১৯৭৫ সালের জুন মাসে সকল সংবাদপত্র বন্ধ করে ততকালীন সরকার নিয়ন্ত্রনের ৪টি পত্রিকার প্রধান, বর্ষীয়ান লেখক, সাংবাদিক, কবি ও বুদ্ধিজীবী জনাব আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এসেছিলেন ভেসিনের বাংলাদেশীদের একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে। এয়ারপোর্টে স্বাগত জানাতে আয়োজকদের সাথে আমিও গিয়েছিলাম। জনাব চৌধুরী খুব ধীর পায়ে বেরিয়ে এলেন ইমিগ্রেশন পেরিয়ে। বয়সের ভার সামলাতে হাতে লাঠি। খুব যত্ন করে বুদ্ধিজীবীর কোমর পেঁচিয়ে হাটছেন চল্লিশোর্ধ এক বাঙালী রমনী। আয়োজকরা নিজেদের মধ্যে এক পশরা চোখাচোখী করে নিল। কবির সাথে কোন নারী আসবে তারা আগে থেকে জানে না। নারীর জন্য আলাদা থাকার কোন ব্যবস্থা করা হয়নি। মেয়ের বয়সী মহিলার প্রতি বুদ্ধিজীবীর কেয়ারীং এবং মহিলার মুখে 'গাফ্ফার ভাই' ডাকটা উপস্থিত অনেকের কাছেই অসস্তি লাগছিল।
মহিলার নাম পারভীন সুলতানা। পলাশী থেকে ধানমন্ডি নাটকে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের অভিনেত্রী তিনি। স্বামী নেই। একা থাকেন লন্ডনে। লেখকের সফর সংগী হতে পছন্দ করেন। বয়সী সাংবাদিক লন্ডনের বাইরে সফর করলে তিনি সাথে থাকেন। কথা প্রসঙ্গে জানালেন, লেখকের সেবায় নিজেকে কোরবান করতেও রাজী আছেন তিনি।
অনুষ্ঠানে বুদ্ধিজীবী গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করলেন। ৩৮ মিনিটের বক্তৃতা শুনলাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো। পরদিন সকালে আবারো দেখা করতে গেলাম। ইচ্ছে ছিল লেখকের সাথে ভেনিস ঘুরব। গোনদলায় (ভেনিসের নৌকা বিশেষ) চড়ব। মাঝিদের গলায় ভেনিসের আনচলিক গান শুনব। কিন্তু কে জানতো এক মহা বিব্রতকর অবস্থা অপেক্ষা করছে!
রাগে ফুসে ফুসে উঠছেন বুদ্ধিজীবী। গলার বয়সী রগগুলো ফুলে উঠেছে। চোখে মুখে জমা হয়েছে রক্ত। হুমকির সুরে বললেন, তোমাদের বিরুদ্ধে আমি পত্রিকায় লিখব।
তার রাগের কারন জানতে পারলাম দুটি! প্রথমত অনুষ্ঠানে পারভিন সুলতানাকে বক্তৃতা করতে দেয়া হয়নি। দ্বিতীয়ত রাতে বুদ্ধিজীবী তার রুমে একবোতল রেড'লেবেল ও একজোড়া গ্লাস পাঠাতে বলেছিলেন। আয়োজকরা পাঠিয়েছে রেড'ওয়াইন!
আয়োজকরা বার বার ক্ষমা চাচ্ছে ওইতিহাসিক একুশের গানের লেখকের কাছে। তারা বলছে, পারভীন আপা আসবেন আগে থেকে জানা না থাকার কারনে তার নাম বক্তৃতার খাতায় রাখা সম্ভব হয়নি। আর যাকে বর্ষীয়ান বুদ্ধিজীবী রেড লেবেলের কথা বলেছেলেন সে ভুল শুনেছে। ফলে রেড লেবেলের পরিবর্তে পাঠিয়েছে রেড ওয়াইন!
বুদ্ধিজীবী তাদেরকে ক্ষমা করতে পারলেন না। লন্ডনে ফিরে ভেনিস সফরের কথা লিখলেন ঢাকার একটি দৈনিকে। একটি লিখার মধ্যে যতটা সত্য বিকৃত করা যায়, নিজেকে বিসর্জন দেয়া যায়- তার সব চেষ্টাই তিনি করেছেন যত্ন করে। যাদের পকেটে সওয়ার হয়ে স'বান্ধব ভেনিস ভ্রমন করলেন তাদের নামটুকু উল্লেখ করার মতো সামান্য উদারতা তিনি দেখাতে পারেননি। কার সুন্দরী বউ তার পা ছুঁয়েছে, বাড়িতে ডেকে শুটকি ভর্তা নিজ হাতে থালায় তুলে দিয়েছে, যুবতী কন্যা সঙ্গযুগিয়েছে তা লিখেছেন বেশ খুটিয়ে খুটিয়ে। অনুষ্ঠানে নাচতে দেখে এক সুন্দরী শোড়ষীকে বড্ড মনে ধরে বুদ্ধিজীবীর। লন্ডন থেকে ফোন করে তার নাম জেনে লিখেছেন মনের মাধুরী মিশিয়ে। ধান ভানতে শিবের গানের মতো প্রথম আলো এবং যায়যায়দিন'র বিরুদ্ধে খিস্তি করতে ভোলেননি। বিভ্রান্তি দিয়েছেন দেশের রাজনৈতিক প্রসঙ্গে। ভেনিসের একমাত্র বাংলা রেডেও 'রেডিও বাজে' নিয়েও দিয়েছেন মনগড়া তথ্য।
কেন তিনি এমন করলেন? এ প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। আমি তাকে শ্রদ্ধা করতে চাই। নোংরা কিছু বলে মনের দৈন্যতা প্রকাশ করতে চাই না। ছোট করতে চাই না প্রিয় লেখক জনাব চৌধুরীকে। হয়তো বয়সের ভারে অনেক কিছু সাভাবিক ভাবে নেয়ার ক্ষমতা তিনি হারিয়েছেন। কিন্তু আমরা তাকে আরো উদার দেখতে চাই। শেষ বয়সে অন্তত একটি হলেও সঠিক ও সত্য কলাম দেখতে চাই। যা ঘুনে ধরা আমাদের সমাজকে সভ্য হতে শেখাবে।
লিখাটি সাপ্তাহিক ২০০০ এ প্রকাশিত। লেখকের ইচ্ছায় নাম প্রকাশ করা হলো না।