somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কথাচ্ছলে : ঝিলামে যখন ছিলাম-১

০৮ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ৭:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জম্মু স্টেশনের সামনে থেকে গাড়ি ছাড়ল সোয়া আটটায়। রাস্তা ভালোই আছে। কারণ মিলিটারিদের শুধু যে চলতে হয়, তাই নয় পালাতেও হয়। আমরা ড্রাইভারের সাথে রফা করলাম ছত্রিশ শ’ রুপিতে। কিন্তু সে আরো দুই শ’ টাকা বখশিশ দাবি করল। মনে মনে ভাবলাম, ড্রাইভিং যদি ভালো হয় পুরো চার হাজারই দেবো। একে রমজান মাস, তদুপরি কাশ্মিরিদের গরিবি-হালত দেখেই বোঝা যায় তাদের কষ্টটা। এক ‘ফিরান’ পরেই তারা কাটিয়ে দেয় দশ-পনেরো দিন। একটু মোটা কাপড়ে তৈরি এই ফিরান নিত্যি না ধুলেও চলে; তবে ময়লাটা তো চোখে পড়ে। পাঠানদের সাথে চেহারার যতই মিল থাকুক, পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে কাশ্মিরিরা খুবই সচেতন।
উঁচুতে যত উঠি, আমার শাশুড়ি তত তার নাতনীকে খুঁচিয়ে দেন : বাবাকে জিজ্ঞাসা করো তাজিন এখানেই কি নাজনীনের সাথে দেখা হয়েছিল?
আমি লজ্জায় লাল।
তালিব ভাই-হাসনাইন ইমতিয়াজের কারণে আর নিজের গোপন রোমান্টিকতার চাপে যে বইয়ের পুরোটাই প্রায় কল্পনা সে বই আমার মায়ের বয়সী এক পাঠিকারও বুকের ভেতরে গিয়ে বসে আছে! তারপরও এই সাহিত্যকে যারা ছুরি নিয়ে দৌড়ান আল্লাহ তাদের কোন বেহেশতে ঠাঁই দেবেন?
তাজিনের কৌতুকময় হাসি আর নানী-নাতনীর খোঁচাখুঁচিতে আমি বারবার অসুস্থ ছেলের মাথা কাঁধের ওপর টেনে নেই আর বলি আমি গাড়ি থামিয়ে দেখিয়ে দেবো, মা। চুপ করো।
কিন্তু তাজিনকে ততক্ষণে মজায় পেয়ে বসেছে। ষোলো-সতেরো বছরের যে কোনো তরুণীই স্বপ্নের রানী হতে চায়। অথচ আমি দেখছি প্রায় দুই যুগ আগের সেই রাস্তা, সেই বাস, সেই সাইপ্রাসের কালচে-সবুজে ছুঁয়ে যাওয়া মেঘ আর অনেক নিচে বয়ে যাওয়া রিনিঝিনি নদীর ধারা। এই বিচিত্র সুন্দরের সাথে সামান্যই মিল আমার জন্মভূমির যদিও অনেক সাযুজ্য আমলাতন্ত্রে, বিচারহীনতায় এবং কলুষিত রাজনীতিতে। আমি সেসব আবেগ ঝেড়ে ফেলে ড্রাইভারকে ভয়ে ভয়ে বলি, নাশতা খাবেন আমাদের সাথে, ভাই। আজ আপনি আমাদের মেহমান।
লং-ড্রাইভের চালকেরা সাধারণত রোজা রাখতে পারেন না। তবু তার কঠোর চেহারা আর রুক্ষ্ম দাড়ির আড়ালে হাসি ফোটে কি না, বোঝার চেষ্টা করি। লাভ হয় না। তবে তেই শ’ বছর আগের নাজনীনের চোখের ভাষা সেখানে আমি ঠিকই পড়তে পারি; যখন সে বলেছিল... তোমার ওই বদান্যতার বিনিময়ে আমি তোমায় কী আর দিতে পারি? কিছুই তো নেই আমাদের!
প্রায় এক ঘণ্টা পর জিপ থামে পাঞ্জাবি-ধাবায়। ড্রাইভার বিনীত কণ্ঠে বলে আধা ঘণ্টার মধ্যে আমি রওনা হতে চাই, জনাব।
জি-আচ্ছা। বলে আমি ঘড়ি দেখি।
পুরি সবজি আর পাকোড়া দিয়ে আমরা সফরকালীন নাশতা সারি। আম্মা হঠাৎ জানতে চান সেবারও কি এখানেই গাড়ি থেমেছিল?
