আমার ভাগ্নি— মীরা। আমাকে সে অসম্ভব ভালোবাসে। জন্মের পর থেকেই তো আমার কোলে-কোলে বড় হয়েছে; ভালোবাসাটাই স্বাভাবিক। তাকে আমি দুয়েকটা চড়চাপড় তো দূরের কথা; একটা সামান্য ধমকও দিতে পারি না। ওর নাকি কলিজা ভেঙে আসে। প্রথমে ঠোঁট ফুলিয়ে তারপর বিশাল হা তুলে তারস্বরে চেঁচিয়ে শুরু হয় তার কান্না। সেই চিৎকারে সকলের কান ফেটে ঝালাপালা হয়ে যায়।
একদিন ঘরে ঢুকেই শুনলাম মীরা নাকি আজ আল্লাহর কাছে বলেছে— সে যেন কখনো বড় না হয়। আমি বললাম‚ ‘তুমি বড় হতে চাও না কেন?’
মীরা শিশুমনে বলে দিল‚ ‘আমি বড় হলে তো নানু মরে যাবে।’
শিশুরা মাঝেমধ্যে ভয়ঙ্কর কথা বলে ফেলে। মীরার মুখের এই কথাটিও ভয়ঙ্কর। সে জানে না সে কী বলে ফেলেছে। আমি শুনে স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। পরে বললাম‚ ‘তোমাকে এ কথা কে বলেছে?’
মীরা ইনিয়ে-বিনিয়ে আমাকে যা বলল‚ তার সারসংক্ষেপ হলো— কোনো একদিন হয়তো আমার মা তাকে বলেছে, তুমি বড় হতে-হতে নানু তো মরে যাব।
মৃত্যু কী জিনিস মীরা এখনো বোঝে না। আবার সে মৃত্যুকে কীরকম করে বোঝে, সেটা আমরা বুঝি না। তবে এটুকু বুঝতে পারি মৃত্যু জিনিসটা ঠিক মীরারও পছন্দ নয়। তাই সে আল্লাহর কাছে বলে দিল— আল্লাহ, আমাকে বড় করিও না। আমি বড় হলে তো আমার নানু মরে যাবে।
তার শিশুমন কীভাবে যেন বুঝে গিয়েছে— মৃত্যুতে দোষ নেই। দোষ তার বড় হওয়ায়। সে বড় হলে তবেই নানু মরে যাবে। বড় না হলে আর মরবে না। নানুকে বাঁচিয়ে রাখতে সে বড় হতে চায় না।
মীরার এইসব কর্মকাণ্ডের সাথে আমরা বেশ পরিচিত। পাঁচবছর এখনো তার হয়নি; কিন্তু তার কথা এবং উচ্চারণ খুবই স্পষ্ট। আমরা গেলাস বলি, মীরা ভুল ধরিয়ে দেয়‚ ‘আম্মু বলেছে এটা গেলাস না... গ্লাস।’
মীরাকে নিয়ে প্রচুর হাসির কথাও আছে। ওর জন্ম হয়েছে শহরে। প্রথম বসতে শেখা‚ দাঁড়াতে শেখা‚ দৌড়ানো— সবই তার শহরেই হয়েছে। শহরে বেড়ে ওঠা বেশিরভাগ শিশুরা অত্যন্ত নাজুক প্রকৃতির হয়। মীরাও তার ব্যতিক্রম নয়। সে গ্রামের উঁচুনিচু রাস্তা কিংবা খানাখন্দভরা ক্ষেতের আইল দিয়ে একলা হাঁটতে পারে না। কাউকে ধরে রাখতে হয়। একারণে তাকে আমি মাঝেমধ্যে ‘আলুকোম্বা’ বলি। শব্দটির শুদ্ধ উচ্চারণ— আলু কুমড়া। তবে আমাদের গ্রামাঞ্চলে হাবাগোবা বোকা টাইপ মানুষকে বোঝাতে এই শব্দ ব্যবহৃত হয়।
আমার মুখে আলুকোম্বা শুনে-শুনে মীরার সেটা মুখস্থ হয়ে গেছে। সে খেয়াল করেছে— তার একটিমাত্র মামা তাকে আলুকোম্বা কখন বলে। যখন সে হাঁটতে গিয়ে পড়ে যায় তখন।
তো একদিন আমি বাড়ির সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। মীরা আমার দিকে ছুটে আসছে। ছুটতে-ছুটতেই হোঁচট। মীরা পড়ে গেলে আমি এখন আর তাকে টেনে তুলি না। নিজেই নিজেকে টেনে ওঠানোর সুযোগ দেই তাকে।
যা বলছিলাম... মীরা পড়ে যাওয়ায় আমি আগুনগরম চোখ করে ওর দিকে তাকালাম। সে আমার চোখের চাহনি বুঝতে পারল। এবং সঙ্গে-সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলল‚ ‘আমি তো আলুকোম্বা‚ খালি পড়ে যাই।’
তারপর থেকে তাকে আলুকোম্বা ডাকা বাদ দিয়েছি। বাচ্চাদের নিজেকে বোকা বলে মেনে নিতে দিতে হয় না। এতে ওদের আত্মবিশ্বাস কমে যায় এবং পরনির্ভরশীলতা বাড়ে। মীরা এখন পড়ে গেলে আমি কিছু বলি না। তবে উঠে দাঁড়াতে শিখাই। নিজে তাকে টেনে তুলি না। সে নিজেই নিজেকে টেনে তোলে।
