: আফ্রিকা মহাদেশের প্রভাবশালী দেশ মিশরে প্রতিনিয়ত রক্ত ঝরছে। স্বৈরশাসক জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ সিসি পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষে সুপরিকল্পিভাবে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে নিজেই প্রেসিডেন্টে পদে অধিষ্ঠিত হন। এরপর থেকে বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার ও নিপীড়ন শুরু হয়।
মিশরের আয়তন ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৪৮ বর্গমাইল। জনসংখ্যা ৮ কোটি। মাথাপিচু আয় ২৪৫০ ডলার। ১৯২২ সালে মিশর স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৫২ সালে জামাল আবদুন নাসেরের নেতৃত্বে একদল সামরিক অফিসার রাজতন্ত্র উৎখাত করে প্রজাতন্ত্র হিসেবে মিশর প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৬ সালের মধ্যে মিশর থেকে সকল ব্রিটিশ সেনা প্রত্যাহার করা হয়। ১৯৭৯ সালে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের নেতৃত্বে ইসরাইলের সঙ্গে ক্যাম্প-ডেভিড চুক্তি হয়।
প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত একটি সামরিক কুচকাওয়াজে সালাম গ্রহণকালে বিদ্রোহী সেনার গুলিতে নিহত হবার পর হোসনি মুবারক প্রেসিডেন্ট পদে অসীন হন। দীর্ঘ ত্রিশ বছর দেশ শাসন করেন হোসনি মুবারক। তিনি বিরোধীদের ওপর দমন নিপীড়নসহ এবং সীমাহীন দুর্নীতিতে জড়িয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করে। তার দুই পুত্র সন্তান রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটসহ পিতার ন্যায় স্বৈরাচারী ভূমিকা পালন করেন। এসময় হোসনি মুবারক ও তার আত্মীয়-স্বজন শত শত কোটি ডলার লুটপাট করে দেশকে চরম সংকটে ঠেলে দেয়। অভিযোগ রয়েছে, ইসরাইলের সঙ্গে হোসনি মুবারকের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। তার শাসনামলে অর্থাৎ ত্রিশ বছর ইসরাইলকে বিশেষ সুবিধায় গ্যাস সরবরাহ করে মিশর। এতে মিশরের ৬০ হাজার কোটি ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচারিত হয়।
আফ্রিকার দেশ তিউনিশিয়ার স্বৈরশাসক বেন আলী’র বিরুদ্ধে শুরু হওয়া “অরেঞ্জ বিপ্লব” আফ্রিকা ও মধপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক সাপ্তাহ পর মিশরের স্বৈশাসক হোসনি মুবারকের বিরুদ্ধে মিশরের জনতা রাস্তায় নেমে পড়ে। এসময় নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে শত শত জনতা হতাহত হয়। এক পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ জনতার দুর্বার প্রতিরোধের ফসল হিসেবে ২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি হোসনি মুবারক সরকারের পতন ঘটে এবং হোসনি মুবারক ও তার দুই পুত্র গ্রেফতার হন।
মুবারক সরকারের পতনের পর দেশে গনতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ড. মুহাম্মদ মুরসির নেতৃত্বে মিশরে নির্বাচিত প্রথম গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য, ১৯২৮ সালে মিশরের হাসানুল বান্নার নেতৃত্বে ইখওয়ানুল মুসলেমিন গঠিত হয়। ইখওয়ানুল মুসলেমিনের আরেকটি বৃহৎ সহযোগী সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুড আফ্রিকা মহাদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন হিসেবে পরিচিত। ২০১২ সালে ইখওয়ান মুসলেমিন এর নেতা ড. মুরসি মিশরের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। প্রথম থেকে নির্বাচিত নতুন সরকারের পথ মসৃন ছিল না। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে ওঁৎ পেতে থাকা ক্ষমতাচুত প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের সমর্থকদের তীব্র বিরোধিতা উপেক্ষা করে বেশ কয়েকটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বিশেষ করে সিভিল প্রশাসন ও প্রতিরক্ষা বাহিনীতে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার লক্ষে কাজ করতে গিয়ে দেশীয় এজেন্টদের বিরাগভাজন হন। এরপর শুরু হয় নানাবিধ ষড়যন্ত্র।
যে দু’টি কারণে ষড়যন্ত্র পরিচালিত হয়