তিনি রোজা। তবু তার সমস্ত আগ্রহ ঝিলামের নাজনীনে। আমি মিথ্যা করে বলি অত কী আর মনে আছে এখনো?
আম্মা বালিকা-সুলভ চাপল্যে বলেন আমরা বুঝি বুঝি না, তাই না?
আমার চোখ ভিজে আসতে চায়। নাভিদ কিছুই খেতে পারছে না দেখে তাকে নিয়ে খোলা হাওয়ায় যাই। এই ধাবায় নেমেই নাজনীন আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিল সরল চোখে। না সে চোখে ছিল ভয়, না বিদ্রপ। এখান থেকেই শুরু হয়েছিল তার জীবনের গল্প আমি দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে পড়ি...।
সেই পাহাড়, সেই নদী, সেই আকাশছোঁয়া দেওদার আর ফার গাছ এবং পথের দু’ধারে ফোটা জুনিফুল আজো ফুটে আছে শুধু নেই এ মাটির স্বাধীনতা। যদি রাজনীতির কথা নাও ভাবি, তবু আমার মনে হয় এই কাশ্মির হচ্ছে ভারতবর্ষের জেরুসালেম। আমি উদাস হয়ে যাই। মনের কোণে কোণে ভেসে বেড়ায় সেই আদিম প্রশ্ন আল্লাহ তো আদমকে পরীক্ষার মধ্যেই পাঠিয়েছেন। কেউ সে পরীক্ষা দেয় হলে বসে; কেউ যুদ্ধের ময়দানে। কিন্তু আমার দেশে? সবুজ শ্যামল শান্তির মধ্যে কোনো পরদেশী না থাকলেও আমরা পর করেছি আপনকেই। সামান্য স্বার্থে কিংবা হিংসায় ভাই ভাইকে মারছি আর রঙ দিচ্ছি রাজনীতির। মানুষের খুনকে যে জাতি মূল্য দেয় না, সে জাতির নিজের মৃত্যুও যে ঘনিয়ে আসে তা আমরা কবে বুঝব?
***
গাড়ি ছাড়তে দশ মিনিট দেরি হলো। কারণ একেবারে শেষ মুহূর্তে নাভিদের একটু ক্ষিদে অনুভব হওয়ায় তাকে দু-টুকরো পাউরুটি আর এক কাপ চা দেয়া হয়েছে। দেখি কিছু গিলতে পারে কি না।
গাড়ি উঠছে তো উঠছেই। বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ির চেয়ে অনেক বেশি দেরি করিয়ে দিচ্ছে একই দিকে চলা সামরিক কনভয়। আমার শাশুড়ি দু’শটা হেভি-ডিউটি ট্রাক এবং একশ’টা পর্যন্ত কামান গোনার পর ক্ষান্ত দিয়ে বললেন নাহ্, আর সম্ভব না। আমি এবার ঘুমাই।
কিন্তু বিস্ময়করভাবে জেগে থাকল আমার কন্যা। সে আস্তে আস্তে কথা শুরু করল। বুঝলে বাবা, জার্নিটা আমি দারুণ এনজয় করছি। নানী আর আম্মু নাজনীনকে খুঁজছে, খুঁজুক। আমরা দেখতে থাকি পাহাড়ের মেঘ, মেঘের ওপরের বাড়ি আর রঙ-বেরঙের জুম।
আমি আগেই অবাক হয়েছি জুমক্ষেতের লালচে এবং গোলাপি রঙ দেখে। অনেক দূরে দূরে বলে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না যে কিসের ক্ষেত ওগুলো। গম আর যব ছাড়াও কী নতুন ফসল এসেছে কাশ্মিরে? নাকি জাফরান?
- না না, জাফরান তো বড় গাছে হয়।
-বড় মানে? আমি তাজিনের কথায় অবাক হয়ে যাই।
-বড় মানে যেগুলো লতাগুল্ম নয়। জবাব দেয় মেয়ে ওই মরিচগাছ বা আরেকটু বড়। ওই যাকে হার্প-না-শ্রাব কি যেন বলে না।
-ও হ্যাঁ, তা ঠিক বলেছিস মা। আমি ভেবেছিলাম রেন-ট্রি বা ওরকম কিছুর কথা বলছিস নাকি।
-পাগল পেয়েছ আমাকে? আমি বুঝি ঝিলাম পড়িনি!
