somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মামার বাড়ি, ছুটিতে

২৫ শে নভেম্বর, ২০০৯ রাত ১:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমার মায়ের বাবা মানে দাদামশাই ছিলেন সাধাসিধে ভাল মানুষ। বাংলাদেশে নড়ালের জমিদারের নায়েব ছিলেন দাদু,নাম সতীশ চন্দ্র বসু। আমরা শ্যামবাজারের বাসা বাড়িতে থাকাকালীন ছুটিছাটায় ঝিনাইদহের বাড়িতে যেতাম।ওখানে মেজকাকাবাবু সপরিবারে থাকতেন তখনো। কিন্তু দাদুরা বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে এলেন পাকাপাকিভাবে। প্রথমে নদিয়া জেলার কল্যাণীতে জমি দেখলেন,কিন্তু বনবাদাড় বলে পছন্দ হল না। তখন বাদকুল্লায় জমি কিনলেন একসাথে প্রায় চল্লিশ বিঘে। প্রথমে গ্রামের দুই এক ঘর থেকে এসে পছন্দ করে গেলেন। পরে জমি পছন্দ হলে দাদুরা সব জ্ঞাতিগুষ্টিসহ বাদকুল্লায় এসে বসবাস শুরু করলেন। জমিজাতি হল ঠিকই,কিন্তু দাদু এখানে এসে বেকার হয়ে পড়লেন।

একবার আমার স্কু্লে পরীক্ষা হয়ে ছুটি পড়ে গেলে,দাদু আমাকে বাদকুল্লায় বেড়াতে নিয়ে যাবার জন্য বাবার কাছে মত নিলেন। বাবা মত দিলেন। সেবার ঝিনাইদহে না গিয়ে গেলাম বাদকুল্লায়।

শিয়ালদা থেকে ট্রেনে উঠলাম আমি আর দাদু।কামরাটা বেশ ফাঁকাই ছিল। দুজনে মুখোমুখি সিটে বসলাম। দাদু একটু বাদেই ঘুমিয়ে পড়লেন। আমি জানলার ধারে বসে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে চলেছি। দু একটা স্টেশন পার হতেই দুজন লোক কামরায় উঠল ।বসল দাদুর পাশের সিটেই। ময়লা অপরিছন্ন কাপড়চোপড় মুখে একঝাঁক দাড়ি মাথায় ফেজ টুপি। তারা বসেইএদিকওদিক তাকাতে লাগলো।আমি বাইরের দৃশ্য দেখার ফাঁকে ফাঁকে তাদের দেখতে লাগলাম আড়চোখে। রানাঘাট স্টেশন এলেই তারা নেমে গেল ব্যস্তসমস্ত হয়ে। কিন্তু যাবার সময় দাদুর ছাতা খানা নিয়ে গেল।আমি চুপচাপ ঘটনাটা দেখলাম। কিন্তু তাদের কিছু বলতে সাহস হল না। আবার দাদুকেও ডাকলাম না। এরপর বাদকুল্লার কাছাকাছি ট্রেন আসতেই দাদুর ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভেঙেই দাদু সিটের কোণ থেকে নিজের ছাতাখানা নিতে গিয়ে সেটাকে না দেখে এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলেন। তারপর আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন,দিদি,আমার ছাতা খানা কনে গেল? আমি তাড়াতাড়ি বললাম, দুজন লোক তোমার ছাতা নিয়ে রানাঘাট স্টেশনে নেমে গেছে। দাদু একথা শুনে মাথায় হাত দিয়ে হায় হায় করতে লাগলেন,কিন্তু আমাকে কিছুই বললেন না। আমার নিজের উপরেই রাগ হল, সমস্ত ঘটনাটা দেখেও কিছু বলিনি বলে নিজেকে অপরাধী বলে মনে হতে লাগল।

বাদকুল্লা স্টেশন থেকে রিক্সায় চেপে বাড়ির কাছে পৌঁছালাম। আমায় দেখে বড়দিদিমা,মামা সকলেই খুব আদর করতে লাগলেন। আনন্দে ছাতা হারানোর দুঃখটা চাপা পড়ে গেল।

মামার বাড়ির চারিদিকে ধূধূ মাঠ। দাদুর ঘরটা শুধু পাকা, আর দুটো ঘর মাটির। দাদুদের পাশেই গুরুদাস মামাদের ঘর।
এই দু ঘরই প্রথম এই গ্রামে এসেছিল। পরে এক এক করে পুরো পলাশবেড়ে গ্রামটাই উঠে আসে এখানে। জায়গাটার নাম দেয় অঞ্জনগড়। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে একটা নদী।নাম অঞ্জনা।

