আগের পর্ব দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
বর্ডার পর্ব-১
ভিসা যখন পেলাম ঘড়ির কাটায় মিলিয়ে দেখি সন্ধ্যে ৬টা ছুঁই ছুঁই। সে এক আশ্চর্য্য অনুভূতি। নীচে নেমে এক কোনায় বসে বার বার দেখছি সেই আশ্চর্য্য পাতাটি আর পড়ছি এর লেখাগুলি। অনেক কষ্টের পর অনুযোগও কম ছিল না। কিন্তু পাওয়ার আনন্দে কোথায় যেন সব উবে গেল।কম করে হলেও ৫ জনকে জানালাম সেই বিশ্ব জয়ের খবরটি।
রাত্রী সাড়ে ৮টার গাড়ী। বাসার নীচ থেকেই CNG পেয়ে গেলাম। উদ্দেশ্য কল্যাণপুর SR কাউন্টার। ড্রাইভারের কাছে “রাস্তায় জ্যাম আছে” শুনে হাতির ঝিল দিয়ে ঢুকে নাবিস্কো-মহাখালী হয়ে আগারগাঁও ক্রস করতেই সামনে চোখে পড়ল শ্যামলী শিশু মেলার জ্যাম।শেরে-বাংলা নগর বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে গিয়ে গাড়ী একেবারে থেমে গেল।আসাদগেট হয়ে আসলে অবস্থাটা কি হ’ত আন্দাজ করে নিলাম।
পাক্কা আধা ঘন্টা খেয়ে নিল শিশু মেলার জ্যাম। ভাড়া চুকিয়ে কাউন্টারে ঢুকে বুকিং করা আসন চাইতেই শুনলাম সময়মত আসি নাই বলে আসনটি বিক্রি হয়ে গেছে। মাত্র ৪দিন আগে ঈদ গেছে।ফিরতি গাড়ীর টিকিট সোনার হরিণ হবে ভেবে বুদ হয়েছিলাম।বলা হচ্ছে বুকিং সিট নিশ্চিত করতে গাড়ী ছাড়ার ৪৫ মিনিট আগে কাউন্টারে পৌছতে হবে।এখন কেবল পিছনের সারিই ভরসা। ছুটাছুটি,জ্যামে বসে প্রতীক্ষার ধকল আর কাউন্টারের তেলে সমাতিতে এখন সত্যি সত্যিই ক্লান্ত মনে হচ্ছে।
সারা রাত আরাম মত ঘুমাব বলে মাঝামাঝির এই সিটটি বুক দিয়েছিলাম। এসে যা শুনলাম যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না।অনেকটা অভিমান করেই ঝিম মেরে টিকেট মাস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। এই গাড়ীতেই কয়েকদিন আগে নীলফামারী গিয়েছি।আবার তিনবিঘা করিডোর দেখে সব গাড়ীকে ”না “ বলে এই গাড়ীতেই পাটগ্রাম থেকে ঢাকা এসেছি।যাত্রীর আকাল বেলায় সে কি আদর! আজ যাত্রী ভরা কাউন্টারের চরিত্রটাও দেখার সৌভাগ্য হ’ল।
শ্যামলীর BRTC তে গিয়ে পেলাম পিছন থেকে তৃতীয় সারির সিট।কিন্তু উনারা বুড়িমারীর টিকিট দিবেন না।সরাসরি শিলিগুড়ির টিকিট নিতে হবে।ভাড়া পড়বে ১৫০০টাকা। আর বুড়িমারী পর্যন্ত SR Plus এর ভাড়া ৮০০ টাকা। ঢাকা থেকে বুড়িমারীর দূরত্ব ৪৫৭ কিলোমিটার। আর বুড়িমারী থেকে শিলিগুড়ি ৮৩ কিলোমিটার।৪৫৭ কিলোমিটারের ভাড়া ৮০০টাকা হলে মাত্র ৮৩ কিলোমিটারের ভাড়া ৭০০ টাকা হয় কিভাবে ? অথচ SR Plus ও শ্যামলীর BRTC গাড়ীর মধ্যে গুণগত কোন প্রার্থক্য খুঁজে পেলাম না।
