পৃথিবীতে কিভাবে প্রান সৃস্টি হল- এর চেয়ে কঠিন প্রশ্ন সম্ভবতঃ দ্বিতীয়টি নেই। ইতিহাসের বেশীরভাগ সময় ধরে মানুষ বিশ্বব্রহ্মান্ডকে সর্ব শক্তিমানের কীর্তি হিসেবে বিশ্বাস করে এসেছে। কিন্তু বিজ্ঞানের আবিস্কারের ফলে সে বিশ্বাসে এখন ফাটল ধরছে এবং পৃথিবীতে সৃস্টিতত্বে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা ক্রমশঃ কমছে। পৃথিবীর আদিমতম প্রান সৃস্টির রহস্য নিয়ে গবেষনা করছেন বিজ্ঞানীরা। যদিও সাফল্য এখনো আসেনি, অনেকেই বিশ্বাস করেন তারা সঠিক পথেই এগোচ্ছেন এবং তারা আশাবাদী যে ভবিষ্যতে প্রান সৃস্টির রহস্য উন্মোচন করে ল্যাবোরেটরীতে জড় পদার্থ থেকে প্রানী তৈরী করতে সক্ষম হবেন।
পৃথিবীতে প্রানের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। যে সমস্ত প্রানী এক সময় সদম্ভে পৃথিবী শাসন করতো তারা আজ বিলুপ্ত।বিলুপ্ত প্রানীদের মধ্যে সবচে' উল্লেখযোগ্য হল ডাইনোসর যারা ২৫ কোটি বছর থেকে পয়ষট্টি লক্ষ বছর পর্যন্ত পৃথিবীতে টিকে ছিল। পৃথিবীতে প্রানের আবির্ভাব কিন্তু ডাইনোসরদেরও অনেক আগে। এ বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে ৩৭০ কোটি বছরের পুরোনো ব্যাক্টেরিয়ার জীবাশ্ম আবিস্কার করতে সক্ষম হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ভবিষ্যতে হয়ত আরো প্রাচীন প্রানের সন্ধান পাওয়া যাবে। আমরা যদি ধরে নিই পৃথিবীতেই প্রানীর জন্ম (কেউ কেউ ধারনা করেন বহির্বিশ্বের অন্য কোন গ্রহ থেকে বা উল্কাপিন্ডের মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রানের আগমন) তাহলে নির্দ্বিধায় বলা যায় যে পৃথিবীর জন্মের একশ কোটি বছরের মধ্যেই পৃথিবীতে প্রানীর আবির্ভাব।
সপ্তদশ শতাব্দীতে মাইক্রোস্কোপ আবিস্কৃত হলে বিজ্ঞানীরা কোষের অস্তিত্ব প্রমান করতে সক্ষম হন । কিন্তু কোষই যে প্রানের ভিত্তি তা বুঝতে বিজ্ঞানীদের সময় লেগেছে আরো একশ বছরেরও বেশী।উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে জীববিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হন যে সমস্ত প্রানীর কোষ একই রকম। মানুষ, গাছপালা, পশুপাখি, ডাইনোসর, ব্যাক্টেরিয়া , ফাংগাস ইত্যাদি সমস্ত প্রানী বাহ্যিকভাবে আলাদা আলাদা হলেও তাদের কোষ কিন্তু অদ্ভুতভাবে একই রকম দেখতে। সুইডিশ বিজ্ঞানী কার্ল লিনিয়াস (Carl Linnaeus) সর্বপ্রথম প্রানীকূলের শ্রেনীবিভাজন করে নামকরন করেন। সর্বশেষ ২০১৬ সালে বিজ্ঞানীদের করা শ্রেনী বিভাজনে তারা দেখান ক্ষুদ্র এককোষী ব্যাক্টেরিয়া থেকে ক্রমশঃ সমস্ত জীবের উৎপত্তি। অর্থাৎ কয়েকশ কোটি বছর আগে আমার আপনার- সবার পূর্বপুরুষই ছিল ব্যাক্টেরিয়া। প্রানের আবির্ভাবের সময় পৃথিবীতে যে সমস্ত পদার্থ ছিল সে গুলো দিয়ে যদি কোষ তৈরী করা সম্ভব হয় তাহলেই ক্রমে ক্রমে সমস্ত প্রানীর উদ্ভবের রহস্য জানা সম্ভব হবে। বিজ্ঞানীরা ধারনা করেন যে জড় পদার্থ থেকে প্রানের উদ্ভব ঘটেছে ধাপে ধাপে দীর্ঘ সময় ধরে। বিজ্ঞানীদের পক্ষে আদৌ প্রান সৃস্টি করা সম্ভব হবে কি ?
