somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতি-২, ঘুর্নিঝড় ১৯৯১(পরবর্তী অংশ)

০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পরদিন দ্বীপের প্রথম সকাল। মশার কামড় থেকে বাচার জন্য জুতোমোজা পরে ঘুমিয়েছিলাম রাতে । বন্ধু আমীনের কথামত আসার সময় দুটো চাদঁর ঢুকিয়েছিলাম ব্যাগে, চাদর দুটো অনেক কাজে লেগেছিল। ২/৩ দিন পর আমীনের দূর সম্পর্কের ভাইয়ের কল্যানে যায়গা হয়েছিল উপজেলা ডর্মিটরীতে। তখন রাতে ভালভাবে ঘুমাতে পারতাম এবং খাবার দাবারের কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। কেউ মাছ খেত না তখন কারন হিসেবে অনেকে বলত তারা দেখেছে এই মাছ গুলো কিভা্বে)মানুষের লাশগুলো ঠুকরে ঠুকরে খেত। কোয়ার্টার থেকে হাত মুখ ধুয়ে প্রাত্যহিক কাজকর্ম সেরে আমরা সবাই এলাম হাসপাতালে।এসে শুনলাম ডাঃ মামুন গেছেন ত্রান সমন্বয় কমিটির মিটিং এ। ত্রান কাজে অংশ নিতে বেসামরিক প্রসাশনের পাশাপাশি সামরিক বাহিনীও কাজ করত। সরকারের তরফ থেকে ত্রান সামগ্রী বিলি বন্টনের কাজ করত বেসামরিক প্রশাসন । সামরিক বাহিনীর কাজ ছিল আইন শৃংখলা ঠিক রাখা, এবং অনান্য সহায়তা করা। বিদেশী এবং দেশী এন, জি, ও রা তাদের নিজেদের নিয়ম মত কাজ করতেন। আমেরিকার সেনাবাহিনী প্রধানতঃ কাজ করত উপজেলা সদরে। তারা যে কাজ গুলো করত তা ছিল ত্রান সামগ্রী পৌছে দিত , সমদ্রের লোনা পানি পাম্প করে বের করে দেওয়া, জল সরবরাহ , বিদ্যুৎ সরবরাহ, ইত্যাদি। আমেরিকার সেনাবাহিনী যত দ্রুততার সাথে সুচারুভাবে কাজ গুলো করত তাতে প্রসংসা না করে পারা যায় না। প্রচন্ড গরমে দিনের বেলা ঘামত অথচ তারা কাজ গুলো করে যেত ঠিকভাবেই। একজন ডেপুটি সেক্রেটারী ছিলেন সরকারী দায়িত্বে। অমায়িক ভদ্রলোক। আরো কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেটকে পাঠানো হয়েছিল। এদের একজন এসেছিলেন চাদঁপুর থেকে, আমার পূর্ব পরিচিত, ঐ ভদ্রলোকের সাথে একই উপজেলাতে কাজ করেছিলাম অল্প কিছুদিন আগে। ত্রান সমন্বয় মিটিং থেকে ফিরলেন ডাঃ মামূন দুপুরের দিকে। মিটিং এ সিদ্ধান্ত হয়েছিল স্বাস্থ্য সেবা দিতে আমাদের ইউনিয়ন গুলোতে যেতে হবে।সেই অনুসারে অদল বদল করে অর্ধেক ডাক্তারকে হাসপাতালে রেখে বাকি অর্ধেক কে বিভিন্ন ইউনিয়নে পাঠানোর নিয়ম করেছিলেন ডাঃ মামুন। সব ইউনিয়ন গুলোর নাম আমার এখন মনে নেই। যে গুলো মনে আছে সে গুলো হল “ লেমশীখালী, উত্তর এবং দক্ষিন ধুরুং, বড়ঘোপ ইত্যাদি। ঐ দিন হাসপাতালেই কাটলো আমার। দুপুরে খেলাম সেই একই খাবার। কুতুবদিয়া তে যে ১০/১২ দিন ছিলাম অধিকাংশ দিন কেটেছে, আলু, ভাত আর ডাল খেয়ে। সেই খাবারই গোগ্রাসে গিলতাম ।
পরদিন সকালে স্বাস্থ্য সহকারী এবং একজন ওয়ার্ড বয়কে সাথে নিয়ে আমার প্রথম দিনের কাজ শুরু হল। ঝাকা ভর্তি ঔষধপত্র মাথায় করে নিয়ে চলল ওয়ার্ড বয়। গন্তব্য লেমশীখালি। কুতুবদিয়া দ্বীপটা দক্ষিন থেকে উত্তরে লম্বা লম্বি। উপজেলা সদর দ্বীপের দক্ষিনে । লেমশী খালি ইউনিয়ন ছিল সদর থেকে ৮/১০ কিলোমিটার দূরে। উপজেলা সদর থেকে “ চাদেঁর গাড়ী” তে করে রওয়ানা দিলাম। যারা চাঁদের গাড়ী দেখেন নি তারা নিতান্তই অভাগা। এ গুলো ছিল বাসে রুপান্তরিত পুরান দিনের জীপ গাড়ী। পরে কোন এক সময় কক্সবাজার বেড়াতে গিয়ে এদের দেখেছি সৈকতে চলাচল করতে। ছাদে, বনেটে পাদানি তে সবখানেই মোট প্রায় ২০/৩০ জন যাত্রী নিয়ে চলাচল করে। উপজেলা সদর থেকে মাইল খানেক দূরে মাঠের মধ্যে দেখলাম পড়ে আছে চাদেঁর গাড়ী। ঝড় জলোচ্ছাসের তীব্রতা এত বেশী ছিল যা তা একটা গাড়ীকে নিয়ে ফেলেছে মাইল খানেক দূরে মাঠে মধ্যে। চাদেঁর গাড়ীতে ৪/৫ কিলোমিটার গিয়ে তারপর মাটির রাস্তা দিয়ে হাটতে হল ৪/৫ কিলোমিটার। স্বাভাবিক অবস্থায় গাড়ী দক্ষিন থেকে উত্তরে প্রায় ১০ কিলোমিটার যেত , ঘুর্নিঝড়ে রাস্তা ভেঙ্গে যাওয়ায় ৪/৫ কিলোমিটারের পর “চরন থাকিতে মরনে কি ভয় নিমেষে যোজন ফরসা”

