আমার জন্ম পুরান ঢাকার একটি কাপড়ের কারখানায় । জন্মের পর থেকে মা-বাবা কি জিনিস তা বুঝি না । তবে ভাই-বোন ব্যাপারটা বুঝি । আমার সাথে আমার মত দেখতে আরও অনেক রঙ-বেরঙের কাপড় তৈরি করেছিল ওরা । এরাই আমার বন্ধু-বান্ধব । এরাই আমার ভাই-বোন । তবে প্রথম দিনের কথা মনে পড়লে আমার এখনও হাসি পায় খুব । ঐ কারখানার লোকেরা একজন আরেকজনের হাতে আমাদের দিতে গিয়ে বলে, এই ওড়নাগুলোর ডেলিভারি কবে ? "ওড়না" । কি নাম দিলো ওরা আমাদের সবার ? শুনেই আমরা সকলেই হেসেছিলাম । কেমন জানি, উড়তে অনুরোধ করছে যেন ওরা । আচ্ছা, এভাবে আমাদের বেঁধে রেখে আমাদের উড়তে অনুরোধ করে লি লাভ ?
প্রথম যখন আমাকে আরেকজনের হাতে দেয়া হয়, মানে ওদের ভাষায় যেটি ডেলিভারি সেটা করলো বিক্রমপুরের ব্যবসায়ী জব্বার আলীর কাছে । সবাই তাকে সেট বলে ডাকতো । তাই তাদের দেখাদেখি আমিও সেট বলে ডাকা শুরু করি তাকে ।
আমার সেই সেট অনেক দয়ালু ছিল । সব ওড়না থেকে আমাকে প্রাধান্য দিয়ে আমাকে একেবারে দোকানের সামনে এনে সাজিয়ে রাখে । আমার গায়ের রঙ ছিল লাল আর সবুজের মিশ্রণ । লাল রঙ-টাকে কেমন জানি আমার অনেক ভালো লেগে গিয়েছিল, কারণ আমার প্রিয় বান্ধবীর পুরো গায়ের রঙটাই লাল । তবে দুঃখ এটাই ও আমার সাথে এখানে আসিনি । না জানি, কোথায় গিয়েছে । আর জীবনেও আমাদের দেখা হবে কিনা ।
আমাকে সেট যার কাছে বিক্রি করে, সেই লোকটি আমাকে দেখেই এক ঝলকে পছন্দ করে ফেলে । এমনকি আমাকে দেখার পর আর একটাও ওড়না দেখেও না সে । আমার দাম নাকি ৮৫০ টাকা । কে জানে, এই টাকার পরিমাণ অনেক বেশি নাকি কম । আমার কোন ধারণা নেই । লোকটির মুখে আমি এত খুশি দেখেছিলাম যে আমার জীবনে আর কারও মুখে আমাকে দেখে এত খুশি দেখি নাই । লোকটি আমাকে তার বাসায় নিয়ে গেল আমাকে । এতক্ষণে বুঝলাম, আজ লোকটির মেয়ের জন্মদিন । মেয়েটির নাম রিনি । মেয়েটি নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে । বাড়িভর্তি লোকজনের সামনেই লোকটি তার মেয়েকে গিফট করলো আমাকে । আমাকে পেয়ে মেয়েটির খুশি যেন উপচে পড়ছিল । সবার সামনেই নিজের গায়ের আগের ওড়নাটি সরিয়ে আমাকে গলায় পেচায় মেয়েটি । মেয়েটি পরীর মত সুন্দর । আর আমাকে যখন গলায় পেচাল, দেখলাম সবাই ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে । আমার মনে হল, ঐটাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন ।
