উনিশশো পঞ্চাশের দশকে মিলার উরি পরীক্ষার ফল প্রকশিত হওয়ার পর থেকে বিজ্ঞানী সমাজ থেকে ঈশ্বর এবং তথাকথিত “জীবনী শক্তি”র ধারনা ক্রমশঃ লোপ পেতে থাকে। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে যৌগিক পদার্থসমুহের স্বয়ংক্রিয় রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে প্রানের উৎপত্তি। বিজ্ঞানীরা ক্রমশঃ প্রান রসায়নের জটিল যৌগিক পদার্থগুলো রস্যানাগারে তৈরী করতে সক্ষম হন। এ গুলোর মধ্যে ছিল প্রোটিন, ফ্যাট, পলিস্যাকারাইড, Deoxy riboncleic acid (DNA) , Riboncleic acid (RNA) ইত্যাদি। বিজ্ঞানীরা প্রমান করে দেখান যে সুগার বা এমাইনো এসিডকে একটার সাথে আরেকটা জোড়া দিয়ে পলিমারাইজেশান(Polymerisation) 'র মাধ্যমে বড় আকারের অনু যেমন- প্রোটিন বা স্টার্চ তৈরী করা সম্ভব। ১৯৫২ সালে বিজ্ঞানী সিডনী ফক্স পরীক্ষাগারে পৃথিবীর আদিম পরিবেশে একটার সাথে আরেকটা এমাইনো এসিড জুড়ে দিয়ে এমাইনো এসিডের পলিমার তৈরী করে নাম দেন প্রোটিনয়েড। বিজ্ঞানীরা প্রোটিনকে জীবনের মূল উপাদান হিসেবে ভাবতে শুরু করেন ,কারন কোষের মূল গঠন প্রোটিন দিয়ে এবং সমস্ত পাচন প্রক্রিয়ার জন্য প্রোটিন অপরিহার্য্য।
পঞ্চাশের দশকে জীন (Gene) নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়। প্রোটিনের জটিল গঠনাকৃতির কারনে অনেক বিজ্ঞানী প্রোটিনকে “জিন” হিসেবে ভাবতে শুরু করেন। কিন্তু ১৯৫২ সালে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী Alfred Hershey এবং Martha Chase যখন দেখালেন যে প্রোটিন এবং ডি,এন,এ বা Deoxy riboncleic acid (DNA)আলাদা জিনিস এবং ডিএনএ'ই হল জীন, তখন বিজ্ঞানী মহলে প্রচন্ড ঝড় বয়ে যায়। বিজ্ঞানী Alfred Hershey এবং Martha Chase তাদের পরীক্ষায় দেখান যে একটি ভাইরাসের কোষে থাকা শুধুমাত্র ডিএনএ অংশ অন্য কোষে প্রবেশ করে কিন্তু অন্যন্য প্রোটিন বাইরে থেকে যায়। ভাইরাসের ডি,এন,এ অন্য কোষে প্রবেশের পর ভাইরাসের ডি,এন,এ কোষের পাচন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রন করতে থাকে এবং আরো ভাইরাস তৈরী করতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ ডি,এন,এ ই হল বংশানুক্রমিক তথ্য বহনকারী অনু এবং জীন হল Deoxy riboncleic acid (DNA) দিয়ে তৈরী ক্রোমোজোমের অংশ যা কোন একটি নির্দিস্ট গুনাবলী এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে বয়ে নিয়ে যায়, ।
এরপর ডি,এন,এ'এর গঠন প্রকৃতি জানার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন বিজ্ঞানীরা। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫৩ সালে কেম্ব্রিজের বিজ্ঞানী Francis Crick, James Watson, এবং Rosalind Franklin ডি,এন,এ,র গঠন এবং প্রকৃতি আবিস্কার করেন। তারা দেখান যে ডি,এন,এ'র গঠন হল মইএর মত যা নিজের চারদিকে পেঁচিয়ে থাকে কুন্ডলী আকারে। মই এর লম্বা লাঠির মত প্রান্ত হল ডি-অক্সিরাইবোজ এবং ফসফেট দিয়ে তৈরী যাদেরকে একত্রে বলা হয় নিউক্লিওটাইড। ডিওক্সিরাইবোজ অনুগুলো মইয়ের ধাপের মত আড়াআড়িভাবে থাকা এডেনাইন, গুয়ানিন , থাইমিন এবং সাইটোসিন এই চার প্রকারের বেস দিয়ে অপরের সাথে সংযুক্ত থাকে। Watson, এবং Crick, এর নাম অনুসারে ডি,এন,এ এর এই গঠনকে বলা হয় Watson-Crick, মডেল।
