মিস লিসবেথ বার বার করে পুরোনো হাভানা থেকে বাস ছাড়ার সময় স্মরন করে দিয়েছিলেন সবাইকে । তারপরও বাস ছাড়ার সময় দেখা গেল একজন যাত্রী অনুপস্থিত।১৫- ২০ মিনিট দেরী করার পরও যখন তিনি ফিরলেন না আমরা রওয়ানা দিলাম দুপুরের খাবারের উদ্দেশ্যে।ওল্ড হাভানা ছেড়ে সেন্ট্রাল পার্কের পাশ দিয়ে গিয়ে বাস ডুব দিল হাভানা টানেলে। হাভানা উপসাগরের নীচ দিয়ে গিয়ে উঠলাম অপর পারের দুর্গের পাশে। উপনিবেশিক আমলে হাভানা ছিল গুরুত্বপূর্ন বন্দর। আমেরিকা থেকে ছেড়ে আসা জাহাজগুলো নোঙ্গর ফেলে আটলান্টিক পাড়ি দেওয়ার আগে এখান থেকে জ্বালানী এবং অনান্য রসদ ভরে নিত।এ বন্দর নগরীর সুরক্ষার্থে স্প্যানিশরা মনোযোগী ছিল প্রথম থেকেই। হাভানা উপসাগর এবং ক্যারিবিয়ান সাগরের সংযোগ স্থলে পাহাড়ের উপর তারা গড়ে তুলেছিল একাধিক দুর্গ। উপসাগরের মুখে ১৫৮৯ সালে দুর্গ গড়ে তোলা দুর্গের নাম El Morro Castle।ইংরেজী ভাষার The শব্দ স্প্যানিশ ভাষাতে হল El, আরবীতে Al, এবং ফরাসীতে la/le। স্প্যানিশ ভাষায় Morro শব্দের অর্থ হল পাথর।পাথরের পাহাড়ের উপর গড়ে তোলা থেকেই এ দুর্গের নাম পাথুরে দুর্গ। হাভানা উপসাগরের মুখে লোহার চেইন পানির মধ্যে ঝুলিয়ে রেখে উপসাগরে জাহাজ ঢোকা নিয়ন্ত্রন করত স্প্যানিশরা। সাগরের একদম পাড়ে ১৮৪৬ সালে গড়ে তোলা বাতি ঘর বা লাইট হাউজ আজও টিকে আছে।এ দুর্গের পাহাড়ের উপরে বিভিন্ন স্তরে রাখা আছে সেই সময়ে ব্যাবহৃত কামানগুলো।দূর্গ পাহাড়ের পাদদেশের রেস্তোরাঁ থেকে মূল হাভানা শহর খুব ভালোভাবে চোখে পড়ে। মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে দুর্গের গেটের পাশের দোকানে হাভানার স্যুভেনির কেনার জন্য নিয়ে গেলেন লিসবেথ। এ দোকান সরকারী, ফলে দরাদরির সুযোগ নেই। দাম একটু বেশীই মনে হল। কিউবাতে পর্যটক মাত্রই হাভানা সিগার কিনবেন সুতরাং আমিও কিনলাম। ফিডেল ক্যাস্ট্রোর প্রিয় ব্রান্ড এক বাক্স Cohiba esplendido সিগারের দাম পড়ল ৮০ ডলার। El Morro Castleএর পাশেই আরো একটি দুর্গ।নাম La Cabana Fortress। ১৭৬২ সালে বৃটিশরা কিউবা দখল করে নেওয়ার এক বছর পর ফ্লোরিডার বিনিময়ে কিউবা ফিরে পায় স্পেন। ১৭৬৩ সালে নতুন দুর্গ La Cabana Fortress এর কাজ শুরু হয়ে ১১ বছর পর শেষ হয়। কিউবার বিপ্লবের পর এ দুর্গ ব্যবহৃত হয় বন্দীশালা হিসেবে। চে' গুয়েভারা বন্দীদের বিচারের ভার নেন। সে সময়ে কয়েকশ' বন্দীকে নির্মম ভাবে হত্যা করেন চে'। এ দুর্গ নির্মানের পর থেকে এর গেট রাত নয়টায় বন্ধ করে দেওয়া হত। পুরোনো দিনে কামান দেগে গেট বন্ধ হওয়ার সময় সবাইকে জানান দেওয়া হত। সে ঐতিহ্য অনুসরন করে আজও রাত নয়টায় এ দুর্গ থেকে কামান দাগা হয়।
দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে বাস ছুটল ফেলে আসা পুরোনো হাভানার দিকে।এবারের গন্তব্য হাভানা ফ্লি মার্কেট(Flea market)।মেডিকেল কলেজে কমিউনিটি মেডিসিন অধ্যয়নের সুবাদে পরজীবি কীট ফ্লী সম্পর্কে সম্যক ধারনা ছিল কিন্তু কীটের নামে যে মার্কেট হয় তা প্রথম টের পাই দেশের বাইরে আসার পর। কিউবার স্যুভেনির এবং গিফট সামগ্রী কেনার জন্য এ মার্কেট বেশ সাশ্রয়ী। বাজারে পৌছানোর আগেই আবার শুরু হল বৃস্টি। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের দেশগুলোতে সারাবছর সারাদিনই রোদ আর বৃস্টি। যখন আকাশ ভেঙ্গে মুষলধারে বৃস্টি নামে, মনে হয় শ্রাবনের এ বৃস্টি বুঝি শেষ হওয়ার নয়।আবার কিছুক্ষন পরই বৃস্টি থেমে গিয়ে শুরু হয় ঝলমলে রোদ।প্রতিপ্রতিদিনের রোদ বৃস্টির কারনে এখানকার গাছপালা বেড়ে ওঠে তরতর করে।আমার দেখা সমস্ত ক্যারিবিয়ান দ্বীপগুলোই অস্বাভাবিক রকম সুন্দর-সবুজ।
