ছেলেটি ইদানীং ঘুমের ভেতর কেঁদে উঠছে। নিজেকে গুটিয়ে রাখে, বন্ধুদের সঙ্গে আগের মতো খেলে না। হঠাৎ করে রেগে যায়, মন খারাপ করে রাখে। ওর মা-বাবা দুজনেই যথেষ্ট সচেতন; তাঁরা ওকে নিয়ে গেলেন একজন মনোচিকিৎসকের কাছে। দীর্ঘক্ষণ ছেলেটির সঙ্গে আলাপ করে মনোচিকিৎসক জানতে পারলেন, ছেলেটি তাঁর কাছের আত্মীয় দ্বারা নিপীড়নের শিকার হয়েছে।
মা-বাবার অজান্তে নানাভাবে নিপীড়নের শিকার হতে পারে শিশুরা। তা সে শিশু মেয়েই হোক আর ছেলেই হোক। মানসিক নিপীড়ন, শারীরিক নিপীড়ন ও যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটতে পারে ছেলেশিশুদের সঙ্গেও। তাঁর নিরাপত্তা হয়
বিঘ্নিত। ক্রমাগত তাকে উত্ত্যক্ত করা, হুমকি দেওয়া, পর্নোগ্রাফিতে উৎসাহিত করা, মিথ্যা কথা বলা, চোরাই জিনিসপত্র বিশেষ করে চোরাই মুঠোফোন-ল্যাপটপের বিপণনে ছেলেশিশুদের ব্যবহার করা, মাদক সেবনে উৎসাহিত করা ও পরে মাদকের ব্যবসায় তাদের কাজে লাগানোর মতো ঘটনায় নিরাপত্তাহীনতায় পড়তে পারে ছেলেশিশুরা। নিয়ত এই নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কায় থাকতে থাকতে তার মনোজগতে পরিবর্তন ঘটে। মিথ্যা বলা, চুরি করা, অবাধ্য আচরণ করা, পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হওয়া, মাদকাসক্ত হওয়াসহ বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় পড়ে যায় সে।
যৌন নিপীড়ন বিষয়ে একটা সাধারণ ধারণা রয়েছে যে শিশুদের মধ্যে কেবল মেয়েরাই এর শিকার হয়। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গবেষণায় দেখা যায় মেয়েশিশুদের পাশাপাশি ছেলেশিশুরাও এ ধরনের নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। সেন্ট্রাল ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ১৮ বছরের নিচে মার্কিন শিশুদের মধ্যে ২৪ দশমিক ৭ শতাংশ মেয়ে আর ১৬ শতাংশ ছেলে যৌন নির্যাতনের শিকার; অর্থাৎ প্রতি চারজন মেয়ের মধ্যে একজন আর প্রতি ছয়জন ছেলের মধ্যে একজন জীবনে কমপক্ষে একবার যৌন নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছে। এ বিষয়ে ২০০৯ সালে পৃথিবীর ২২টি দেশের ৬৫টি গবেষণাপত্রের ফলাফল একত্র করে একটি সমীক্ষা প্রকাশিত হয় চাইল্ড সাইকোলজি রিভিউ জার্নালে। সেখানে দেখা যায় ১৯ দশমিক ৭ শতাংশ মেয়ে আর ৭ দশমিক ৯ শতাংশ ছেলে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে।
মেয়েশিশুদের পাশাপাশি ছেলেশিশুদের নিরাপত্তার বিষয়ে আরও সক্রিয় হওয়া জরুরি। সম্প্রতি ঢাকায় খেলার এক বিদেশি কোচকে যৌন নিপীড়নের চেষ্টায় বাধা দেওয়ার কারণে স্কুলপড়ুয়া একটি ছেলেকে পানিতে ডুবিয়ে হত্যার অভিযোগ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু অপ্রকাশিত নিপীড়নের ঘটনা রয়েছে অনেক গুণ বেশি।
নিপীড়ক কারা?
