“এই যে বুড়ামিয়া, লুঙ্গি ঠিক কইরা শোন। এইখানে মেয়েছেলে আছে দেখেন না?”
করিম আলী চমকে উঠলেন। তাকিয়ে দেখলেন একটা তরুণী মেয়ে তাঁর দিকে আগুন চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে। মেয়েটির কাছ থেকে আচমকা ধমক খেয়ে তাঁর বুক ধড়ফড় করছে। তিনি শুয়ে ছিলেন। শোয়া অবস্থায় বেকায়দায় পড়ে লুঙ্গিটা হাঁটুর উপরে উঠে এসেছিল। তিনি সেটা খেয়াল করেননি। খেয়াল না করার দুটি কারণ। প্রথমত বয়সের কারণে এসব ছোটখাটো ব্যাপার তাঁর চোখে ধরা পড়ে না। দ্বিতীয়ত এই কক্ষটিতে তাঁর মতোই আরও অনেক বাস্তুহারা এসে আশ্রয় নিয়েছে। সারাক্ষণ মানুষ এখানে গিজগিজ করছে। এত মানুষের ভীড়ের মাঝে তাঁর মতো একজন বয়স্ক মানুষ নিজের জন্যে একটু জায়গা করে নিতে পেরেছে এই তো অনেক। লুঙ্গি কোথায় উঠল তা নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় কোথায়?
মেয়েটি আবার বলল, “লজ্জা শরম কি সব বানের জলে ভাসাইয়া দিছেন? নাকি বুড়া বয়সে ভীমরতি পাইছে?”
করিম আলী কিছু বলতে পারছেন না। তাঁর মুখ লাল হয়ে উঠেছে। খুবই লজ্জা লাগছে। একইসঙ্গে মনও খারাপ হয়েছে। আজকালকার ছেলেমেয়েরা গুরুজনদের আদব করা ভুলে যাচ্ছে। তাদের মধ্য থেকে শ্রদ্ধা ভক্তি উঠে যাচ্ছে। তাঁদের সময়ে তাঁরা গুরুজনদের চোখের দিকেও তাকাতেন না। আর এখন? এখনকার জমানা অন্যরকম। আদব-কায়দা উঠে যাচ্ছে। নাইলে বিশ-বাইশ বছরের একটা সেইদিনের মেয়ে কি তাঁকে ধমক দিতে পারে! বুড়ামিয়া বলতে পারে?
করিম আলী লুঙ্গি হাঁটুর নিচে নামিয়ে শুকনো মুখে বললেন, “ঘুমের মধ্যে ছিলাম। টের পাইনাই মা।”
কথাটি বলেই করিম আলী আফসোস করলেন। এই বেয়াদব মেয়েটিকে মা ডাকা ঠিক হয়নি। এই মেয়ে তাঁকে অসম্মান করে বুড়ামিয়া বলেছে।
মেয়েটি বলল, “ঠিক আছে। পরেরবার জানি খেয়াল থাকে।”
“হুঁ থাকবে।”
“আপনার সাথে আর কেউরে দেখতেছি না। আপনি একাই আসছেন?”
“আমার সাথে আমার নাতনি ফুলমণি আছে।”
“আর কেউ নাই?”
“না।”
“ফুলমণি কই?”
“এইখানেই কোথাও আছে। ছোটমানুষ... একজায়গায় কি স্থির থাকে?”
“হুম। খানা-দানা কিছু পাইছেন?”
“হুঁ পাইছি।”
“কী পাইছেন?”
করিম আলী মাথার পিছনের পুটলির দিকে ইশারা করে বললেন, “চিড়া, মুড়ি, বিস্কুট আর পানি।”
“খেচুড়ি পাননাই?”
“না।”
“আইচ্ছা। এখন ভাত খেচুড়ি নিয়ে চিন্তা করার সময় না। এখন যা পাইবেন তাই খাইতে হইব। ক্ষিধা পাইলে বাঘেও ধান খায়। বুঝছেন?