মাঠ এবং গ্রামের মধ্যে দিয়ে হাটা পথে বীভৎস অনেক দৃশ্য চোখে পড়েছিল। কোন গ্রামে বাড়ী ঘর অক্ষত দেখি নি। মাঠের মধ্যে দিয়ে হাটা পথে নাকে দুর্গন্ধ আসায় তাকিয়ে দেখি একটা ৮/১০ বছরের ছেলের লাশ পড়ে আছে যার পা থেকে পেটের উপরের অংশ অবধি নেই। হয়ত শেয়াল কুকুরে খেয়ে নিয়েছে। আরেকবার রাস্তার পাশে দেখেছিলাম বেশ বড় আকারের একটা রুই জাতীয় মাছ মরে পড়ে আছে। সামুদ্রিক মাছ জলোচ্ছাসের সাথে এসেছিল আর যেতে পারে নি। সাথের সহকর্মীকে তার ওই রাতের অভিজ্ঞতা কি জিজ্ঞেষ করাতে সে জানাল রেডিও তে ঝড়ের ঘোষনা তারা শুনছিল সবাই। ওদের বাড়ী টা ছিল উপজেলা সদরের পাশে বাধের ভেতরে। কুতবদিয়া দ্বীপের দক্ষিন দিকে উচু করে বাধ দেওয়া আছে । ফলে বাধের ভেতরে এলাকা গুলো অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। কিন্তু সে রাতে পানির মুল আঘাত এসেছিল দ্বীপের পুব দিকের কুতুবদিয়া চ্যানেলের দিক থেকে। চট্টগ্রাম রেডিও থেকে মুহুর্মূহ নির্দেশ আসছিল সবাইকে নিরাপদ আশ্রয় যেমন কুতুবদিয়া সদরে চলে যেতে। ঐ সময় কুতুবদিয়া দ্বীপে ঘুর্নিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র তেমন ছিল না। তবে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে কিছু উচু মাটির ঢিবি তৈরী করা হয়েছিল শেখ মুজিব আমলে যে গুলো স্থানীয়ভাবে পরিচিত ছিলো “মুজিব ঢেইল” হিসেবে। দ্বীপে বেশী প্রানহানি হওয়ার একটা কারন ছিল অনেকে এই সতর্ক বার্তা গুলোকে উপেক্ষে করেছিল। যাই হোক আমার স্বাস্থ্যকর্মীর পরিবার সবাই বাড়ীতেই ছিল। ওরা যখন সিদ্ধান্ত নিলো বাড়ী ছেড়ে আশ্রয়ের সন্ধানে যাবে ততক্ষনে পানি এসে পৌছে গেছে। অন্ধকার আর ১৫০ কিলোমিটারের বাতাস বৃস্টির মধ্যে কে কোথায় বোঝার উপায় ছিলো না। একটু পরেই ধ্বসে পড়লো তাদের টিনের ঘর। ভাসিয়ে নিয়ে চলল টিনের ঘরকে, যা কিছু দূর গিয়ে আটকে যায় এক গাছে। সেখানেই তারা ছিল। তবে তার পর থেকে ছোট বোনটাকে আর খুজে পাচ্ছে না। কত উচু ছিল পানির স্রোত? স্বাস্থ্য কর্মী দেখালো মাটি থেকে ৮/১০ ফুট উচু গাছের মাথায় আটকে থাকা খড় কুটোর দিকে। অর্থাৎ সাগর কিনার থেকে ৩/৪ কিলোমিটার দূরে এই গাছের এখানেও জলোচ্ছাস ছিল ১০ ফুট উচু। দ্বীপটা উত্তর দক্ষিনে লম্বা এবং মাঝমাঝি এক জায়গায় খুব বেশী হলে ৩/৪ কিলোমিটার চওড়া হবে কারন ওই খান থেকে ডাইনে বায়ে তাকালে দু দিকেই সমুদ্র চোখে পড়ছিল।