মামা বিকেলে অঞ্জনা নদীতে মাছ ধরতে গেলেন। সঙ্গে নিলেন আমাকে আর রেখামাসিকে।রেখামাসি মা’র জ্যাঠাইমার মেয়ে। মাসি হলে কি হবে, আমারই প্রায় সমবয়সী।রেখামাসি হল আমার খেলার সাথী।মামা নদীতে ছিপ ফেলেছেন।একপাশে রাখা আছে ছোট্ট মতন একটা কৌটো আর মাছ রাখার একটা বেতের টুকরি।আমি আর রেখামাসি মামার আর এক পাশে চুপচাপ বসে আছি।

মামা বেশ পটাপট নানাধরনের মাছ ধরতে লাগলেন। প্রথমটায় আমি লক্ষ্য করিনি পরে দেখি ঐ ছোট কৌটোটা থেকে কেঁচো বার করে বঁড়শিতে গাঁথছেন আর জলে ছিপ ফেলছেন।দেখে আমার খুব ঘেন্না করতে লাগলো। মনেমনে ঠিক করলাম এই কেঁচো দিয়ে ধরা মাছ আমি কিছুতেই খাবোনা। দিদিমা অনেক সাধাসাধি করেও সে মাছ খাওয়াতে পারলেন না আমায়।আমি এমনিতেই মাছ খেতে খুব একটা ভালোবাসি না। তাই মাছ ছাড়া খেতে আমার বিশেষ অসুবিধা হত না।

মামাবাড়িতে রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে চিঁড়ে দুধ কলা খেতে হত। আরবিকেলের জলখাবার ছিল আমসত্ত্ব দিয়ে দুধভাত।এসব খেতে আমার একদম ভাল লাগতো না।তবে একথা কখনও প্রকাশ করতামনা।দাদু আমায় খুব ভালো বাসতেন।চোখেচোখে রাখতেন আমায় সবসময় ।আর খোঁজ নিতেন খালি আমার কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা।

দুপুরে দাদু ঘুমিয়ে পড়লে আমাকে নিয়ে রেখামাসী বেরিয়ে পড়তো। দুজন হাঁটতে হাঁটতে স্টেশন পর্যন্ত্ চলে যেতাম ।লাইনের ওপর দিয়ে হাঁটতে আমার ভয় করতো।তাই পোলের তলা দিয়ে আমারা যেতাম। যাওয়ার সময় তখন সেখানে কত হাড়গোড় পড়ে থাকতে দেখতাম। পরে শুনেছি ওখানে নাকি শ্মশান ছিল।ভাগ্যিস তখন জানতাম না ।জানলে হয়তো এক পাও যেতে পারতামনা।

দাদু তখন কিছুই করতেন না।আমাদের শ্যামবাজারের বাসায় চা খাওয়ার চল ছিল না। ছোটোকাকীমা লুকিয়ে চুরিয়ে চা খেতেন চিনি গুলে। দাদু দেখি চা খাচ্ছেন ভেলি গুড় দিয়ে।আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে দাদু একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলতেন, আমার চিনি কেনার পয়সা নেইতো তাই গুড় দিয়ে খাচ্ছি। দাদু রেখামাসীকে একটা শাড়ি কিনে দিলেন। খুব সাধারণ জ্যালজ্যালে খোল ।বেগুনী রংয়ের ওপর লাল ডুরে।হোক শস্তা তবু নতুন শাড়ি।আমিও নতুন শাড়ির জন্য বায়না ধরলাম দাদুর কাছে। দাদু বললেন ওরে বাবা এই শাড়ি কি তোকে দিতি পারি। কেন আমি এখন শাড়ি পরতে পারি ।দাওনা কিনে ঐ রকম রেখামাসীর মত।কত কাকুতি মিনতি করলাম ।দাদু কিছুতেই কাপড় কিনে দিলেন না।খুব রাগ হচ্ছিল দাদুর ওপর।পরে বুঝেছিলাম কত কষ্টে দাদু একথা বলে ছিলেন।

