somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন সেক্টর কমান্ডারের স্মৃতিকথা (কর্নেল কাজী নূর-উজ্জামান)

১৪ ই অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ৮:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রাতের আঁধার কাটেনি তখনো, ভোর হবে একটু পরেই। অন্ধকারের আড়ালে সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে চলছে কিছু মানুষ। রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকার এবং আশে পাশের প্রকৃতির সাথে যেন মিশে যেতে চাইছে তারা। প্রথমে আছে ছোট একটি স্কাউট দল, যাদের কাজ পেছনের থাকা ষাট জনের দলকে পথ দেখানো এবং সম্মুখের বিপদ থেকে সতর্ক রাখা। আর পেছনেই আছে মূল
দল এক লাইনে। দূর থেকে দেখলে যেন মনে হবে যেন ছোট একটি বিন্দু, একটি মানুষই। সামনেই সীমান্ত, আক্রমণের লক্ষ্যে নিঃশব্দে পেরুতে হবে তা।
খানিকটা দূর দিয়েও ঠিক একইভাবে এগিয়ে চলছে দ্বিতীয় আরেকটি দল, তাদের দলেও সদস্য সংখ্যা ষাট। এরা সবাই ৭নং সেক্টরের অধীনে, তপন সাব-সেক্টরের যোদ্ধা। ক'দিন আগে হারিয়েছে অধিনায়ক মেজর নাজমুল হক কে। বদলী অফিসার না আসা পর্যন্ত এক ভারতীয় ক্যাপ্টেন রাজভীই দিচ্ছেন তাদের যুদ্ধ চালাবার দিক নির্দেশনা। দু'ভাগে ভাগ হওয়া ১২০ জনের এই মুক্তিযোদ্ধারা যাচ্ছেন নওগাঁ জেলার পত্নীতলা থানার পাকবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি আক্রমণে। বহুদিন ধরেই চলছিলো এই আক্রমণের প্রস্তুতি এবং পরিকল্পনা। স্বয়ং সেক্টর কমান্ডার কাজী নূর-উজ্জামান নির্দেশ দেন এই আক্রমণের।
নির্ধারিত দিনে তিনি তরঙ্গপুর থেকে তপনে আসেন এই আক্রমণ কাছ থেকে পরিচালনার জন্য। কিন্তু তিনি এসেই শুনতে পান অন্ধকার থাকতেই এগিয়ে গেছে তার ছেলেরা।
কিন্তু হঠাত সীমান্তের দিক থেকে ভেসে আসে তীব্র গোলাগুলির শব্দ। সচকিত হন নূর-উজ্জামান। চিন্তার রেখা পড়ে তার কপালে, কারণ টার্গেট থেকে দূরে থাকতেই সীমান্তে পেরুতে তার দল গোলাগুলিতে জড়িয়ে পরার কথা নয়। থেমে থেমে গুলির শব্দ বেড়েই চলছে।
দুরুদুরু বুকে যা আশঙ্কা করছিলেন তাই হল, পত্নীতলার দিক থেকে আসছে একে একে আহতের দল, কারো হাত নেই, নেই কারো পা। অনেকের আবার পেটে গুলি লাগবার পর গলগল করে বেরিয়ে আসছে রক্ত। ইদ্রিস নাম এক গুপ্তচর থেকে খবর পেয়ে পাকবাহিনী আগেই জেনে যায় মুক্তিবাহিনীর এই দলটির সীমান্ত অতিক্রমের খবর।
আর তাই আগে থেকেই ওঁত পেতে ছিল তাদের জন্য। যেই আমাদের যোদ্ধারা পা দেয় তাদের ফাঁদে তক্ষুনি শুরু হয় আক্রমণ, আর অপ্রস্তুত এবং স্বল্প প্রশিক্ষিত এই যোদ্ধরা তাদের দলে থাকা এক বিশ্বাসঘাতকের কারণে মাসুল দিতে থাকে রক্ত দিয়ে। কোন রকমে এই অতর্কিত আক্রমণ থেকে সাহসিকতার সাথে লড়ে যখন তারা ফিরে আসে পিছিয়ে, পুরো দলের অবস্থা তখন অত্যন্ত সঙ্গিন। আহত অনেক, নিহতও কম নয়।
এদিকে সাথে থাকা ফার্স্ট এইড ফুরিয়েছে বহু আগেই। আহতদের পানি,পানি আর্ত চীৎকারে ভারী আকাশ। চাই পানি, চাই চিকিৎসা, চাই আশ্রয়। নূর-উজ্জামান তার জীপটি ভারতের ভেতরে পাঠালেন ঔষধের জন্য। ঠিক তখনই অল্প দূরে থাকা কিছু কুঁড়ে ঘর থেকে এগিয়ে এলেন এক মধ্য বয়স্ক ব্যক্তি। দারিদ্রের ছাপ প্রকট চলনে, চেহারায় ফুটে উঠেছে দীর্ঘ দিনের অনাহারে থাকার ছাপ। কাছে এসে তিনি একটি কলসি রাখলেন নূর-উজ্জামানের পায়ের কাছে, ভেতরে জল।
বললেন, "বাবু, এই জলটি ভাল। বহুদূরের এক টিউবওয়েল থেকে এই জল এনেছি আমি পরিবারের জন্য।" অভিভূত হলেন নূর-উজ্জামান। আর আহতরা যেন পানি পেয়ে ফিরে পেল নতুন জীবন। সেই সাথে পানি দিয়ে চলল ক্ষত পরিষ্কারও। তাকে ধন্যবাদ জানালেন নূর-উজ্জামান।
কিন্তু একটু পর আবার ফিরে এলো সেই ব্যক্তি। এবার হাতে একটি শাড়ী। কাছে এসে বললেন, বাবু এই শাড়ীটি ধোপা বাড়ী থেকে ধোওয়া, একটাই ভাল শাড়ী আমার স্ত্রীর। স্ত্রী ছেঁড়া ফাটা একটি শাড়ী দিয়ে কোন রকমে লজ্জা নিবারণ করলেও তিনি এটি তুলে রেখেছিলেন ভাল কোন উপলক্ষের জন্য।
কিন্তু পানি দিতে এসে যেই দেখলেন আমাদের ছেলেদের ব্যান্ডেজটি পর্যন্ত নেই ক্ষত বাঁধবার জন্য তখনই এই একমাত্র ভাল শাড়ীটিই তিনি নিয়ে আসেন আমাদের যোদ্ধাদের জন্য। বলেন, "বাবু শাড়ীটি পরিষ্কার। এটি যদি ব্যান্ডেজের কাজ দেয় এবং আপনারা ব্যবহার করেন তবে আমরা খুশী হবো অত্যন্ত।" সাথে দিয়ে গেলেন পরিবারের জন্য জমিয়ে রক্ষা অন্ন ডজন খানেক কলা। দাম দিতে চাইলে সেই মধ্য বয়স্ক ব্যক্তিটি বলেন, "বাবু, দূর থেকে দেখেছি আপনার চীৎকার, আর্তনাদ। ভাবছিলাম কিই বা তেমন সাহায্য করতে পারবো, এই জল, শাড়ী ছাড়া তো নেই কিছুই। তাই নিয়ে এলাম। আমাদের হৃদয়ও কি কাঁদে না?"
আহ! কি মায়া, কি মমতা, কি প্রেম। এই মধ্যবয়স্ক ব্যক্তির পরিবারের মত এভাবেই দেশবাসী নিজের খাবার, নিজের মুখের পানি তুলে দিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। তাই সেদিনের সেই অপারেশনে ব্যর্থ হয়েও তাই কর্নেল কাজী-নূরউজ্জামান বুঝতে পারলেন, যুদ্ধের প্রকৃত সফলতা নির্ভর করে মানুষের সমর্থনেই, অস্ত্রতো শুধু উপলক্ষ মাত্র। সেদিন গণ মানুষের ভালবাসার যে প্রতিভূ তিনি দেখেছিলেন সেই অনুপ্রেরণায় পরবর্তীতে নিয়ামক হয়েছিল আমাদের বহু যুদ্ধ বিজয়েই।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ৮:১৫
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সেকালের গ্রামের বিয়ের বর দেখা