নিপীড়ক হতে পারে যে কেউ। গবেষণায় দেখা গেছে, নিপীড়কদের ৮৫ শতাংশই হচ্ছে আক্রান্ত শিশুর পরিচিতজন। এ ছাড়া গৃহশিক্ষক, বাসার গৃহকর্মী, সমবয়সী বন্ধু, বড় ক্লাসের ছাত্রছাত্রী, বড় ভাইবোনের বন্ধু-বান্ধবী, গাড়িচালক, অপরিচিতজন যে কারও দ্বারা ছেলেশিশুর নিপীড়নের ঘটনা ঘটতে পারে। পুরুষ বা নারী যে কাউকে নিপীড়কের ভূমিকায় দেখা যেতে পারে। যৌন নিপীড়ন ছাড়াও নানা রকম অপরাধের (মাদক ব্যবসা, চোরাই পণ্যের বিপণন) সঙ্গে ছেলেদের জড়িয়ে ফেলতে পারে যে কেউ।
নিপীড়নের ধরন
শিশুকে শারীরিকভাবে স্পর্শ করা বা চেপে ধরা, ইচ্ছার বিরুদ্ধে শারীরিক সম্পর্ক তৈরিতে বাধ্য করা, শিশুর একান্ত ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিও প্রকাশ করা, তাকে আপত্তিকর ছবি-ভিডিও দেখতে বাধ্য করা, তার সাথে অশ্লীল-উত্তেজক কথা বলা, শিশুর সামনে অশালীন অঙ্গভঙ্গি করা, নিজের শরীর শিশুকে প্রদর্শন করা ইত্যাদি শিশু নিপীড়নের ধরন হতে পারে।
শিশুর ওপর প্রভাব
শিশু যদি এক বা একাধিকবার যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে থাকে অথবা অন্য কোনো নিপীড়নের ঘটনা না ঘটলেও কেবল চেষ্টার শিকার হয়ে থাকে এমনকি যদি সে নিয়ত এ ধরনের নিপীড়নের হুমকির শিকার হয় তখন তার মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ভয়-লজ্জা-দ্বিধা-বিহ্বলতার কারণে সে বিষয়টি মা-বাবাকে জানাতে ব্যর্থ হয় বেশির ভাগ সময়। তার মধ্যে জন্ম নেয় হতাশা, বিষণ্নতা ও নানাবিধ মানসিক সমস্যা। নিপীড়নের শিকার শিশুটি বিষণ্নতা, অতি উদ্বেগ, অহেতুক ভীতি, খুঁতখুঁতে চিন্তা ও আচরণ, হিস্টিরিয়া (কনভার্সন ডিস অর্ডার), আবেগের সমস্যা, আচরণজনিত সমস্যাসহ নানা ধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। পরে শিশুটি প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাঁর মধ্যে ব্যক্তিত্বের সমস্যা দেখা দিতে পারে। পরিণত বয়সে সে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে মানিয়ে চলতে ব্যর্থ হয়। মনে রাখতে হবে যে যৌন নিপীড়ন ছাড়া অন্যান্য মানসিক চাপ এবং মানসিক অসুস্থতার কারণেও কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে, তাই দ্রুত কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে বিষয়গুলো ভালোভাবে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
কখন বুঝবেন শিশু কোনো সমস্যার মধ্যে পড়েছে
অহেতুক ভয় বা আতঙ্কগ্রস্ত থাকা, কারণে অকারণে কেঁদে ওঠা, ঘন ঘন বমি করা, বমির চেষ্টা করা, খেতে না চাওয়া, ঘুমের সমস্যা, ঘুমের মধ্যে ভয় পেয়ে কেঁদে ওঠা, চিৎকার করা
নিজেকে গুটিয়ে রাখা, পরিবারের সদস্য বা বন্ধুদের সঙ্গে সময় না কাটানো, মন খারাপ থাকা, আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া
স্কুলে যেতে না চাওয়া, পড়ালেখায় মনোযোগ না দেওয়া, পরীক্ষার ফল ক্রমাগত খারাপ করা, খেলাধুলা বা বিনোদনে আগ্রহ কমে যাওয়া, বড়দের মতো কথা বা আচরণ করার চেষ্টা করা, অবাধ্য হওয়া, হঠাৎ করে রেগে যাওয়া, সবাইকে সন্দেহ করা
শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা (দুর্বলতা, ব্যথা) হওয়া, •ঘুমের মধ্যে বিছানায় প্রস্রাব করা, বারবার বাথরুমে যাওয়া, বাথরুমে বেশি সময় কাটানো, একাধিকবার গোসল করা, ব্যক্তিত্বের সমস্যা হওয়া, মাদকসেবন করা,•অন্য শিশুকে যৌন নিপীড়ন করা বা করার চেষ্টা করা, প্রাপ্তবয়স্ক কারও সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করা বা করার চেষ্টা করা।
নিরাপদ কীভাবে
শিশুকে নিরাপদে রাখার জন্য মা-বাবাকে যে বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে হবে—
ছেলেশিশুর ক্ষেত্রে নিরাপত্তা শিথিল করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, মেয়েশিশুর মতো তারও নিপীড়নের শিকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে বয়ঃসন্ধিকালে সন্তানেরা মা-বাবার নজরদারি পছন্দ করে না। এটি মাথায় রেখেই শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
সন্তানকে তার নিরাপত্তার বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতে হবে, কোথায় কার কাছ থেকে সতর্ক থাকতে হবে তা জানানো জরুরি।
সন্তানকে তার বয়স অনুযায়ী যৌন বিষয়ে বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দিতে হবে, শিশুকে তার শরীরের বিভিন্ন অংশের নাম শেখাতে হবে, শরীরের যে চারটি অতি ব্যক্তিগত স্থান—মুখ, বুক, নিতম্ব ও প্রজনন–অঙ্গের নিরাপত্তার বিষয়ে তাকে প্রয়োজনীয় ধারণা দিতে হবে।
যাদের দ্বারা নিপীড়নের শিকার হতে পারে (বিশেষ করে কাছের কেউ) তাদের কোনো কোনো আচরণকে আস্থায় এনে সতর্ক হতে হবে তা শিশুকে জানানো।
মা-বাবাকে কেবল নিজে সচেতন হলেই হবে না, পরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং প্রয়োজনে শিশুর সহপাঠীদের বাবা-মাকেও বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করা।
শিশু কী বলতে চাচ্ছে তা বুঝতে হবে, অনেক সময় শিশু সরাসরি না বলে একটু ঘুরিয়ে, তার প্রতি নিপীড়নের কথা বলতে পারে। আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুকে ভর্তি করার আগে ভালোমতো খোঁজখবর নেওয়া, কর্মজীবী বাবা-মায়ের ক্ষেত্রে বাসায় থাকা শিশুটির নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতন হতে হবে। বিশ্বস্তজনের কাছে শিশুকে রাখা, উৎস জানা নেই এমন পরিমাণ টাকা শিশুর কাছে পাওয়া গেলে, তার কাছে হঠাৎ মুঠোফোন পাওয়া গেলে সতর্কতার সঙ্গে সেগুলোর উৎস জানতে হবে।
যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটে গেলে লোকলজ্জার ভয়ে চুপ করে না থেকে নিপীড়ককে আইনের আওতায় আনা, তা সে যত আপনজনই হোক না কেন। নয়তো নিপীড়ক পরবর্তী সময়ে অন্যান্য শিশুকেও নিপীড়ন করতে পারে।
নিপীড়নের শিকার হওয়া শিশুর মধ্যে কোনো মানসিক সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত তাকে চিকিৎসার আওতায় আনা। তাকে দায়ী করা ঠিক হবে না, তিরস্কার করা যাবে না। বরং বোঝাতে হবে যে এ ঘটনায় তার নিজের কোনো দোষ নেই। তার জন্য মানসিক চিকিৎসার পাশাপাশি শারীরিক চিকিৎসারও প্রয়োজন হতে পারে।
নেট থেকে
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে নভেম্বর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:০০