“হুঁ।”
“আজকে বিকালের মধ্যে আমাদের জন্যে আরও খানা আসবে। ঢাকা থেকে অনেক মানুষ আসতেছে আমাদেরকে খানা দেওয়ার জন্য।”
“হুঁ।”
“বন্যা হইছে ভালোই হইছে... কী কন বুড়ামিয়া! বইসা-বইসা খানা পাইতেছি। হি হি হি।”
করিম আলীর মনে হলো এই মেয়েটার গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় দিতে পারলে মনটা শান্তি হতো। বেহায়ার মতো হাসছে। এই মেয়ে নির্ঘাত ফকিরনি ঘরের মেয়ে। মানুষের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে হাত পেতে খানা চাওয়া এদের স্বভাব। সুযোগ পেলে যে চুরি করবে না তাই বা কে বলবে! থাপ্পড়টা দিতে পারলে খুব ভালো লাগত। কিন্তু দেয়া যাচ্ছে না। করিম আলীর শরীর খুবই দুর্বল। শোয়া থেকে উঠে বসতেও অনেক কষ্ট হয়।
আজ চারদিন হলো করিম আলী এখানে এসেছেন। এটা একটা স্কুল। তিনতলা ভবন। বন্যায় যাদের ঘরবাড়ি ভেসে গেছে তারা সবাই স্কুলে এসে আশ্রয় নিয়েছে। স্কুলটা এখন আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রতিটি ক্লাস মানুষে ভর্তি। যে যার মতো জায়গা করে নিয়েছে। বারান্দাতেও হাঁটার জায়গা নাই। এখানে সেখানে মানুষ এলোপাথাড়ি শুয়ে আছে।
বন্যায় করিম আলীর ঘর ভেসে গেছে। এইরকম বন্যা সারাজীবনে তিনি আর কখনো দেখেননি। আরবছর বন্যা হলে সর্বোচ্চ হাঁটুসমান পানি হতো। কিন্তু এইবার পানি হয়েছে মাথা বরাবর। অন্য অনেকের তো ঘরের চালের উপর দিয়ে পানির স্রোত বয়ে গেছে। করিম আলী নিজের চোখে নিজের ঘরকে টুকরো-টুকরো হয়ে পানিতে মিশে যেতে দেখেছেন। তাঁর খুব একটা দুঃখ হয়নি। তবে প্রচণ্ড বিস্মিত হয়েছেন। পানি এইভাবে মানুষের ঘর ভাসায়ে নিতে পারে!
ঘর চলে গেছে এই নিয়ে করিম আলীর মনে দুঃখ তেমন নেই। তাঁর সবচাইতে বেশি দুঃখ গরুটার জন্য। সদ্য বাচ্চা বিইয়েছে। বাছুরের বয়স সতের দিন। তিড়িংতিড়িং করে লাফাত। ক্ষিদা লাগলে ছুটে এসে মায়ের দুধের বাঁট মুখে পুরে চুকচুক করে চোষা আরম্ভ করত। বন্যার পানি যখন বুকসমান হয়ে এলো তখন করিম আলী বুঝতে পারলেন আর রক্ষা নাই। ঘরবাড়ি সবকিছু ভেসে যাবে। তিনি একটা নৌকার ব্যবস্থা করে ফুলমণিকে নিয়ে উঠে পড়লেন। কিন্তু গাভী আর বাছুরটার কোনো ব্যবস্থা করতে পারলেন না। তারা চোখের সামনে বন্যার স্রোতে ভেসে গেছে। গাভীটা ভেসে যাওয়ার সময় তাঁর দিকে তাকিয়ে অনবরত হাম্বা-হাম্বা করছিল। করিম আলী অন্যদিকে মুখ সরিয়ে নিলেন। মাঝেমাঝে মানুষকে নির্দয় হতে হয়।
ফুলমণিকে নিয়ে করিম আলী বিরাট যন্ত্রণায় আছেন। এই মেয়ে জন্মের সময় তার মাকে খেয়েছে। তার বাপ আরেকটা বিয়ে করে নতুন সংসার ধরেছে। মেয়েকে দিয়ে গেছে নানার কাছে। এখন এই মেয়ে নিয়ে করিম আলীর মাথাপাগল অবস্থা। বন্যার পানিতে গোটা জেলা পানিতে ডুবে আছে, অথচ তার মনে আনন্দের শেষ নাই। পানি যত বাড়ে তার আনন্দও তত বাড়ে। সে মনে করে তাদের গ্রামটা এখন নদী হয়ে গেছে। এই নিয়ে তার মনে অপার আনন্দ। খুশিতে গদগদ হয়ে বলে, “আমাদের গেরাম তো নদী হয়ে গেছে নানা।”
“হুঁ হয়েছে।”
“কী নদী? নদীর নাম কী? ছাতকী?”
“না। এই নদীর নাম বন্যা।”
“নদীর নাম বন্যা, মানুষ করে কান্না। মিলছে না নানা?”
“হ মিলছে। এখন চুপ কর। কানের কাছে বকবক করবি না।”
“করব। একশবার বকবক করব।”
“চুপ কর কইলাম।”
“চুপ করব না। বকবক বকবক।”
“এখন কিন্তু তুই আমার হাতে মাইর খাইবি।”
“খাইলে খাব। বকবক বকবক বকবক...”