মামাবাড়িতে থাকাকালীনই আমার কপালে একটা ফোড়া হল।আস্তে আস্তে বড় হছিল কিন্তু কিছুতেই পাকছিল না।খুব ব্যথা।দাদু খুব অস্থির হয়ে উঠলেন ফোড়া পাকানোর জন্য। প্রথমে কদিন ফোড়ার মাথায় মুসূর ডাল লাগিয়ে দিলেন ।কিন্তু তাতে কিছুই হলনা। তখন নিয়মিত কদিন তোপমারি লাগালেন। তাতেও যখন কিছু হলনা তখন দাদু আমাকে ডাক্তার দেখানোর জন্য মামাকে বলতে লাগলেন। মামার কত কাজ ফুরসতই নেই।সকালে ইস্কুলে যায়।বিকেলে ফিরেই মাঠে ।মামা খুব ভালো ফুটবল খেলে।তাই মামা না গেলে চলেই না।যাইহোক এমনি করেই আমার ফোড়াটা একদিন কিভাবে যেন আপনা থেকেই ফেটে গেল।

আমার বাদকুল্লা ছেড়ে যাবার সময় হয়ে আসছিল।ঠিক সেই সময় আমার ছোট ভাই গৌর এসে হাজির । ও ছিল যেমন জেদী তেমনি দুরন্ত। ওকে দেখে আমাদের মুখ শুকিয়ে গেল।দাদু আমাকে ছেড়ে গৌরকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন।ও যথারীতি একএকদিন এক একটা কান্ড ঘটাতে লাগলো।একদিন গৌরকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। দাদু একেবারে পাগলের মত করছেন।দাদুদের বাড়ির পেছন দিকে মাটি কেটে কেটে একটা ছোট মত গর্ত হয়ে গেছিল। বৃষ্টির জল জমে সেটা ছোটখাট একটা পুকুরের মত লাগতো।সবাই যখন গৌরকে খুঁজছে তখন ঐ গর্তের মধ্যে থেকে দেখি ও চিৎকার করছে, আমি এখানে পড়ে গিয়েছি আমাকে তোল। বেশী গভীরনয় বলেডুবেযায়নি।সকলে মিলে ওকে জল থেকে তুলে আনলে ।দাদু মাথা নেড়ে বলতে লাগলেন আর নয় ।আমি কালই তোমাদের দিয়ে আসবানে।এরপর আমারা আবার শ্যামবাজারে ফিরে এসে পড়াশুনোয় মন দিলাম।
-------------------------------

সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০০৯ রাত ১:১৪
৪৫৬ বার পঠিত
৭টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এক্স লইয়া কি করিব

লিখেছেন আনু মোল্লাহ, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৫১

যাচ্ছিলাম সেগুনবাগিচা। রিকশাওয়ালার সিট কভারটা খুব চমৎকার। হাতে সেলাইকরা কাঁথা মোড়ানো। সুন্দর নকশা-টকশা করা। নর্মালি এররকম দেখা যায় না। শৈল্পিক একটা ব্যাপার। শুধু সিটকভার দেইখাই তার-সাথে কোন দামাদামি না কইরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইলিশনামা~ ১

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৭


১৯৮৫ সালে ডক্টর মোকাম্মেল হোসাইন ‘ ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে যেই রিসার্চ পেপারটা( থিসিস – এম এস এর জন্য) জমা দিয়েছিলেন সেটা এখানে মিলবে;
[link|https://open.library.ubc.ca/cIRcle/collections/ubctheses/831/items/1.0096089|Spawning times and early life history of... ...বাকিটুকু পড়ুন

৯০% মুসলমানের এই দেশ? ভারতে কতগুলো মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির করা হয়েছে? গতকালও ভারতে মসজিদের পক্ষে থাকায় ৩ জন মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৪২

সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার | SAD

লিখেছেন আজব লিংকন, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৩



শীতকালীন সর্দি-কাশি, জ্বর, হাঁপানি, অ্যালার্জিক রাইনাইটিস, কনজাংকটিভাটিস, নিউমোনিয়া কিংবা খুশকি মতো কমন রোগের কথা আমরা জানি। উইন্টার ডিসঅর্ডার বা শীতকালীন হতাশা নামক রোগের কথা কখনো শুনেছেন? যে ডিসঅর্ডারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

চট্টগ্রাম আদালত চত্বরের একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে লিখছি

লিখেছেন শান্তনু চৌধুরী শান্তু, ২৬ শে নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:৪৮



আজ চট্টগ্রাম আদালত চত্বরে যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তা নানান গুজব ও ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা এড়াতে প্রকৃত ঘটনাটি নিরপেক্ষভাবে একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে লিখছি।

চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×