লিখেছেন প্রামানিক, ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:১৩


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

একদিন পরেই শুক্রবার। সকালেই বাবাকে ঐ বাড়ির ঘরবর (অর্থাৎ বর দেখা অনুষ্ঠানকে আঞ্চলিক ভাষায় ঘরবর বলে) উপলক্ষে ডাকা হয়েছে। বাবা সকালে গিয়ে বর দেখা উপলক্ষ্যে কি কি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ওবায়েদুল কাদের কি মির্জা ফখরুলের বাসায় আছেন?

লিখেছেন রাজীব, ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৮

"পালাবো না, পালিয়ে কোথায় যাবো? দরকার হলে মির্জা ফখরুলের বাসায় আশ্রয় নেবো। কি ফখরুল সাহেব, আশ্রয় দেবেন না?" ওবায়েদুল কাদের একটি জনসভায় এই কথাগুলো বলেছিলেন। ৫ই আগষ্টের পরে উনি মির্জা... ...বাকিটুকু পড়ুন

যোগ্য কে???

লিখেছেন জটিল ভাই, ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:৪১

♦أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشِّيْطَانِ الرَّجِيْمِ (বিতাড়িত শয়তান থেকে আল্লাহ্'র নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি)
♦بِسْمِ ٱللَّٰهِ ٱلرَّحْمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ (পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ্'র নামে)
♦ٱلسَّلَامُ عَلَيْكُمْ (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক)




(সকল... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণতান্ত্রিকভাবে লীগকে ক্ষমতার বাহিরে রাখা যাবে আজীবন।

লিখেছেন শাহিন-৯৯, ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:১৩



লীগ সদ্য বিতাড়িত কিন্তু তাদের সাংগঠিক কাঠামো এখনো পূর্বের মতই শক্তিশালী শুধু ছোবল দিতে পারছে না, স্থানীয় নেতারা বিএনপির নেতাদের বড় অংকের টাকার বিনিময়ে ইতিমধ্যে এলাকায় প্রবেশ করছে তবে মুখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরিয়ে ফেললেন মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৪১


মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী লম্বা রেইসের ঘোড়া মনে হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া হতে বেডরুমে যার নিয়োগ নিয়ে অস্বস্তি আছে তিনি খুব দ্রুত শিখে গেলেন কিভাবে মানুষের মাথা ঠান্ডা করতে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×