করিম আলী আর ধৈর্য্য রাখতে পারেন না। ফুলমণির গালে তিনি চড় বসিয়ে দেন। ফুলমণি তাতে রাগ করেনা। তার অভ্যাস আছে। সে দুই মিনিট চোখের পানি ফেলবে। পাঁচ মিনিট গাল ফুলিয়ে থাকবে। ছয় মিনিটের মাথায় সে স্বাভাবিক। দশ মিনিট পর আবার কোনো একটা ছন্দ মিলিয়ে এসে নানাকে জিজ্ঞেস করবে, “নানা মিলছে না?”
কিন্তু গত দুই ঘন্টা ধরে ফুলমণির খবর নাই। সে এমন মেয়ে নানাকে ছাড়া দশ মিনিট থাকতে পারে না। অথচ দুই ঘন্টা হয়ে গেল সে নিখোঁজ! করিম আলীর নিজের উপরে প্রচণ্ড রাগ হলো। ফুলমণি এতিম শিশু। তার বয়স সাড়ে ছয়। এখনই তার দুষ্টামি করার আসল বয়স। সে দুষ্টামি করবে না তো কে করবে? তাকে চড় মারা ঠিক হয়নি। ছোট একটা মেয়ে, অভিমান করে কোথায় লুকিয়ে আছে কে জানে!
করিম আলী অনেক কষ্টে দেয়াল ধরে উঠে বসলেন। তাঁর এখন শুয়ে থাকলে চলবে না। ফুলমণিকে খুঁজতে হবে। এত-শত মানুষের ভিতরে তাকে খুঁজে পাওয়া সহজ হবে না। অনেক পরিশ্রম যাবে। তিনতলা ভবনে উঠানামা করতে হবে। কিন্তু করিম আলী শরীরে বল পাচ্ছেন না। পেটে প্রচণ্ড ক্ষিধা। তবু তিনি খেতে পারছেন না। এর কারণ ফুলমণি চিড়া-বিস্কুট কিছুই খায় না। দুইমুঠ মুড়ি আর তিনঢোক পানি খেয়ে সারাদিন কাটিয়ে দেয়। এতিম শিশুটাকে ফেলে করিম আলী কিছুতেই পেট ভরে চিড়া খেতে পারেন না। তাঁর মন টানে না। তিনিও দুইমুঠ মুড়িতে হাত দিলেন।
ফুলমণিকে খুঁজতে খুঁজতে বিকাল হয়ে গেল। কিন্তু তাকে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। তিনতলা পুরোটাতেই খোঁজা হয়েছে। সে ভবনের কোথাও নেই। করিম আলী দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। তাঁর ভয়-ভয় করতে লাগল। ফুলমণি যদি ভবনের বাইরে গিয়ে থাকে তাহলে বিপদ। চারদিকে অঢেল পানি। বন্যার প্রবল স্রোত। এই স্রোতের মাঝে সে কোথায় যাবে?
করিম আলী আবারও ফুলমণিকে খুঁজতে আরম্ভ করলেন। কিন্তু এবার আর পুরো ভবন শেষ করতে পারলেন না। দোতলার অর্ধেকটা দেখার পর হঠাৎ করেই সমস্ত মানুষজন ছুটোছুটি আরম্ভ করে দিল। সবগুলো কক্ষের সমস্ত আশ্রিত মানুষ বারান্দায় এসে ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে গেল। করিম আলীও তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন।
স্কুলের সামনে বেশ কয়েকটি নৌকা এসে থেমেছে। সবকটা নৌকাভর্তি খাবার আর পানীয়। কয়েকজন লোক রেইনকোট পরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কোমর পর্যন্ত পানি। তাদের মধ্যে একজনের হাতে মাইক। সে সবাইকে সালাম জানিয়ে বলল, “আমরা ঢাকা থেকে এসেছি আপনাদের সহযোগিতা করার জন্য। আমাদের কাছে চার হাজার মানুষের খাবার আছে। আমরা জানি বিগত কয়দিনে আপনারা কোনোমতে শুকনো খাবার খেয়ে দিন যাপন করছেন। কিন্তু আমরা সবাই বাঙালী। আমাদের ভাত না হলে চলে না। আমরা আপনাদের জন্য সামান্য খিচুড়ির আয়োজন করেছি। আপনারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করে শান্ত হয়ে অপেক্ষা করলে আমরা বণ্টনের কাজ শুরু করতে পারি।”
আশ্রিত সকল মানুষ হাততালি দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল।
খাদ্যসামগ্রী বন্টনের কাজ চলছে। একজন একজন করে সবাইকে দেয়া হচ্ছে। করিম আলী এখনো খাবার পাননি। ঠিক পাননি নয়— তিনি মূলত সিরিয়ালেই দাঁড়াননি। মুখ কালো করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। সিরিয়ালে দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে না। ফুলমণি খিচুড়ি খেতে ভালোবাসে। তাকে পাওয়া না গেলে তিনি খিচুড়ি দিয়ে করবেন কী? ফুলমণি ছাড়া ঐ বস্তু তাঁর গলা দিয়ে নামবে না।
“কী খবর বুড়ামিয়া? খানা পাননাই?”