-তুই-ও পড়েছিস? কবে? কিভাবে?
-কিভাবে আর- চুরি করে। আম্মু কি নইলে দেয়। তোমার এত বিখ্যাত বইটা আমি না পড়লে ইজ্জত থাকে, বলো? তবে আমার কিন্তু তোমার বন্ধুদেরকেই বেশি ভালো লেগেছে। বিশেষত খুরশিদকে।
আমার বুকটা আবারো ভারী হয়ে আসে। কে জানে, নয়ীম-খুরশিদরা কে কোথায় আছে? বেঁচে আছে কি না তাই তো জানি না। কোথায় আছে নাজনীন? তেইশ বছর আগের সেই পাগলামি-ভ্রমণ আর সেই অখ্যাত বাঙালি-তরুণকে কি সে মনে রেখেছে? কিভাবে তা সম্ভব? আমি না হয় সাহিত্য-করে তার নাম পৌঁছে দিয়েছি বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে, কিন্তু তার তো সে সুযোগ থাকার কথা নয়।
আমার চোখের পর্দায় ভেসে উঠল তার সেই ওড়না-ঢাকা দীপ্ত মুখ। সেই কাজল টানা ঈগল-ভুরু আর স্বপ্নমথিত মাদকতায় হক-কথা বলার শিল্পীত সাহস। তার সেই স্বপ্নের-জাভারভান পাহাড়ে নিশ্চয়ই আমি আমার পুত্র-কন্যা-পরিবার-পরিজনকে নিয়ে যাবো। নিয়ে যাবো গুলমার্গ, পেহেলগাম, সোনমার্গ আর ডাল লেকে। সেই শঙ্করাচার্য মন্দিরেও আমি যাবো তবে নিশ্চয়ই সেখানে উপস্থিত থাকবে না সেই ড্রাইভার করিম খান। জীবন তো এরকমই। নদীর মতো। শুধু চলে। চলে আর হারিয়ে যায়। কখনো বিরহে, কখনো মৃত্যুতে। শুধু সেই যাওয়াটাকে কে কত অর্থপূর্ণ করে যেতে পারে সেটাই মূল্যবান। আমার মনে পড়ে গেল এক আশ্চর্য কবিতা :
মানুষের বৈপরীত্য নিয়ে কেউ আশাহত হয়ো না
পরস্পর-বিরোধিতাই জীবন।
কেউ তরবারি নিয়ে প্রতিবাদ করে
কেউ তরবারির নিচে মাথা দিয়ে প্রতিবাদ করে...।
সেই চলে-যাওয়া নাজনীনকে যদি পাই কোন রূপে তাকে দেখতে পাব? যে আমায় আফসোস করে বলেছিল, কেবল সামর্থ্যবান স্বামীর স্ত্রী হওয়া তার স্বপ্ন নয়, সে চায় আরো বড় কিছু; আমার প্রিয় শিক্ষক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়’কেও ছাড়িয়ে যে উঠতে চেয়েছিল জোয়ান-অভ-আর্কদের সারিতে; নারীত্বের ভূষণ আর ধর্মের গোঁড়ামির ঊর্ধ্বের এক শাশ্বত-সুখের স্বপ্ন ছিল যার তার মতো? নাকি, সাধারণ ভোগ-বিত্তে সুখী হাজার নারীর মতো যারা স্বপ্নের অনুসারী হতে রাজি না তাদের মতো? আমার সেই বন্ধুর যদি দেখা পাই আমি জানতে চাইব যে, তার স্বপ্নের কতটা পূরণ হয়েছে? স্বাধীন দেশের পরাধীন মানুষের মুক্তির-সাধ আসলেই কখনো সফল হয় কি না!
আমরা তিন-তিনটি বড় পাহাড় পেরিয়েছি, বাবা।
তুই ঘুমাচ্ছিস না কেন, মা?