তোমরা কি অভিজ্ঞতা সেই রাতের? মামূন জানাল ও দোতলার সরকারী বাসাতেই ছিল। একাই থাকতো । ঝড় শুরু হলেও বেশী চিন্তিত ছিলো না কারন অপেক্ষাকৃত মজবুত দালান এবং উচু যায়গা । এক সময় ঝড়ের আঘাতে খুলে যায় ব্যালকনির দরজা। বৃস্টি এসে ভিজে যাচ্ছিল। উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করতে গিয়ে ঝড়ের তান্ডবে ছিটকে গিয়ে পড়েছিল পাশে রাখা চৌকিতে। দরজা ঐ সময় তার পক্ষে আর বন্ধ করা সম্ভব হয় নি। তার পর এক সময় শোয়ার ঘরেও আর টিকতে পারে নি। আশ্রয় নিয়েছিল বাথ রুমে। খুলে যাওয়া দরজা জানালা দিয়ে হু হু করে ঢুকছিল ১৫০ কিলো মিটারের ঝড়ো হাওয়া এবং বৃস্টি। জলোচ্ছাসের পানি এসেছিল একতলার হাটূ অবধি।

মনে আছে লেমশীখালি যাওয়ার পথে ছোট একটা নদী পেরুতে হয়েছিল। নদীর কিনারে দু ধারেই নদিতে ভেসে আসা মানুষের হাড়গুলো দেখে মনে পড়ে যাচ্ছিল ছাত্র জীবনের এনাটমীতে হাড় বা “বোন” পড়ার কথা। স্বাস্থ্য কর্মী দেখালো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া লবন তৈরীর ক্ষেত গুলো। এই এলাকার লোকজনদের আয়ের একটা প্রধান উৎস ছিল লবন চাষ।