করিম আলী মুখ না দেখেই বুঝতে পারলেন সেই বেয়াদব মেয়েটি এসেছে। তাঁর মেজাজ খারাপ হলো। তবু তিনি শান্ত গলায় বললেন, “আমার খানা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। তুমি তোমার খানা নিয়ে চিন্তা কর।”
“আমার আবার চিন্তা কী? বইসা-বইসা খানা পাইতেছি। আরামের আরাম। হি হি হি।”
করিমা আলীর সারা গা জ্বলে উঠল। ফকিরনি ঘরের মেয়েটার কোনো লাজলজ্জা নাই। বসে-বসে খাবার পাওয়ার ব্যাপারটা তো ভিক্ষার মতই। এই মেয়ের মাথায় সেটা নাই। করিম আলী মৃদু ধমক দিয়ে বললেন, “অযথা হাসাহাসি করবা না। যাও এখান থেকে।”
মেয়েটি সামান্য অবাক হয়ে বলল, “বুড়ামিয়ার দেখি মাথা গরম। কী হইছে বুড়ামিয়া?”
“কিছু হয়নাই। তোমারে যাইতে বলছি যাও।”
“আরে এত চেত দেখান কেন? কী হইছে বলেন। খানা নেননাই?”
“না।”
“নিবেন না?”
“না।”
“কেন? এখন তো খানা ভালো দিতেছে। খিচুড়ি আর সিদ্ধ ডিম।”
“দিক। আমি নিব না।”
“আরে কেন নিবেন না সেইটা তো বলেন। খালি তখন থেকে নিব না নিব না করতেছেন।”
করিম আলী কিছুই বললেন না। বেয়াদব মেয়েটা এখনো যাচ্ছে না দেখে তাঁর মেজাজ আরও খারাপ হচ্ছে। মেয়েটা যেভাবে কথা বলছে তাতে মনে হয় না তার কথা আজ শেষ হবে। সরতে হলে তাঁকেই সরে যেতে হবে।
“আপনার নাতনি কই বুড়ামিয়া? নামটা জানি কী? ফুলমণি না?”
“হুঁ।”
“দেখছেন আমার মনে আছে?”
“হুঁ।”
“হুঁ হুঁ করতেছেন কেন? ফুলমণি কোথায় বলেন। তারে তো একবারও আপনার সাথে দেখলাম না।”
করিম আলী বলবেন না বলবেন না করেও বলে ফেললেন, “ফুলমণিরে খুঁইজা পাইতেছি না।”
মেয়েটি চোখ কপালে তুলে বলল, “সর্বনাশ! খুঁইজা পাইতেছেন না মানে? কই গেছে সে?”
“জানিনা।”
“জানেন না কী আবার! আপনি না বলছেন সে আপনার সাথে এখানে আসছে?”
“আসছিল। আমারে খুব ত্যক্ত করতেছিল। এইজন্য একটা চড় দিছিলাম। সে রাগ করে কোথায় জানি চলে গেছে। কিন্তু আমি বুঝতেছি না সে যাবেটা কোথায়? চতুর্দিকে থৈ থৈ পানি।”
“পুরা বিল্ডিংয়ে খুঁজছেন?”
“খুঁজছি। সে এখানে নাই।”
মেয়েটি খানিকক্ষণ কথা বলল না। ভুরু কুচকে কী যেন চিন্তা করল। তারপর সামান্য ইতস্তত করে বলল, “ফুলমণি সাঁতরাইতে পারে বুড়ামিয়া?”
করিম আলী ধরা গলায় বললেন, “না।”
“তাইলে আর চিন্তা নাই।”
“চিন্তা নাই মানে! কী বল তুমি?”