আমি ঘুমাতে পারছি না, বাবা। এত থ্রিল আর আনন্দ লাগছে যে চোখের ত্রিসীমানায় ঘুম আসার সুযোগই পাচ্ছে না। ঘুমকে আমি পাঠিয়েছি নানীর চোখে।
প্রায় নাজনীনের মতো কথাবার্তা। হঠাৎ যেন আমি ভুলে যাই এ আমার নিজেরই মেয়ে, যে কেবল স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে। ভেবে ভেবে সিদ্ধান্ত নেই তার আনন্দ-অবগাহনে আমি বাধা হতে পারি না। আমি হতে চাই না সেই হন্তারক পিতা, যে তার সন্তানের দেহকে বাঁচানোর জন্য কাপড়ের পর কাপড় পেঁচিয়ে দেয় এবং অজান্তে শৃঙ্খলিত করে তার হৃদয়। আত্মসমর্পণের দ্বন্দ্ব যার মধ্যে কাজ করে না আমি তেমন ধার্মিক কখনোই হতে চাই না।
বাবা, শোনো ফিসফিস করে বলে তাজিন, তোমার কি নাভিদকে কাঁধে রাখতে কষ্ট হচ্ছে?
একটু তো হচ্ছেই, মা। ও তো বেশ বড় হয়েছে; প্রায় তোমার সমানই।
না। ও আমার তিন বছরের বড়।
কথা বছর নিয়ে নয়, মা। ছেলেরা লম্বা হয় বেশি এবং তাদের গতরও দ্রুত বাড়ে। বিশেষত, এডোলোসেন্ট-পিরিয়ডের সময়।
হ্যাঁ, দেখ না, বান্দরের এখনই গোঁফ উঠতে শুরু করেছে। দাঁড়ি রাখলে ওকে সম্রাট আকবরের মতো লাগবে; তাই না, বাবা?
যোধা-আকবর দেখে দেখে তোমার মগজটা গেছে।
কোথায় আর যাবে বলো? তোমরা তো ঘরের বাইরেই যেতে দাও না। ভয়েই মরে যাও।
কেন এই যে কাশ্মির যাচ্ছি; যেতে দিচ্ছি। এটা কি ঘরের বাইরে না?
হ্যাঁ, তা বটে। তবে ইস্তাম্বুল তো নাও না।
আচ্ছা! কিন্তু কায়রো?
ওহ্, বাবা। প্লিজ, আমার মনটাকে খারাপ করে দিও না। জানো, যেদিন-যেদিন আমার পরীক্ষা ভালো হয়, সেদিন-সেদিন আমি স্বপ্নে নীল-নদী দেখি!
ভালো তো। আমি ফোড়ন কেটে বলি, চশমা ছাড়া ঘুমাই বলে আমার সব স্বপ্ন সাদা-কালো। আমি বুড়িগঙ্গাকেও কালো দেখি। আর তুমি নীলও দেখো
তোমার চশমা থাকলেও তুমি বুড়িগঙ্গাকে কালোই দেখতে। ওই যে বরিশাল গেলাম না লঞ্চে, ছি: ছি:, বুড়িগঙ্গার দুর্গন্ধে সদরঘাটে টেকাই যায় না। আচ্ছা বাবা, তুমি যে লিখেছ মিসরের সব শহরে নীলের দু-পার কংক্রিটে বাঁধানো; সেটা কি সত্যি?
মিথ্যা কথা লিখব কেন, মা?
তাহলে কি এটাও সত্যি নয় যে, তুমি নাজনীনের প্রেমে পড়েছিলে?
আমার দম বন্ধ হয়ে গেল।
মেয়েরা কত তাড়াতাড়ি বড় হয় আর তাদের চিন্তা কত বিচিত্র ও বহুমুখী! মা-নানী জেগে থাকতে এই মেয়ে ভাব করেছে যেন নাজনীনকে সে চেনেই না। অথচ এখন নির্জনে-একাকী বাপের নাড়ি ধরে টান দিতেও দ্বিধা করছে না। কপাল!
বলো, লেখকেরা যা লেখে, তা কি সব সত্যি?
হ্যাঁ, সত্যি। তবে আক্ষরিক অর্থে নয়, মা।
বুঝিয়ে দাও।
যেমন ধরো, তোমার নাম তাজিন। কিন্তু তোমাকে আমি লিখব আয়েশা নামে।
আয়েশা? ওয়াও!! কেন কেন? আমার নাম আয়েশা দেবে কেন?
কারণ, তাতে তোমার বাস্তব জীবনটাকে কেউ খুঁজে পাবে না এবং লেখাটা হবে শিল্প। এটাই সাহিত্যের কৌশল।
এতে লাভ কি?