ইউনিয়ন সদরে পৌছে দেখলাম ঝড়ের তান্ডব, বাজারের একটা ঘর বাড়ি দাঁড়িয়ে ছিলো না, সব গুলো দুমড়ে মুচড়ে ধ্বসে পড়া। কোন কোন ঘর ছিল সম্পুর্ন নিশ্চিহ্ন, দু একটা খুটি ইঙ্গিত দিচ্ছিল এখানে অতীতে ঘরবাড়ী ছিল। গেলাম লোকজনের সাথে আলাপ করতে । তাদের ওই সময় ওষুধের চেয়ে বেশী দরকার ছিল খাবার, পানি এবং জামা কাপড়। যাই হোক সাথে করে আনা ঔষধগুলো বিলিয়ে দিলাম প্রয়োজনে বা বিনা প্রয়োজনে , আমাদের উপর নির্দেশ ছিল ঔষধ বিলিয়ে দিতে। বয়ে নিয়ে যাওয়া ঔষধ গুলো ফিরিয়ে আনার মানে ছিল না এবং এই ঔষধ ভবিষ্যতে তাদের হয়ত দরকারে পড়বে ।(চলবে)
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অপেক্ষা-২য় পর্ব

লিখেছেন শামীম মোহাম্মাদ মাসুদ, ২০ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৮:৪৪

বিগত পাঁচ-ছয় মাস যাবত ফকির আবদুল হাই সাহেবকে মাথা থেকে সরাতে পারছি না। আমি নিজে থেকেই বিড়বিড় করে ওনার সাথে কথা বলা শুরু করেছি। দিন রাত যখনই অবসরে থাকি ফকির... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ব্যাপারে সরকার কি পদক্ষেপ নিবে ?

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২০ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৯:২৭


আওয়ামী লীগের মিছিলের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ঢাকার ডেমরা-উত্তরা- বাড্ডা - মিরপুর সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগ ঝটিকা মিছিল করছে। প্রায় তিনমাস ধরে রাস্তায় মিছিল নামানোর প্রস্তুতি ছিলো। মিছিলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবেনাকো তুমি- যেদেশে হাসির জন্যও প্রাণ দিতে হয়!

লিখেছেন জুল ভার্ন, ২০ শে এপ্রিল, ২০২৫ রাত ১০:৩৩

কয়েক দিন আগে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম হবু চন্দের আইন কবিতা নিয়ে, যেখানে কান্নার বিরুদ্ধে রাজা আইন জাড়ি করেছিলেন.....আজ লিখতে হচ্ছে- হাসির জন্য প্রাণ কেড়ে নেওয়ার ঘটনা নিয়ে। আমরা সবাই ইতোমধ্যেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

৭১ না দেখেও কেবল ইতিহাস পড়ে যদি আপনি ৫৩ বছর পরে এসেও পাকিস্তানকে ঘৃণা করতে পারেন। তাহলে নিজ চোখে ভারতের আগ্রাসন দেখেও চুপ কেন?

লিখেছেন তারেক সালমান জাবেদ, ২১ শে এপ্রিল, ২০২৫ ভোর ৪:৩৭

প্রথমেই শুরু করতে চাই সীমান্ত হত্যা নিয়েঃ -
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী দ্বারা ২০০০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১,৫০০ সাধারণ ও বেসামরিক বাংলাদেশি হত্যা করা হয়েছে। ভারত সরকারের বাংলাদেশের সীমান্তে... ...বাকিটুকু পড়ুন

চতুর্দিকে ওত পেতে আছে ফ্যাসিস্টের দোসর

লিখেছেন নতুন নকিব, ২১ শে এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ৮:৩৮

চতুর্দিকে ওত পেতে আছে ফ্যাসিস্টের দোসর

ছবি, অন্তর্জাল থেকে সংগৃহিত।

২০২৫ সালে বাংলাদেশ এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। স্বৈরাচারী শাসনের পতন সত্ত্বেও ফ্যাসিবাদের ছায়া সমাজের প্রতিটি স্তরে লুকিয়ে রয়েছে। ফ্যাসিস্ট শক্তির সহযোগীরা—যারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×