বুড়িমারী বর্ডার চেকপোস্টের গায়ে বুড়িমারী থেকে বাংলাদেশ-ভারতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ শহরের দূরত্ব
এবার গেলাম নন AC Hanif Enterprise এর কাউন্টারে। গিয়ে দেখি পারলে তারা ইঞ্জিন কভারটাও বিক্রি করে বসে আছে। Hanif, SR, শ্যামলীর BRTC সবার গাড়ীই রাত সাড়ে ৮ টায়। শ্যামলী বা SR এর কোন নন AC গাড়ী বুড়িমারী যায় না। শুনলাম আর যে সব গাড়ী বুড়িমারী যাবে তাদের কাউন্টার টেকনিক্যাল অথবা গাবতলী কেন্দ্রিক।
খুব একটা আশাহত হলাম না। কারণ বুড়িমারী-পাটগ্রাম যে গাড়ীই যাক না কেন সেগুলো সাধারণত তিস্তা ব্রীজ পাড়ি দিয়ে লালমণিরহাট হয়ে যায়।অন্য রাস্তাও আছে।সেটা নীলফামারীর জলঢাকা দিয়ে ঢুকে তিস্তা ব্যারেজ হয়ে। তবে মাঝে মাঝে ডাকাতি হয় বলে রাস্তাটির একটি কু-খ্যাতি আছে।অতএব, লালমণিরহাট অথবা তিস্তা ব্রীজ পাড় হবে এমন যে কোন গাড়ীতে গেলেও ওখান থেকে বুড়িমারীর গাড়ী পাওয়া যাবে এ ধারণায় লালমণিরহাট বা কুড়িগ্রামের গাড়ীর খোঁজ নিতে গেলাম।ভাল সিটও মিলল।কিন্তু মুশকিল হলো লালমণিরহাট বা কুড়িগ্রামের কোন গাড়ীই রাত ১০টার আগে ছাড়বে না। কাউন্টারে বেকার দেড় থেকে দুই ঘন্টা বসে থাকতে হবে।ওদিকে সকালে নেমে বর্ডারে পৌছতেও দেরী হবে।কথাগুলি ভাবছি এমন সময় দেখি কুড়িগ্রামের ভুড়িঙ্গামারীগামী গাড়ীর সুপার ভাইজার যাত্রীদের আসন নিতে বলছেন।গাড়ী ছাড়বে রাত ৮টা ৪৫মিনিটে। “D” লাইনের সিট,চাইতেই পেয়ে গেলাম।কারণ অধিকাংশ সিটই ফাঁকা।ফিরতি তত্বের স্বার্থক সত্য। বুড়িমারীর গাড়ীগুলোতে এত চাপ পড়ল কেন বুঝতে পারলাম না।সুপার ভাইজারকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিলাম- লালমণিরহাট যাব এমন জায়গায় নামিয়ে দিতে ভোর কয়টার সময় গাড়ী পৌছবে? সুপার ভাইজার জায়গাটির নাম বলল মোস্তাফির মোড়।পৌছবে কম করে হলেও ফজর নামাজের পর।টিকেট মাস্টার জায়গাটির নাম লিখে ভাড়া নিল ৫০০টাকা।
(৬) আমার ট্রিপসঃ-এমন পরিস্থিতিতে অপরিচিত জায়গায় গাড়ী থেকে নামার সময় চারিদিকে ফর্সা হওয়াটা জরুরী। কারণ ফজরের আজানের আগে বা পর মহুর্তের সময়টুকুতে এসব স্থানে ঠক লোকের (বিশেষত ছিনতাইকারী) আনাগোনা বেশি থাকে।