ডিএন এর আবিস্কার ছিল বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবিস্কার কারন এর ফলে বিজ্ঞানীরা কোষের জটিলতম রহস্য উদঘাটন করতে সমর্থ হন এবং পৃথিবীতে প্রানের জন্ম রহস্য উদ্ঘাটনে আরো এক ধাপ এগিয়ে যান। বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন কোষ কিভাবে জীনের বংশগত তথ্যগুলো কপি করে পরবর্তী প্রজন্মের কোষগুলোতে পাঠায়। ডি,এন,এ অনুর একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ঠ হল যে এরা নিজেদের কপি নিজেরাই তৈরী করে। ডিএনএ মাঝ বরাবর লম্বালম্বিভাবে চিরে গিয়ে আলাদা হয়ে যায় এবং বেসগুলো বেরিয়ে পড়ে। এই বেসগুলোর মধ্যেই থাকে জীনের সংকেত বা জেনেটিক কোড।এই বেসগুলো কে ছাচ হিসেবে ব্যবহার করে তৈরী হয় ডিএনের শতভাগ অনুরুপ ডিএন,এ আর নতুন ডিএন,এ গুলো চলে যায় পরবর্তী প্রজন্মের কোষগুলোতে। নিজেকে ছাচ হিসেবে ব্যবহার করে নতুন জীন তৈরী করার এই পদ্ধতি চলে আসছে প্রান সৃস্টির প্রথম থেকেই। অর্থাৎ কয়েকশ কোটি বছর আগে ব্যাক্টেরিয়াতে জন্ম নেওয়া জীন আজ এসে উপস্থিত হয়েছে মানুষের মধ্যে।
ওয়াটসন এবং ক্রীক এর আবিস্কার নেচার (Nature) পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে। এর পর কোষ ও জীবনে ডিএন এর ভূমিকা রহস্য উদঘাটন করতে ঝাপিয়ে পড়েন বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীরা অচিরেই আবিস্কার করেন যে ডি,এন,এর কাজ হলো প্রোটিন তৈরী নিয়ন্ত্রন করা। কোষ প্রোটিন তৈরী করে কয়েকটি ধাপে। ডিএন,এ এর একটি অংশ নিজেকে ছাচ হিসেবে ব্যবহার করে তৈরী করে Messenger RNA যার মধ্যে ডিএন এ থেকে বয়ে নিয়ে যাওয়া প্রোটিন তৈরী করার তথ্য থাকে, যেমন- কতটি এমাইনো এসিড দিয়ে প্রোটিন তৈরী হবে , প্রোটিন তৈরী করতে কোন এমাইনো এসিডের পর কোন এমাইনো এসিড বসবে ইত্যাদি। RNA এবং DNAএর অনু দেখতে একই রকম হলেও কিছু পার্থক্য আছে, যেমন ডি,এন,এ তে থাকে মইয়ের মত দুই বাহু, কিন্তু আর,এন,এ তে থাকে একটিমাত্র বাহু, ডিএন,এ র থাইমিন এবং ডিওক্সিরাইবোজের পরিবর্তে আর এন এ তে থাকে ইউরাসিল এবং রাইবোজ। ডি,এন,এ থেকে Messenger RNA তথ্য বহন করে নিয়ে আসে কোষের সাইটোপ্লাজমের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দানার মত রাইবোজোম(Ribosome) এ যেখানে একটার পর একটা এমাইনো এসিড জুড়ে তৈরী হয় প্রোটিন। প্রোটিনরাই নিয়ন্ত্রন করে শরীরের সমস্ত কাজ গুলোকে যেমন, খাদ্য হজম, মাংস পেশীর সংকোচন, হৃৎপিন্ডের স্পন্দন, শ্বাসপ্রশ্বাস ইত্যাদি।
জীবনের উৎপত্তি রহস্য জানতে হলে আগে DNA, RNA এবং ribosome এ প্রোটিন তৈরী হওয়ার রহস্য জানা ছিল অপরিহার্য্য। ( চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০১৭ বিকাল ৫:০৬