লাভ হচ্ছে এ যারা লেখককে ব্যক্তি হিসেবে দেখতে চায় তাদেরকে সরিয়ে রাখা সম্ভব হয়। পৃথিবীর বেশির ভাগ কবিই নারীদের যেসব অপরূপ সৌন্দর্য এঁকেছেন তাদের কবিতায়, গল্পে; ব্যক্তিজীবনে হয়তো তার নখের যোগ্যও কোনো নারীকেও তিনি কাছে পাননি। অপ্রাপ্তি বা স্বপ্নকে প্রজাপতির মতো কোমল করে, রঙধনু করে, চূড়ান্ত আকাক্সক্ষা করে আঁকা বা পরিবেশন করাই শিল্পীর কাজ।
যেন মানুষ নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, তাই তো?
ঠিক ধরেছ, মা। পাখা লাগানোর এই কাজটা নবীরাও করেন। তবে তাদের পদ্ধতি ভিন্ন।
কি রকম? যেমন ধরো বাংলাদেশ। সেখানে কি দেখতে পাও? সারাক্ষণ খুন-জখম-মারামারি। কারণ কি? আমরা কি জন্মগতভাবেই হাবিল-কাবিল? তা নয়। তবে চিন্তাহীন মানুষের মগজের পেছনে কোনো স্বপ্নের অস্তিত্ব নেই। অসীমকে ছোয়ার আকাক্সক্ষা নেই। অথচ এই জাতিই একবার বাঁশের লাঠি নিয়ে যখন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল; এবং সেটা হয়ে উঠেছিল প্রায় নবীদের কাজ। মানুষ যখন জীবনকে সঁপে দেয় মৃত্যুর পায়ে; মানে চরমতম ত্যাগস্বীকারেও পিছপা হয় না সেটা হয় ধর্ম। উল্টো দিকে যখন শুধু আমি আর আমিত্ব বড় হয়ে ওঠে তখন তার নাম হয় স্বার্থ, ভোগ আর অহঙ্কার। এটা আল্লাহও পছন্দ করে না।
কিন্তু খোদাকে তো আমরা দেখতে পাই না।
এই যে বিশাল পাহাড় তার ওপাশটা কি দেখতে পাচ্ছ?
না, তা-ও পাচ্ছি না।
সটা কি তাহলে নেই?
নিশ্চয়ই আছে।
ঠিক। আবার বলো তোমার মনকে কি তুমি দেখতে পেয়েছ কখনো?
না, তাও পাইনি।
তাহলে? দেশপ্রেম কি দেখতে পাওয়া যায়?
না।
জাতীয় সঙ্গীত আর রবীন্দ্র্রসঙ্গীত কি এক? দুটো তো একই ব্যক্তির লেখা।
সোবহানাল্লাহ। তাজিন আমার গাল টেনে ঠকাশ করে চুমু খায়।
তার মা ঘুমের মধ্যেই বলে ওঠে এত নড়াচড়া করো না তো, তাজিন! চুপ করে বসো।
আমার স্ত্রীর এই অভ্যাসের সাথে আমরা সবাই পরিচিত। সে ঘুমের মধ্যেও গৃহিণী থাকে এবং স্পষ্ট কণ্ঠে নির্দেশ দেয় এবং কখনো কখনো আমাদের প্রশ্নেরও জবাব দিতে পারে। যদিও সকালে সে এসবের কিছুই মনে করতে পারে না।
সুতরাং কয়েক মিনিট আমরা চুপ থাকলাম। গাড়ি এতক্ষণে উঠে এসেছে দ্বিতীয় আসমানে। অনেক নিচে ভেসে যাচ্ছে মেঘের সারি। কথার ফাঁকে বদলে গেছে বাইরের প্রকৃতি। শীত জেঁকে বসতে চাইছে আর সূর্য লুকোচুরি খেলছে ফার ও সাইপ্রেসের উঁচু চূড়ার সাথে।