মেয়েটি পরেরদিনই আমাকে পরে ক্যাম্পাসে গেল । ক্যাম্পাসের সকলেই আমার প্রশংসা করলো । এত সুন্দর মেয়ে অথচ কোন বয়ফ্রেন্ড নেই মেয়েটির । তাই তো আমার জন্য মেয়েটির বাড়তি সময় ছিল । একটু একটু পর আমাকে ধরে মেয়েটি যেন আমাকেও ধন্য করছিল । কিন্তু সমস্যা ছিল অন্যখানে, মেয়েটি দেখতে না পেলেও, পিছন থেকে আমি দেখছিলাম ঐ ক্যাম্পাসেরই কিছু উচ্ছৃঙ্খল ছেলে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে শিস দিচ্ছে । তাদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে, মেয়েটিকে পেলে যেন গোগ্রাসে খেয়ে ফেলবে তারা ।
আজ প্রায় এক মাসের কাছাকাছি রিনি নামক মেয়েটির কাছে আছি আমি । মেয়েটি আমাকে খুবই যত্ন করে । আমাকেই সব ওড়নার থেকে বেশি প্রাধান্য দেয় । কোন বিশেষ অনুষ্ঠানে আমাকে পরে যায় । একদিন বান্ধবীর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণে গেল মেয়েটি সন্ধ্যার দিকে । জন্মদিনের অনুষ্ঠানেও সবাই আমার প্রশংসা করলো । জন্মদিনের অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে বেশ রাত হয়ে গেল । এখন মেয়েটি বাড়ি ফেরার জন্য অটোরিকশার অপেক্ষা করতে লাগলো রাস্তায় দাড়িয়ে । কিন্তু রাস্তাটি কেন জানি জনশূন্য । হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, কোথা থেকে একটি মাইক্রোবাস এসে মেয়েটিকে উঠিয়ে নিলো । মেয়েটির চিৎকার শুনার মতও কেউ রাস্তায় নেই । মেয়েটিকে উঠিয়েই মাইক্রো টি ছেড়ে দিল । এরা ঐ ছেলেগুলো, যাদের আমি সেদিন মেয়েটির ক্যাম্পাসে দেখেছিলাম ।
এরপর ওরা আমাকে মেয়েটির গলা থেকে খুলে মাইক্রোর শেষ কোণায় চেলে মারে । এরপর যা হল, আমি আর দেখতে পাইনি । শুধু মেয়েটির চিৎকার শুনেছি । সূক্ষ্ম চিৎকার আর আর্তনাদ । আর কতগুলো পশুর পাশবিক হাসির শব্দ । এরপর অনেক অনেকক্ষণ পর আমাকে সহ মেয়েটিকে রাস্তায় ফেলে রেখে হায়নাগুলো চলে যায় । রাস্তায় পরে থাকা মেয়েটিকে দেখে রাস্তার কোন লোকজনই এগিয়ে আসিনি আর । মেয়েটি অনেক কষ্ট করে আমাকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছায় । এতক্ষণ চিন্তাগ্রস্থ বাড়ির লোকগুলোকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আহত মেয়েটি আমাকে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয় । ওদিকে বাড়ির লোকজন সকলেই যে দরজার কাছে এসে জড় হয়েছে, তা স্পষ্ট ।
এখন আমি ঝুলে আছি ঘরের এই সিলিং ফ্যানটির সাথে । আর আমার আরেক কোণায় ঝুলছে রিনির শরীর । হ্যাঁ, এই সেই রিনি । পরীর মতও দেখতে মেয়েটি আর সহ্য করতে পারেনি কিছুই । এই দুনিয়া তাকে সহ্য করার ক্ষমতা দেয়নি আর । তাই তো আজ সে প্রাণহীন । আমি আর কারও গলায় ঝুলতে চাই না । যদি পারতাম, আজ আমিও নিজেকে শেষ করে দিতাম রিনির মত করে । কিন্তু এই জগতে অনেকেই বেঁচে থাকে শুধু কষ্টগুলোকে দেখার জন্য । তারা না পারে মরতে আর না পারে বাঁচতে ।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ২:৩৯