কিছুদুর নামার পর রাস্তা ভাগ হয়েছে দুইভাগে। অল্প উচু ন্যাড়া পাথুরে পাহাড়ের পাশ দিয়ে বাম দিকেরটি গিয়েছে আগোরার দিকে আর ডান দিকেরটি গিয়েছে এথেন্স ইউনিভার্সিটি মিউজিয়ামের দিকে। বামদিকের পাথরের ঢিবি বা ছোট ন্যাড়া পাহাড়ের নাম এরোপ্যাগোস। এরোপাগোস শব্দের অর্থ হল "এরিসের পাহাড়"। প্রাচীন এথেন্সে এক্রোপলিসের প্রতিটি ধুলিকনা ঘিরে গড়ে উঠেছিল হাজারো রুপকথা বা পৌরানিক কাহিনী। এরোপ্যাগোসও তার ব্যাতিক্রম নয়। এরিস ছিলেন দেবরাজ জিউস এবং হেরার পুত্র। তিনি ছিলেন যুদ্ধের নির্মমতার বীভৎস দেবতা। জিউস তার অসংখ্য সন্তান সন্ততিদের মধ্যে এরিসকে সবচে' বেশী অপছন্দ করতেন। ট্রয়ের যুদ্ধে তিনি ট্রোজানদের পক্ষে যুদ্ধ করেন এবং সমুদ্র দেবতা পোসাইডনের পুত্র Alirrothiosকে হত্যা করেন। দেবতারা এরিসের অপরাধের বিচার করেছিলেন এই পাহাড়ে। এ পাহাড়ের উচ্চতা ত্রিশ পয়ত্রিশ ফুট এর বেশী নয়। ক্লাসিকাল গ্রীসে এ পাহাড় ব্যবহৃত হত খুনী আসামীদের আদালত হিসেবে। গ্রীসে খৃস্ট ধর্ম প্রসারের পর প্রথম শতাব্দীতে" পোপ সেন্ট পল এ পাহাড়ের উপর থেকে এথেন্স বাসীদের উদ্দেশ্য বক্তব্য রাখেন Now what you worship as something unknown I am going to proclaim to you- The God who made the world and everything in it is the Lord of heaven and earth and does not live in temples built by hands."। পাহাড়ের গা বেয়ে এবড়ো খেবড়ো পাথুরে রাস্তা দিয়ে উপরে ওঠার ব্যাবস্থা থাকলেও পাশের লোহার সিড়ি বেয়ে ওঠা সহজ এবং অনেক বেশী নিরাপদ। উপরে উঠে পরিচিত হলাম আশীতিপর বৃদ্ধ জার্মান দম্পতির সাথে। বৃদ্ধ জানালেন প্রাচীন সভ্যতার টানে তারা বার বার আসেন গ্রীসে। এ পর্যন্ত চারবার তারা গ্রীসে এসেছেন এবং প্রতিবারেই মাসাধিক কাল কাটিয়েছেন এখানে। গ্রীসের আনাচে কানাচে ঘুরে দেখেছেন খৃস্টপূর্ব যুগের সভ্যতার নিদর্শনগুলো।মিনিট দশেক উপরে কাটিয়ে লোহার সিড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলাম। পাহাড়ের গায়ে বেশ বড় পিতলের ফলকে অনেক কিছু লেখা আছে যা আমার কাছে "গ্রীক" বা দুর্বোধ্য ছিল। হরফগুলোর জটিলতা দেখে মনে হল সঙ্গত কারনেই দুর্বোধ্য বোঝাতে ইংরেজীতে "গ্রীক" শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
নেমে চললাম পাহাড়ের ঢাল বেয়ে পাকা রাস্তা দিয়ে। দুই তিনশ ফুট নীচে নামার পর গিয়ে উপস্থিত হলাম বেশ বড় পাচিল ঘেরা এলাকায়। পাচিলের গেট এর পাশে টানানো সাইনবোর্ডে গ্রীক এবং ইংরেজীতে লেখা " Ancient agora" । গ্রীক শব্দ আগোরার অর্থ হল বাজার এলাকা। এক্রোপলিস, এরোপেগাস, কলোনস পাহাড়ের মধ্যবর্তী এ এলাকা ছিল প্রাচীন এথেন্সের প্রানকেন্দ্র। এর পাশ দিয়ে বয়ে যেত এন্ডানোস নদী যা লিকাবেটস পাহাড় থেকে উৎপত্তি হয়ে সাগরে গিয়ে মিশেছিল। এই আগোরাতে এসে মিশেছিল অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ন পথ যার মধ্যে "প্যান এথেনিয়ান উৎসবের রাস্তা অন্যতম।