মিশরে প্রথম নির্বাচিত রাজনৈতিক দল ইখওয়ান মুসলেমিন সরকার গঠনের পর শুরু হয় আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ কয়েকটি বিষয়টি সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। বিশেষ করে মিশরে সংঘটিত বিপ্লব মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ার আশংকায় চরম ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছিল রাজ পরিবারে। মধ্যপ্রাচ্যে থেকে রাজতন্ত্র উৎখাত আতঙ্কে রাজা বাদশারা দিশেহারা। অপরদিকে আমেরিকাসহ পশ্চিমাদের কাছে সোনার ডিম হিসেবে খ্যাত ইসরাইলের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টির আশংকায় পশ্চিমাদের উৎকন্ঠা বৃদ্ধি পায়। মিশরের স্বৈরশাসক হোসনি মুবারকের সঙ্গে ইসরাইলের দহরম-মহরম সবার জানা। এতদিন ইসরাইল তার পরীক্ষিত বন্ধু হোসনি মুবারকের মাধ্যমে রাজা-বাদশাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে আসছিল। কিন্তু বাধ সাজে মিশরের ইখওয়ানুল মুসলেমিন সরকার। ফলে দুই শক্তি জোটবদ্ধ হয়ে ড. মুরসি সরকার উৎখাতে ষড়যন্ত্র শুরু করে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মিডিয়ার বদৌলতে জানা গেছে, সৌদি সরকারের অর্থায়নে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীকে নিজেদের বশে আনার জন্য ড. মুরসি সরকার বিরোধী গ্রুপ সৃষ্টি করা হয়। একাজে সৌদি আরব তৎকালীন সেনা প্রধান ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ সিসিকে কয়েক মিলিয়ন ডলার প্রদান করে। জেনারেল সিসি সৌদি আরবের বিস্বস্ত অনুচর হিসেবে অর্থ ভাগাভাগির মাধ্যমে এ ধরনের কঠিন দায়িত্ব সম্পন্ন করেন। এরপর শুরু হয় ষড়যন্ত বাস্তবায়নের পালা। এসময় কয়েকটি মিথ্যা ইস্যু দাঁড় করিয়ে সরকারের কাজে হস্তক্ষেপ করে দেশটির সেনাবাহিনী। তখন পশ্চিমা মিডিয়াগুলো মিশরের নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগে যায়। অবশেষে যা হবার তাই হয়েছে। ড. মুরসিসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ করা হয়। সরকার উৎখাতের সময় কয়েক হাজার শান্তিকামী জনতাকে হতাহত করা ছাড়াও বিরোধীদলের কয়েক হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেফতারের মাধ্যমে সীমাহীন নির্যাতন চালানো হয়।
সৌদি ও পশ্চিমাদের রোডম্যাপ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ঘটনার প্রধান নায়ক জেনারেল সিসি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন। এসময় সৌদি আরবসহ পশ্চিমারা জেনারেল সিসিকে শত শত কোটি ডলার ও বিনামূল্যে লাখ লাখ ব্যারেল তেল সরবরাহের নিশ্চয়তা প্রদান করেন। তৎকালীন সৌদি বাদশার সাথে জেনারেল সিসি’র মুখোমুখি সাক্ষাতের সময় জেনারেল সিসি একপর্যায়ে সৌদি বাদশাকে কদমবুসি করে তার আনুগত্য প্রকাশ করেন। বিনিময়ে সৌদি বাদশা তার বিস্বস্ত গোলামকে বুকে টেনে নিয়ে তার মুখে চুমু দেন। এটাই হচ্ছে প্রকৃত মোনাফিকের তাৎক্ষণিক লেনদেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী জেনারেল সিসি মিশরে প্রহসনমূলক নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। এতে তিনি নিজেই প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী। নির্বাচনে তার বিরুদ্ধবাদী কেউ যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারে সেজন্য আবারো বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। অবশেষে সাজানো একতরফা নির্বাচনে জেনারেল সিসি’কে বিপূল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। নির্বাচনে বিজয়ী হবার পর সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইসরাইল, আমেরিকাসহ কয়েকটি দেশ জেনারেল সিসি’কে অভিনন্দন জানিয়ে, মিশরের সিসি সরকারের সর্বাত্মক প্রদানের আশ্বাস দেন। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের পর সৌদি আরবের সাথে যোগাযোগ আরো বৃদ্ধি পায়। সিসি একাধিকবার সৌদি আরব সফল করেন। দেশে ফিরে তিনি সাংবাদিকদের জানান, তার সফল ফলপ্রসু হয়েছে। জেনারেল সিসি ক্ষমতা গ্রহণের পর ঐসব দেশে স্বস্তি ফিরে আসে। অর্থাৎ জেনারেল সিসি সরকারের বদৌলতে এখন মধ্যপ্রাচ্যের রাজ পরিবার ও ইসরাইল অনেকটা আশংকামুক্ত। মিশরে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার উৎখাতের ঘটনাটি যুগ যুগ ধরে বিশ্বের শান্তিকামী জনগণ স্বরণ রাখবে।