
রানাঘাটের এক মুসলমান ভদ্রলোক সে সময় আমাদের বাড়ির সাথে তাঁর বাড়ি বিনিময় করতে চেয়েছিলেন ।কিন্তু ঠাকুমা কিছুতেই রাজী হলেননা।ঠাকুমা বাড়ির আনাচ কানাচ আবার নতুন করে সাজাতে লাগলেন। ভিসা করে শ্যামবাজারে মাঝে মধ্যে আসা যাওয়া করতেন।আমরাও ছুটি ছাটায় ঝিনেদা বেড়াতে যেতাম ।কিন্তুশেষ পর্যন্ত আর থাকা সম্ভব হলনা।
ঝিনেদা টাউনের উপর সিংহদরজাওলা বাড়ী ছেড়ে একদিন চলে আসতে হয়েছিল চিরদিনের মত।পরে জেনেছি আমাদের সেই বাড়ী নাকি এতিম খানা হয়েছে। শ্যামবাজারের বাড়ীতে একেএকে সবাই চলে এল।ঐ ছোট্ট ছোট্ট ঘর গুলোতে গাদাগাদি করে এতবড় একটা সংসার কিভাবে যে দিন কাটাতো ভাবলে এখন অবাক লাগে আমার। শ্যমবাজারে লোকসংখ্যা বাড়ল, সংসার বড় হল,কিন্তুসংসারের চালক সেই বাবা। বাড়ীতে বাবার পয়সা ছাড়া অন্য কারো পয়সায় কোন কিছু কেনার ক্ষমতা ছিলনা কারো। মেজকাকিমা একবার নিজের পয়সায় মুড়ি কিনেছিলেন তা দেখে ঠাকুমা সারা বাড়ী চেঁচিয়ে তোলপাড় করলেন। জানিয়ে দিলেন মেজোবৌয়ের আস্পর্দা আর ভাশুরকে অপমান করার সাহস তিনি আর কোনদিনও বরদাস্ত করবেন না। এরপর মেজকাকিমা আর নিজের পয়সা খরচ করার সাহস দেখান নি।
বাবা যখনই কিছু কিনতেন, তিন বৌ এর জন্য একইরকম জিনিস আনতেন। একবার বাবা তিনখানা শাড়ী কিনে আনলেন। কিন্তু তার মধ্যে একটা শাড়ী বাবা পছন্দ করেছিলেন মায়ের জন্য। ঠাকুমাকে সেকথা বলতে ঠাকুমা বললেন এই শাড়ীখানা কিন্তু মেজবৌমাকেই বেশি মানাবে, ওখানা মেজবৌমাই নিক। মেজকাকিমা শুনে বলে উঠলেন, আর কত নেব? ভাশুর ঠাকুর ওখানা শখ করে দিদিকে দিতে চেয়েছেন ও কাপড় আমি কিছুতেই পরতে পারবো না। বাবা যখন গয়না গড়িয়ে দিতেন একই সঙ্গে তিন বৌকে একই ডিজাইনের গয়না গড়িয়ে দিতেন।আমাকে আর দিদিকে একই রকমের দুল গড়িয়ে দিয়েছিলেন।একবার বাব মায়ের জন্য শখ করে একজোড়া চটিজুতো কিনে আনলেন । ঠাকুমার চিৎকারে সেদিন বাড়ীতে কান পাতা দায় হল। মাঝেমাঝেই ঠাকুমা চিৎকার করে বাড়ী মাথায় তুলতেন ,কান্নাকাটি করতেন ।এক একদিন পাড়া প্রতিবেশীরা ছুটে আসতো কোন বিপদ হয়েছে ভেবে।
আমাদের পোষাক ছিল খুব সাদামাটা।সকলের জন্য বরাদ্দ ছিলএকজোড়া করে । ঐ দিয়েই বছর চালাতে হত।বাড়ীতে বড় ছোট কাচ্চা বাচ্চা মিলিয়ে অনেক লোক ।তাই বছরের এই কাপড় কেনা হত বান্ডিল ধরে। সব কাপড়ের দাম দিতেন বাবা।আমরা বছরে ভাগের ভাগ জামা ছাড়া আর কিছু পেতাম না ।
কিন্তু দিদি কে ছোটকাকার বন্ধুরা ভালো ভালো জামা উপহার দিত।ওর বাবা নেই তাই। দিদি আমার মেজ পিসীমার মেয়ে । মেজ পিসেমশাই দিদির ছ মাস বয়সেই মারা গিয়েছিলেন। সেই থেকে দিদি আর পিসীমা এ বাড়ীতেই থাকতেন। আমি তখন জন্মাইনি।ছোটবেলা থেকেই দিদি ছিল আমার খেলার সাথী ।ওকে ভালোবাসতাম। তাই দিদির এই জামা পাওয়ায় আমার কোন হিংসা হতনা। মনে মনে খুব ইছ্ছা হত ওর মত সুন্দর জামা পরার।কোনদিন যদি বাক্স থেকে একটা পুরোনো তুলে রাখা জামা বেরোতো। অনেক দিন পর বারকরা সেই জামাটা আমার কাছে অপ্রত্যাশিত নতুন জামারই সামিল হত।খুব আনন্দ করে পরে বসতাম।মা বকুনি দিয়ে গাল টিপে দিয়ে বলতেন যা দেখ তাতেই তোমার আনন্দ। দেখতাম মার চোখ ভরা জল। আমার মুখের হাসি মিলিয়ে যেত। বুঝতাম মা রেগে গিয়েছেন। কিন্তু মার চোখের জলের অর্থ বোঝার ক্ষমতা আমার ছিল না। ঠাকুমা পিসীমা দেখতাম শাড়ীর নিচে সেমিজ পরে বেশ সেজেগুজে থাকতেন।কিন্তু মায়েদের তিন বৌয়ের সেমিজ জুটতনা। মা কাকিমা দেখতাম খালি গায়ে লাল পাড় শাড়ি পরেই থাকতেন। মার ছিল কোমর ছাড়িয়ে লম্বা একঢাল কালো চুল।কিন্তু সে চুল বাঁধা দূরে থাক আঁচড়াতেও কোনদিন দেখতামনা। সারাদিন খালি কাজ আর কাজ। জোরে হাসলে বা কথা বললেও ঠাকুমা বকতেন।
আমি তখন ছোট সংসারের সব কিছুঅত বুঝিনা। কিন্তুসংসারের সমস্ত জিনিষ কেনার টাকা বাবা দেন । মা উদয়াস্ত খাটেন তবু ঠাকুমা খুশী হননা।এটুকু বুঝেছিলাম ঠাকুমা মাকে একদম ভাল বাসেন না ।আর তাই আমাদেরও ভালোবাসেন না।ঠাকুমা মেজকাকিমাকে ভালোবাসতেন। আমার মনে হত ইস্ মার মেয়ে না হয়ে আমি যদি মেজকাকিমার মেয়ে হতাম ,তাহলে বেশ হত!আসলে আমার ভীষণ কষ্ট হত।এভাবেই একটা যৌথপরিবারে নানা অভিঞ্জতার মধ্যে দিয়ে আমি বড় হয়ে উঠছিলাম।একান্নবর্তী পরিবারের নির্মমতা আমি ঐ বয়সেই প্রত্যক্ষ করেছিলাম শ্যামবাজারের বাড়ীতে।যা আমার স্মৃতিতে আজও চাবুকের দাগের মত লেগে আছে।
---------------------------------------