আর কিছুদূর গেলেই বানিহাল টানেল। সেই পাহাড়ি সুড়ঙ্গ যেখানে নাজনীনকে আমি বিদায় জানিয়েছিলাম; স্বপ্নে। এই সমাপ্তিটা সৈয়দ আলী আহসানকে এতটা আপ্লুত করেছিল যে, তিনি আমার সামনেই চশমা খুলে চোখ মুছেছিলেন। হয়তো তার মনে পড়ে গিয়েছিল অন্য কোনো নাজনীনকে প্রত্যেক শিল্পীকেই যে নারীরা তাড়িয়ে বেড়ায় কখনো শিখা হয়ে, কখনো ইয়াসমীনা হয়ে যে আমাদের দিয়ে লিখিয়ে নেয় সেই সব মহাকাব্য ইতিহাসে না থাকলেও যার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে হেলেন।
***
পুলিশ চেকপোস্টের জওয়ানরা সবাই মিলিটারি। আমরা ঢাকা থেকে এসেছি শুনে তারা এতটা আশ্চর্য হলো যে, পাসপোর্ট-ভিসা ঠিক আছে দেখার পরও সবগুলো জানালা খুলতে বলল। গাড়ির বেশির ভাগ আরোহীই নারী দেখে তারা চরম আশ্চর্য হলো! আমি ভাবলাম, পেছনের ব্যাগ-সুটকেস কোনোটাই এত লম্বা নেইনি যে, রাইফেল-বন্দুক আটবে। তাহলে? ম্যালা ঝই-ঝামেলা করার পরে, ওয়্যারলেসের গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে শেষ পর্যন্ত আমাদের গাড়িকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেও তাদের চোখেমুখে ফুটে উঠল পরাজয়ের ছাপ। পুরো বিশ্বের সব সীমান্তে আমি ইমিগ্রেশন-পুলিশের চোখেমুখে একই হতাশার ছবি দেখি। মানুষের ওপর ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ না পেলেই এদের মন খারাপ হয়ে যায়। মার্কিন-ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ার চেকপোস্টে এই চিত্র প্রায় ভীতিকর রকম ভয়াবহ। সেদিকে তাজিনকে ইঙ্গিত করে বললাম, দেখেছ মা, নবীর প্রয়োজন হয় কেন?
কেন?
দেখ, এসব জওয়ানদের কেউ-ই অশিক্ষিত নয়। কেউই বর্বর নয়। কারোরই হাত রক্তমাখা নয়। তবু রক্তের জন্য, অন্যকে হেনস্তা বা অমর্যাদা করার জন্য এদের হাত নিশপিশ করে। এটাই সাধারণ মানুষের নিয়তি। বেশির ভাগ মানুষই দুনিয়ায় যত ওপরে ওঠে, আত্মাকে তত নিচে নামায়। সেই পতিত এবং ধ্বংসোন্মুখ আত্মাকে জাগাতে পারেন নবীরা। ইতিহাস অন্তত সে রকমই বলে।
তারপরও মানুষ নাস্তিক হয় কেন?
খুব কম মানুষই নাস্তিক হতে পারে, মা। আমি আমার জীবনে দু-একজন ছাড়া কোনো নাস্তিক দেখিনি। নাস্তিক হওয়া ঈমানদার হওয়ার চেয়ে কঠিন কাজ।
বুঝলাম না বাবা। তাও থাক এখন। বলা লাগবে না। তার চেয়ে বলো, আমরা কোন্ দিকে যাচ্ছি?
মনে তো হচ্ছে উত্তর দিকে। তবে পাহাড়ি পথের দিক বারবার ঘুরে যায় তো। ঠিকঠাক সূর্য না দেখে বলা যাবে না।
ওই তো সূর্য; তোমার সামনে।
আমি চমকে উঠলাম তার কথায়। কারণ গাড়ির চার পাশেই মেঘ আর কুয়াশা। তাহলে?
ভালো করে দেখো, দেখতে পাবে।
আমি আবারো সামনে তাকাই। মাথা ঘুরাই।
ততক্ষণে নাভিদ জেগে উঠেছে। তার কান আবার বোনের কথাবার্তায় খুবই সজাগ। আড় চোখে সামনে তাকিয়েই সে বলল, নিধি।
নিধি মানে? আমি আরো অবাক হয়ে বলি। নিধি মানে কি সূর্য?