“ঠিকই বলতেছি। সাঁতার না জানা মানুষ পানি খুব ভয় পায়। তারা পানির ধারেকাছেও যায় না। ফুলমণিও বাইরে কোথাও যায়নাই। এইখানেই আছে। হয়ত আপনার চোখে পড়েনাই।”
মেয়েটির কথায় করিম আলী তেমন একটা আশ্বাস পেলেন না। তিনি জানেন ফুলমণির মারাত্মক পানির নেশা। সে সাঁতার না জানলেও পানিকে মোটেই ভয় করেনা। বরং পানি দেখলে তার আরও আনন্দ হয়। সে কি তবে পানিতে নেমে গেছে? করিম আলীর মাথা ঝিমঝিম করছে। ফুলমণি যদি পানিতে নামে তাহলে সব শেষ। তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
“বুড়ামিয়া।”
মেয়েটির গলা নরম হয়ে এলো। এবার আর তার কণ্ঠে বুড়ামিয়া শুনে খারাপ লাগল না। করিম আলী বললেন, “হুঁ বল।”
“আপনি তাইলে এইজন্য খানা নেননাই?”
“কীজন্য?”
“এই যে ফুলমণিরে ছাড়া খাইতে পারবেন না তাই।”
করিম আলী একথার জবাব দিলেন না। তাঁর চোখ ভিজে উঠেছে। তিনি হঠাৎ করেই ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে শুরু করলেন।
.
ফুলমণিকে পাওয়া গেল রাত দশটার সময়। সে চুপিচুপি করিম আলীর কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, “নানা, এই যে দুই প্যাকেট খেচুড়ি। তাড়াতাড়ি লুকাইয়া ফেল। কেউ যেন না দেখে।”
ফুলমণিকে দেখে করিম আলীর খুশি হবার কথা। কিন্তু তিনি তার কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন। হাতে খিচুড়ির প্যাকেট দেখে বললেন, “কই থেকে আনছস?”
ফুলমণি ফিক করে হেসে বলল, “দোতলার এক বেটির কাছ থেকে।”
“বেটি তোরে দিছে?”
“না। চুরি কইরা আনছি।”
করিম আলী চোখ কপালে তুলে বললেন, “তুই চুরি করছস!”
“হ করছি। তোমার জন্য করছি।”
“আমার জন্য! আমি তোরে বলছি?”
“বলা লাগে না। তুমি যে বিকালে খেচুড়ি লওনাই আমি দেখছি। তুমি খেচুড়ি লইলে আমার আর চুরি করা লাগত না।”
“এখন ঐ বেটি কী খাইব?”
“কোন বেটি?”
“যার কাছ থেকে চুরি করছস।”
“সেইটা নিয়া তোমার চিন্তা করা লাগবে না। ঐ বেটি নিজেও চোর। তিনবার লাইনে দাঁড়াইয়া তিনবার খেচুড়ি নিছে।”
করিম আলী হতবাক হয়ে গেলেন। ফুলমণি বলল, “অবাক হইয়া লাভ নাই নানা। আমি জানি তুমি আমারে ছাড়া খেচুড়ি খাইতে পারবা না। এইজন্য তুমি খেচুড়ি লওনাই। এখন আমি আছি, খেচুড়িও আছে। আসো দুইজনে একসাথে খাই।”
করিম আলী আর ফুলমণি একসঙ্গে খিচুড়ি খাওয়া শুরু করল। প্লেট নাই এখানে। প্যাকেট থেকেই খেতে হচ্ছে। খেতে-খেতে করিম আলী বললেন, “তুই কই গেছিলি? আমি যে তোরে খুঁইজা পাইনাই।”
ফুলমণি ফটাফট বলল, “আমি এইখানেই লুকাইয়া ছিলাম। যাতে তুমি আমারে না পাও। এইটা তোমার শিক্ষা। আর যদি কোনোদিন আমারে মারছো, তাইলে আমি আর এইখানে থাকব না। সোজা গিয়া বন্যা নদীতে ডুব দিব। তখন তুমি কানবা, হায় হায় করবা। মিলছে না নানা?”
করিম আলী সঙ্গে-সঙ্গে ফুলমণির গালে একটা চড় বসালেন। ধমকের সুরে বললেন, “খানার সময় এত বকবক করছ কেন? চুপচাপ খানা খা।”
চড় খেয়ে ফুলমণি হেসে উঠে বলল, “তুমি দেখি এখনই কানতেছ। আমি তো এখনো মরিনাই। হি হি হি।”
সত্যি-সত্যিই করিম আলীর চোখে পানি এলো। এত চমৎকার একটা মেয়ের মা-বাপ নাই। তাঁর মতো বুড়োমানুষের সঙ্গে থেকে এতিম জীবন পার করছে। এর কোনো মানে হয়?
.
.
লেখক : বিবাগী শাকিল
২৬/০৬/২০২২
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০২২ সকাল ৭:৩৪