প্রতি চার বছর পর পর প্যানএথেনিয়ান উৎসবের মিছিল শহরের প্রধান গেট বা ডাইপাইলন থেকে শুরু হয়ে আগোরার মধ্য দিয়ে গিয়ে শেষ হত এক্রোপলিসে। সম্রাট পেরিক্লিসের যুগে এখানেই অনুষ্ঠিত হত ভোটাভুটি যার কারনে এখানকে বলা হয়ে থাকে গনতন্ত্রের সুতিকাগার। গান বাজনা নাটক থিয়েটার, বিভিন্ন ধর্মীয়,সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও অনুষ্ঠিত হত এখানে। সক্রেটিস, প্লেটো, পীথাগোরাস, হেরোডেটাস, এরিস্টটল প্রভৃতি মনীষিরা প্রায় তিন হাজার বছর আগে দর্শন, গনিত, সাহিত্য ইতিহাসের সুচনা করেছিলেন এখানে।
আগেভাগে টিকেট কেনা থাকায় লাইন এড়িয়ে ঢুকে পড়লাম আগোরায়। আরো কিছুটা নেমে গেলে ডাইনে আগোরার পূবদিকে নজরে এল ছোটখাট যাদুঘর। প্রাচীন ডোরিক এবং আইওনিক স্থাপত্যে গড়ে তোলা এ যাদুঘর ছিল "Stoa of Attilos" । Stoa শব্দের অর্থ হল ছাদওয়ালা হাটার পথ। পারগামোনের সম্রাট এট্টিলস এথেন্সে দর্শনবিদ্যা শিক্ষা নেন। প্রতিদান হিসেবে তিনি এথেন্সবাসীদের এই Stoa উপহার দেন। খৃস্টপূর্ব ১৫৯ অব্দে শুরু হয়ে এটির নির্মান কাজ শেষ হয় ১৩৮ খৃস্টপুর্বাব্দে।১২০ মিটার লম্বা এবং ২০ মিটার চওড়া এই Stoa ছিল দোতলা। বাইরে এবং ভেতরে দুই সারির স্তম্ভের উপর দাড়িয়েছিল এটি। প্রাচীন এথেন্সে এটি ব্যবহৃত হত শপিং মল এবং চিত্তবিনোদনের স্থান হিসেবে। এর প্রতি তলায় ছিল দোকানপাট এবং এখানে সামাজিক অনুষ্ঠানাদিরও আয়োজন করা হত। ডোরিক এবং আইওনিক স্থাপত্য রীতির মিশ্রনে বেলে পাথর এবং প্যান্টেলিক শ্বেতপাথরে তৈরী এই Stoa। তৃতীয় শতাব্দীতে ইউরোপের উত্তর থেকে নেমে আসা "হেরুলী" বারবারিয়ানরা ধ্বংস করে ফেলেছিল এই স্থাপনা। জে,ডি রকফেলারের অর্থানুকল্যে ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত সেই প্রাচীন কালের অনুকরনে এটি আবার তৈরী করা হয়। এটি এখন একটি ছোটখাটো যাদুঘর।২০০৩ সালে গ্রীসের ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্তির চুক্তি অনুষ্ঠিত হয়েছিল এখানে।
যাদুঘরঃ- স্টোয়া অফ এট্টিলোস যাদুঘরে খৃস্টপূর্ব তিন হাজার বছর আগের থেকে রোমান যুগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের পোড়ামাটি এবং ধাতুর বাসনপত্র, পাথর এবং ব্রোঞ্জ এর তৈরী মূর্তি, অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি সামগ্রী রাখা আছে। এ সমস্ত সামগ্রী ঠিক এখানেই অর্থাৎ আগোরাতেই খুজে পাওয়া। এথেন্সের আমেরিকান স্কুল অফ ক্লাসিকাল স্টাডিস বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে এখানে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের নিরলস কাজের ফলে গড়ে উঠেছে এই যাদুঘর। যে সমস্ত প্রদর্শনী নজরে পড়ার মত সেগুলো হল - হেরোডেটাসের আবক্ষ মূর্তি, মাইসেনিয়ান আমল(খৃস্টপূর্ব ১১ থেকে ১৫ শতাব্দী)ের বাসনকোসন, রোমান সম্রাট এন্টোনিয়াসের আবক্ষ মূর্তি বাইজেন্টাইন আমলের তৈজসপত্র ইত্যাদি। মিউজিয়ামের বারান্দায়ও রাখা আছে কিছু প্রদর্শনী, যার মধ্যে খৃস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে নির্মিত দেবী আফ্রোদিতি'র মাথাবিহীন মূর্তি এবং একিলিসের পাথরের মূর্তি চোখে পড়ার মত। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৭ বিকাল ৩:২০