নাভিদ তার পাণ্ডুরোগের বিবর্ণতা ঠেলে সগর্বে সোজা হয়। তোমার ডাক্তার নিধি। সিরিয়ালের নায়িকা। তুমি যাকে প্রায়ই প্রশংসা করো।
এতক্ষণে আমি দেখলাম।
সত্যিই তো! এই মেয়ে কি কাশ্মিরি-মেয়ে? আশ্চর্য হয়ে আমি তাজিনের দিকে চাই। সে হলো আমার ঘরের মিডিয়া-ডিকশনারি। টিভি-সিনেমা-পেপার সব তার নখদর্পণে। চালাক হাসির সাথে জবাব দিলো সে বলতে পারি, যদি একরাত হাউজবোটে থাকতে রাজি হও। এগ্রিড?
নিতান্ত নিরুপায় হয়ে বললাম ওকে, এগ্রিড। এবার পেটের বস্তা খোলো তো!
ঠিক আছে, খুলছি। ডাক্তার নিধি কাশ্মিরের মেয়ে নয়, বাবা। জম্মুরও না। তার জন্ম উত্তর প্রদেশে। তবে সে তার সৌন্দর্য পেয়েছে পাঞ্জাব থেকে, কারণ সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। তোমার রুচি বেশ ভালো, বাবা; যদিও একটু মোটা সে।
তাতে কি হয়েছে? আমি ক্ষেপে উঠি আরো কিছু বল।
না না, আমার ঘুম পাচ্ছে। আর নাভিদও উঠে গেছে। তুমি ওর কাছে শোনো।
নাভিদও তাহলে টিভির পোকা! আমি আশ্চর্য হয়ে ছেলের দিকে ফিরি। না-বাবা, আপু তোমাকে আরো খসাবে বলে ও রকম করছে। কেবল হাউজবোট নিয়েছে তো; এরপর সালোয়ার-কামিজও নেবে। তোমার সেই কিছু নো কেনার শর্ত টিকবে না এবার। ওর নাম আয়েশা মাশরুবা।
রাইট, মাই ব্রাদার। তাজিন জানালা দিয়ে তাকিয়ে এমনভাবে উত্তর দিলো যেন ক্লিওপেট্রা হারিয়ে দিয়েছে সিজারকে। আমি রেগে গিয়ে বলি, তবুও কিছু বলবি না? আমি শুনতে চাইলাম না?
আচ্ছা শোনো, ওর আসল নাম কৃতিকা। কৃতিকা কামরা। নাহ্, আর বলা যাচ্ছে না।
কেন বলা যাচ্ছে না?
আমি কি কিছু দেবো না বলেছি?
তাহলে প্রমিজ করো, ঈদের আগে-পরের দু’রাত আমাদেরকে হাউজবোটে রাখবে?
আচ্ছা, প্রমিজ-প্রমিজ-প্রমিজ।
থাক, বাবা। তুমি রেগে যাচ্ছ। কোনো প্রমিজ ছাড়াই তোমায় জানাচ্ছি।
***
বানিহাল টানেলেরই আরেক নাম নেহেরু টানেল। দুটো পাশাপাশি সুড়ঙ্গ দিয়ে গাড়ি ওপাড়ে পৌঁছলেই কাশ্মির। যে কাশ্মিরে ঝিলাম আছে, চিনার আছে, ডাল এবং নাগিন আছে। আছে চেশমা-শাহী, শালিমারবাগ, হযরতবাল। আছে জনসংখ্যার দ্বিগুণ মিলিটারি আর নাজনীন। ভাবতে ভাবতে আমার চোখ পানিতে ভরে গেল। স্বাধীনতার জন্য মানুষকে কত না আত্মত্যাগ করতে হয়। দিতে হয় কত কোরবানি আর রক্তের নৈবেদ্য। তারপরও কি মানুষের মুক্তি আসে! আমাদের আত্মা কি তৃপ্ত হয় শুধু পতাকা আর জাতীয় সঙ্গীতেই যদি তার সাথে জয়ী না হয় সচ্ছলতা আর মনুষ্যত্ব! পৃথিবীর ক’টা দেশের মানুষ অধিকার পেয়েছে সত্য বলার? ক’টা দেশের সরকার মানুষকে অন্ন-বস্ত্র-খাদ্য-আশ্রয়ের নিরাপত্তা দিয়েছে সর্বজনীন অধিকারে? কোথায় আছে সেই মুক্তি যা দেহের সাথে আত্মাকেও হাত মেলানোর সুযোগ দেয়? পৌর কিছু সুযোগ-সুবিধা আর চটকদারি-দাসত্বের নামই কি তাহলে শৃঙ্খলমুক্তি? যুদ্ধ তাহলে বারবার ফিরে আসে কেন? কেন পুরো-সিকিম অস্তিত্ব হারায় একজন লেন্দুপ দর্জির ষড়যন্ত্রে? কেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হতে চান আমেরিকার সিটিজেন? আর কেনই বা নাজনীনরা হারিয়ে যায় স্বাধীন দেশের চিহ্নহীন গণকবরে?