বাস থেকে দৌড়ে গিয়ে ঢুকলাম ফ্লি মার্কেটে। বেশ বড় বাজার এটি।ইস্তাম্বুলের মশলাবাজারের মত ছোট ছোট দোকান।ঘুরতে ঘুরতে ঘুরতে বাজারের এক কোনায় ডাব এর দোকানে গিয়ে হাজির হলাম।এখানকার ডাবের আকার যেমনি বড় তেমনি মিস্টি তার জল।একটী ডাবের দাম এক ডলার । আমাদের হোটেলের সীমানার মধ্যে অনেকগুলো নারকেল গাছ ছিল। কর্তব্যরত "গার্ডি"বা নিরাপত্তা রক্ষীদের কাছে চাইলেই তারা গাছ থেকে ডাব পেড়ে দেন ট্যুরিস্টদেরকে বিনামূল্যে, গার্ডিদেরকে সামান্য বখশিশ দিলেই চলে । স্প্যানিশ ভাষায় নিরাপত্তা রক্ষীকে যে "গার্ডি" বলে তা শিখেছিলাম রেস্তোরাঁ ওয়েট্রেস মিস লিজার কাছ থেকে। মধ্য আমেরিকার সমস্ত ফলই চমৎকার। কানাডার বাজারের অধিকাংশ কলা,পেপে আনারস,তরমুজ,ইত্যাদি সমস্ত ফলই যোগান দেয় মধ্য আমেরিকার দেশগুলো।ত্রিনিদাদের বিশাল আকারের তরমুজের নামে আজও জিভে জল আসে।
বেশ কড়া এবং ঘন কিউবান কফির স্বাদ নেসকাফে কফি থেকে আলাদা।কিউবার স্যুভেনির হিসেবে কিছু কফি কিন নিলাম ফ্লি মার্কেট থেকে। বৃস্টি একটু কমে এলেই বাজার থেকে বেরিয়ে পড়লাম। হাতে তখনো ঘন্টা খানেক সময়।বাজারের সামনে অস্টাদশ শতাব্দীর বেশ কয়েকটা রেলওয়ের ইঞ্জিনের ছোট উন্মুক্ত প্রদর্শনী। কিউবাতে রেলওয়ে খুব বেশী বিস্তৃত নয়।উত্তরের রাজধানী হাভানা থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর দক্ষিনের সান্টিয়াগো ডি কিউবা পর্যন্ত কয়েকশ' কিলোমিটারের একমাত্র লম্বা লাইন। রেল ইঞ্জিন গুলোর উলটো দিকে অস্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত রুশ ক্যাথলিক চার্চটি বেশ দর্শনীয়। গুড়ি গুড়ি বৃস্টির মধ্যেই আবার বাসে উঠতে হল। বাস রওয়ানা দিল পুরোনো হাভানার ভেডাডো এলাকার দিকে।মিনিট দশ পনের পরেই বাস থামল হাভানা সেন্ট্রাল পার্কে।এ পার্ক এর একটু ছোট ইতিহাস আছে। শহরের সীমানা প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলে শহরের দুই এলাকার মাঝমাঝি স্থানে এ পার্কের নির্মান শুরু হয়েছিল ১৯০৫ সালে। শহরের কেন্দ্রে হওয়ায় এ পার্কের এমন নামকরন। পার্কের মাঝখানে সাদা বেদীর উপর জাতীয় বীর হোসে মার্টির মার্বেল পাথরের মূর্তি। গাছপালা ফোয়ারা, ইত্যাদি দিয়ে সাজানো বেশ বড় জায়গা জূড়ে এ পার্কটি। ১৯৯৮ সালে পোপ দ্বিতীয় জন পল এখানে হাভানার অধিবাসীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন। কিউবার জনসংখ্যার অধিকাংশ অধিবাসী ক্যাথলিক খৃস্টান। পোপের সফরকে অনেকে কিউবাতে ধর্মের পূনরুজ্জীবনের আশা করেছিলেন, কিন্তু পোপের আহবানে খুব একটা সাড়া মেলেনি।
পুরোনো হাভানা স্কোয়ার।
পুরোনো হাভানা স্কোয়ার।
পুরোনো হাভানা স্কোয়ার।
পুরোনো হাভানা স্কোয়ার।
কিউবার বিপ্লবে ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র।
প্রায় শুন্যে ভেসে থাকা
সেন্ট্রাল পার্কে সাইমন বলিভারের মূর্তি।
হাভানার এই হোটেলে সুদীর্ঘ বিশ বছর কাটিয়েছিলেন আর্নেস্ট হেমিঙ্গোয়ে
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৬ ভোর ৪:১৮