ক্লান্তির কথা আগেই বলেছি।গাড়ী যখন আমিন বাজারের সালেহপুর ব্রীজ পার হচ্ছিল তখনও হুঁশ ছিল। এরপর আর মনে নেই।গাড়ী ভর্তি লাইট আর মানুষজনের চিৎকার চেঁচামেচিঁতে যখন হুঁশ ফিরল তখন দেখি গাড়ী সিরাজগঞ্জ চান্দাইকোনা “হাইওয়ে ভিলা রেষ্টুরেন্টে” দাঁড়িয়ে আছে।বাসা থেকেই পেটটাকে ভালমত শাসন করে নিয়েছিলাম। অতএব, ক্ষুধার রাগটা খুব একটা নেই কেবল ঘুমের তেজটা ছাড়া।তাছাড়া আমি বরাবরই ঘুম কাতুরে মানুষ।ভালমত ঘুম হলে সময়টা ফরফুরে মেজাজে কাটাতে পারি।
হাইওয়ে ভিলা রেস্টুরেন্টের সামনে থেকে।অন্য কোন ট্যুর এ ছবিটি তোলা।
ভোর বেলার হতব্যস্ত মানুষের হাকডাক আর চলন্ত গাড়ীর হর্ণে আবার যখন ঘুম ভাঙল চোখ খুলে দেখি গাড়ী রংপুরের লালমণিরহাট-কুড়িগ্রাম বাস স্ট্যান্ড মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে।সামান্য পিছনেই মডার্ণ মোড়।আকাশে মেঘ, তবুও অনেকটা দূর পর্যন্ত পরিস্কার দেখা যাচ্ছে।সামনের সিটগুলির যাত্রীরা অনেকেই নেমে গেছেন।কন্ট্রাকটর পুটলি পাটলি হাতে যাকে যেভাবে পারছে তুলে খালি সিটগুলো ভরে নিচ্ছে।
বেশ কিছুটা সামনে গিয়ে তিস্তা নদী।এপাড়ে রংপুরের কাউনিয়া আর ওপাড়ে লালমনিরহাটের তিস্তা বাস স্ট্যান্ড।বামে আগের সেই রেল ব্রীজটি এখনও আছে।কিছুদিন আগেও যেটা দিয়ে রেলগাড়ী-মটরগাড়ী একসাথে পার হতো।এখন খানিকটা ডানে সরে এসে আরেকটা সড়ক সেতু হয়েছে।এটাই তিস্তা ব্রীজ। নীচে ভারত থেকে নেমে আসা কাঁদা মাখা স্রোত ঘুরপাক খেতে খেতে ছুটছে ভাটির ব্রহ্মপুত্র-যমুনায় মিলিত হতে।
তিস্তা নতুন ব্রীজ থেকে রেলওয়ে ব্রীজ(পুরাতন ব্রীজ)। মাত্র কিছু দিন আগেও যার উপর দিয়ে মটরগাড়ী-রেলগাড়ী একসাথে চলত। ছবিটি সংগৃহীত।
তিস্তা ব্রীজ পার হয়ে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই মোস্তাফির মোড়ে পৌছে গেলাম।মোড়টি তিন মাথা। লম্বা গাছের ডালের মত বেড়িয়ে বামের শাখাটিই লালমণিরহাট-পাটগ্রাম চলে গেছে।কয়েকটি দোকান পাঠের সাথে দু’য়েকটি হোটেলও খোলা পেলাম।বেশকিছু চার্জার গাড়ী দাড়িয়ে আছে লালমণিরহাট যাবে বলে।ভাড়ার রেঞ্জে বুঝতে পারলাম চার্জার গাড়ীর মন্থর গতির কাছে অনেকক্ষণই লাগবে।এই সাত সকালে দু’তিনজন অজানা অচেনা লোকের সাথে এমন খোলা গাড়ীতে উঠতে মন সায় দিল না।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতেও হল না।পিছনে তাকিয়ে দেখি শুভ বসুন্ধরা।সামনের গ্লাসে লেখা ঢাকা-বুড়িমারী। হাত তুলতেই দরজা খুলে কোথায় যাব শুনেই তুলে নিল। ততক্ষণে পিছনে রোজিনা এন্টার প্রাইজও এসে দাঁড়িয়ে গেছে।
মোস্তাফির মোড়-লালমণিরহাট। বামের রাস্তাটিই লালমণিরহাটের রাস্তা। আর সোজাটি চলে গেছে কুড়িগ্রামের দিকে। ছবিটি সংগৃহীত।
(চলবে)