***
সারাটা পথ আমি চোখ খুলে রেখেছি। পুরো দুনিয়ার মানুষ তো চোখ খুলেই জীবনযাপন করে। তবু এই টানেলে যেমন আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না; বেশির ভাগ মানুষই দুনিয়ার প্রায় কিছুই দেখতে পায় না। না সত্য, না আলো।
যুক্তিহীন নৈরাজ্যে আমি দ্রবীভূত হতে থাকলাম। বিশাল পাহাড়ের অতল-অন্ধকারের মতো আমার চার পাশে যেন মৃত্যুর শীতলতা। শ^াস-রোগীর মতো হাঁপাচ্ছি দু’ঝলক পরিষ্কার বাতাসের জন্য। আমি যেন আইসিইউ’র সেই রোগী, যে অপেক্ষা করছে মৃত্যুর। নাকি, বাঁচানোর নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছেন ডাক্তাররা কিন্তু আমিই টের পাচ্ছি না!
তবুও তো ছুটছি। ছুটছি আমার সত্তাকে জাগরুক রেখে; আত্মা শান্তি পাবে বলে। ছুটছি সেই প্রিয়তমার দিকে, যার ঠিকানা আমি জানি না।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ৭:১১
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

'অপ্রেমের মৃত্যু' - ব্লগার আলমগীর সরকার লিটনের এক দারুণ সৃষ্টি

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ০৬ ই মে, ২০২৫ রাত ৮:৫৮



চর্ম চোখ আমাদের অনেক কিছু দেখায়। আমরা তা বুঝার চেষ্টা করি। কোন কোনটাকে সত্যি বলে মেনে নেই। কখনো কি নিজেকে প্রশ্ন করেছি, আমরা যাকে সত্য বলে মেনে নেই,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামীর তরুণ রাষ্ট্র নায়কদের জন্য ড. ইউনূস হতে পারেন অনুকরণীয় আদর্শ !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৬ ই মে, ২০২৫ রাত ৯:৪০


আগামীর বাংলাদেশে আমরা কি করাপ্টেড অথবা বাবার উত্তরাধিকারী কাউকে রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে ক্ষমতায় দেখতে চাই ? অবশ্যই না ! বাংলাদেশের তরুণেরা চায় ভবিষ্যতের রাষ্ট্রনায়ক হবে ইয়ং এবং ডায়নামিক চরিত্রের অধিকারী। সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Natural Justice.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৬ ই মে, ২০২৫ রাত ১০:০৯

Natural Justice.....

Natural Justice বা প্রকৃতির বিচার কিম্বা রিভেঞ্জ অব ন্যাচার বলে যে একটা কথা আছে, সেই ব্যাপারটা গভীরভাবে অনুধাবন করার একটা বাস্তব উদাহরণ আশা করি সবার সামনেই এখন ভিজিবল।

আমরা অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ড. ইউনূসের মতো বোকা হওয়া শিখতে হবে! | দৈনিক কালবেলা উপসম্পাদকীয়

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ০৬ ই মে, ২০২৫ রাত ১০:৫৭



আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সারা জীবন উল্টো কাজ করে সাফল্য পেয়েছেন। কনভেনশনাল ব্যাংকগুলো ধনী ব্যক্তিদের ঋণ দেয়, অথচ তার গ্রামীণ ব্যাংক দরিদ্রদের মধ্যে ঋণ বিতরণ করে। বাংলাদেশের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মধ্যরাতে পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে হামলা চালাল ভারত

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৭ ই মে, ২০২৫ রাত ৩:৫২


পাকিস্তানের বাহাওয়ালপুর, কোটলি ও মুজাফফরাবাদের পাহাড়ি অঞ্চলের কাছে একাধিক জায়গায় হামলা চালিয়েছে ভারত। এ হামলায় এক শিশু নিহত ও ১২ জন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।

ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী এক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×