মানব ইতিহাসের বেশীরভাগ সময়ে প্রানের আবির্ভাব নিয়ে চিন্তার দরকার পড়েনি কারন সবাই তখন একবাক্যে বিশ্বাস করতো যে সমস্ত কিছুই সর্বশক্তিমানের সৃস্টি। অস্টাদশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা “প্রানশক্তি” তে বিশ্বাস করতেন। প্রানীদের মধ্যে প্রানশক্তি থাকার কারনে তারা জীবন্ত , এবং জড় পদার্থ থেকে ভিন্ন। প্রানশক্তির সাথে যুক্ত হয়েছিল ধর্মীয় মতবাদ। বাইবেলে বলা আছে যে ঈশ্বর মানুষের মধ্যে জীবনের নিশ্বাস( Breath of life) দান করেন এবং অমর “আত্মা”ই হল জীবন শক্তি।
অস্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিজ্ঞানীরা কিছু রাসায়নিক পদার্থ আবিস্কার করতে সক্ষম হন যা শুধু মাত্র জীবন্ত পদার্থের মধ্যে পাওয়া যেত। এমনই এক পদার্থ হল ইউরিয়া। ১৭৯৯ সালে বিজ্ঞানীরা প্রস্রাব থেকে এটি আবিস্কার করেন । তখন থেকে ইউরিয়াকে জীবনের রাসায়নিক পদার্থ ভাবা হত। জার্মান বিজ্ঞানী ফ্রেডরিখ ওহলার ( Friedrich Wohler) ১৮২৮ সালে এমোনিয়াম সায়ানেট থেকে ইউরিয়া তৈরী করার পর সে দাবী মিথ্যে প্রমানিত হয়। আরো অন্যান্য যে সমস্ত রাসায়নিক পদার্থকে জীবনের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হত সে গুলোও রসায়নাগারে তৈরী করার ফলে জীবনের রসায়ন এখনো খুজে পাওয়ায় সম্ভব হয় নি। জীবন রসায়ন বা জীবনশক্তির ধারনা ক্রমশঃ কমে এলেও একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায় নি। ১৯১৩ সালে বৃটিশ জীববিজ্ঞানী বেঞ্জামিন মুর “ বায়োটিক এনার্জী”র কথা বলেন যা প্রকান্তরে জীবনশক্তি। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী গুলোতে তো এগুলো হরহামেশাই চোখে পড়ে। ডঃ হু (Dr. Who) ছবিতে "regeneration energy" দিয়ে জীবন শক্তিকে বাড়ানো অথবা নিঃশেষ করে দেওয়া দেখানো হয়। ভবিষ্যতে হয়ত এমন কিছু আবিস্কার হবে কিন্তু এখন ওগুলো কল্পনা মাত্র।
উনবিংশ শতাব্দীর মাঝমাঝি ডারউইনের বিবর্তনবাদ এক যুগান্তকারী অবদান। ১৮৫৯ সালে ডারউইন তার বিখ্যাত গ্রন্থ Origin of species প্রকাশ করেন। এর আগে সৃস্টিতত্বের বিকল্প সুস্পস্ট কোনো ধারনা মানুষের ছিল না। ডারউইন তার তথ্যে বিবর্তনের ফলে এক প্রানী থেকে অন্য প্রানীর উদ্ভব তত্ব ব্যাখ্যা করেন, যা ছিল সৃস্টিকর্তা কর্তৃক একত্রে সমস্ত প্রানীর সৃস্টি তত্বের পরিপন্থী। বাইবেলে বিশ্বাসী খৃস্টানদের আক্রমনের মুখে পড়েন ডারউইন। তিনি তার বইয়ে পৃথিবীতে প্রানের উদ্ভব নিয়ে কিছু বলেন নি, তবে ১৮৭১ সালে লেখা এক চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন- “ আমরা যদি এমন কোনো উষ্ণ জলাধারের কথা চিন্তা করতে পারি যেখানে এমোনিয়া, ফসফোরিক লবন, আলো তাপ বিদ্যুৎ, কার্বন ইত্যাদি থাকতো তবে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে ক্রমে ক্রমে জটিল যোগিক পদার্থ যেমন প্রোটিন তৈরী হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। ডারউইনের ধারনা ছিল অস্পস্ট, তবে এটিই হল পৃথিবীতে প্রানের উদ্ভবের প্রথম বৈজ্ঞানিক ধারনা। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০১৭ রাত ১১:৪৯