তখন ১৯৪৬। ইংরেজরা দেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিভেদ বাধিয়ে দিল। ধর্মের অজুহাতে মারামারি কাটাকাটি আমি নিজের চোখে দেখেছি সেই সময়ের কলকাতায়।
রাস্তায় বের হওয়া তখন সম্ভব ছিল না। প্রায় সময়ই কারফিউ জারি করা থাকত। সেপাইরা বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকত রাস্তায়। একদিন বারান্দার খড়খড়ি ফাঁক করে দেখতে গিয়ে দেখি, সাহেব আমাদের বারান্দার দিকেই বন্দুক তাক করে আছে। ভয়ে খড়খড়ি ছেড়ে ঘরের মধ্যে দৌড় দিলাম।
আমাদের বাড়ির বারান্দাটা ছিল রাস্তার দিকে। তেতলার বারান্দায় দাঁড়ালে রাস্তা দোকানপাট অনেক দূর পর্যন্ত্ দেখা যেত। একদিন দেখলাম মুসলমানেরা হিন্দুদের দোকান লুট করতে লাগল । হিন্দুরাও মুসলমানদের উপর অত্যাচার শুরু করল।
কোনদিন সন্ধ্যাবেলায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতাম নিকাশী পাড়ার আকাশ লালে লাল। হিন্দুরা মুসলমানদের পাড়ায় আগুণ লাগিয়ে দিয়েছে। একসময় শুনলাম মুসলমানরা হিন্দু মেয়েদের গোপন অঙ্গে লোহার শিক ঢুকিয়ে পুড়িয়ে মারছিল। এতে হিন্দুরা প্রচন্ড খেপে যায়। তখন হিন্দুরা মুসলমানদের নি্র্বিচারে হত্যা করতে লাগল। সেইসব দিনের কথা মনে পড়লে এখনও আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
আমার দেখা কলকাতার সেই জাতিদাঙ্গা সারা ভারত জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। মানুষের তখন খুব খাবারের অভাব। আমাদের ঘরে ছোটকাকা তিন চার বস্তা চাল আর মেশিনে ফাইন করে কাটা বস্তা বস্তা আলু এনে রেখেছিলেন। সেই আলু গরম জলে ভিজিয়ে নরম করে নিয়ে তরকারি ভাজা সব রান্না করা হত।
সকাল থেকে দেখতাম 'একটু ফ্যান দাওগো' ' একটু ফ্যান দাও' বলতে বলতে কত লোক ফ্যান চাইতে আসত। তাদের কঙ্কালসার চেহারা । মা দেখতাম ফ্যানের গামলার মধ্যে একটু ভাত ফেলে দিয়ে ফ্যানটা আমাদের দিয়ে আসতে বলতেন। দেখতাম কঙ্কালসার নরনারী পথের নোংরা ডাস্টবিন থেকে চিংড়ী মাছের খোলা, ফেলে দেওয়া খাবারের টুকরো খুঁজতে গিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। বয়স তখন এত অল্প যে মানুষের এই দুর্দশা কি জন্য তার কারণ কিছুই বুঝতে পারতাম না। কিন্তু খুব খারাপ লাগত মানুষের এই মনুষ্যেতর আচরণে।
এই সময় আমার মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বার বার প্রস্রাব হচ্ছিল। বাইরে তখন কারফিউ চলছে। মার শরীর এদিকে বেশ খারাপ। অগত্যা ছোটকাকা গেলেন ওষুধ আনতে। শুনে ছিলাম পথে সাহেবরা নাকি ছোটকাকাকে গুলি করতে যায়। ছোটকাকা রুগীর জন্য ওষুধ আনতে যাচ্ছেন একথা ওদের বুঝিয়ে বলতে শেষে ওরা অনুমতি দেয়। কলকাতা যখন এরকম অশান্ত , তখন আমরা কিছুদিনের জন্য মামাবাড়িতে দাদুর কাছে চলে গেলাম। মা কিছুদিন ওখানে থেকে সুস্থ হলে আমরা আবার শ্যামবাজারের বাসায় ফিরে আসি।