দুঃখিত, একটু ভুল হয়েছে। আমি এখন দেশের বাইরে। অর্থাৎ মীরা পড়ে গেলেও এখন তাকে টেনে তোলার সুযোগ আমার নেই। তবে আমার বিশ্বাস সে নিজেই নিজেকে টেনে তুলতে সক্ষম হবে।
বাচ্চাদের সাথে সচরাচর আমি মিথ্যা কথা বলি না। কিন্তু মীরাকে বলতে হয়েছে। বাধ্য হয়েই বলেছি। বিদেশযাত্রা শুরু হবে। গ্রামের বাড়ি ছেড়ে একেবারে বেরোচ্ছি। ঘরের সবাই কাঁদছে। আমি নির্বিকার থাকলাম। বাড়িতে অনেক মানুষ। উৎসবের মতো। মীরা উৎসব পছন্দ করে। সেজন্য বুঝতে পারছে না তার মামা তাকে ছেড়ে দূরদেশে চলে যাচ্ছে।
সিএনজি এসে গেছে। বাসস্ট্যান্ডে যেতে হবে। ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে উঠে বসলাম। বড়মামা সাথে যাচ্ছে। আমাকে ধরে মা কান্না জুড়ে দিলেন। তারপর আমার বড়বোন। এরপর মীরার মা; অর্থাৎ দ্বিতীয় বোন। তখনও অবশ্য আমার দৃষ্টি স্বাভাবিক। কিন্তু মীরার দিকে তাকিয়ে দেখি ওকে ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। তাকে ঝাপসা লাগে আমার চোখে।
বাড়ি ছেড়ে বিদায় নিয়ে ঢাকায় এলাম। একরাত থাকব এখানে। পরদিন বিকেলে ফ্লাইট। সন্ধ্যায় হাতে সময় আছে। যদিও সন্ধ্যাটুকু সময় করেই হিসেব করেছি। মেলায় আমার বই এসেছে। আমি একদিনও আমার বইসহ মেলায় ছিলাম না। সেদিন সুযোগ হলো। অনেকটা ব্যস্ত সময় কেটেছে।
রাতে বাসায় যেতেই বোনের ফোন। মীরা ঘুম থেকে উঠে কাঁদছে। কেন কাঁদছে? মামা বিদেশ চলে যাবে তাই। ওর সাথে ফোনে কথা হলো।
‘মামা‚ তুমি কোথায়?’
‘আমি তোমাদের ঢাকার বাসায়। আর তুমি আমাদের বাড়িতে।’
‘তুমি কেন বিদেশ চলে যাচ্ছ?’
‘তোমার জন্য খেলনা আনতে।’
‘খেলনা তো ঢাকায় আছে।’
আমি এইকথার কোনো জবাব দিলাম না। মীরা খুবই আর্ত গলায় বলল, ‘তুমি বাড়িতে কখন আসবা? আমার তোমার জন্য খারাপ লাগছে।’
আমি হেসে বললাম‚ ‘আমি একটুপরে চলে আসব মা।’
‘আজকে একটু পরে?’
‘না আজকে না।’
‘তাইলে কখন আসবা?’
আমি কিছু বলার মতো খুঁজে না পেয়ে মুখে যা আসলো তাই বললাম, ‘আমি অনেক পরে একটু পরে আসব। একটু পরে আবার অনেক পরে আসব।’
মীরা শিশু হওয়ায় আমার সুবিধা হয়েছে। সে আমার এই ‘একটু পরে অনেক পরে’র মানে বুঝবে না। বিশ্বাস করে বসে থাকবে— তার মামা একটু পরেই আসবে।
মীরার কাছে এই ছিল আমার নিষ্ঠুর কিন্তু নির্দোষ মিথ্যা।
মীরা প্রসঙ্গে আরেকটা কথা বলে শেষ করি। এই মেয়ে ভীষণ জেদী। ভুলভাল জেদ ধরে মায়ের হাতে কম মার খায়নি। তবুও তার জেদ ফুরোয় না।
একদিন সাফওয়ানের সাথে খেলতে-খেলতে দুজনে মারামারি লেগে গেল। দু'জনের মা এসে দু'জনকেই আবার মার লাগাল। সাফওয়ান আমার মামাতো বোনের ছেলে; অর্থাৎ ভাগ্নে। মার খেয়ে কাঁদতে থাকা দুই ভাগ্নে-ভাগ্নিকে নিয়ে আমি রওনা হলাম দোকানের দিকে। দু'জনকে কিছু কিনে দিয়ে শান্ত করতে হবে। আমার হাতে চিকন একটা খড়ি। ওদের মামার আবদার মেটাতে দোকানে নিয়ে গেলেও মামার শাসন থেকেও বঞ্চিত করিনি। ধমক দিতে-দিতে দোকানে নিয়ে গেলাম। ফেরার পথে শুরু হলো আবার তাদের ঝগড়া। ঝগড়ার কারণ— মীরা কেন সাফওয়ানের ছায়ার উপর দিয়ে হাঁটছে।
দু'জনকে আমি ছাড়িয়ে আমার দু'পাশে নিয়ে রাখলাম। তবুও তারা দু'জন ক্ষান্ত হলো না। একজন আরেকজনকে মেরে তবেই ক্ষান্তি দিবে। অথচ একটু আগে ঠিক একারণেই মায়ের হাতে মার খেয়েছিল দু'জন। আমি রাগের মাথায় হাতের খড়িটা দিয়ে মীরার পায়ে আলতো করে একটা বাড়ি দিলাম। অবশ্য ব্যথা না পাওয়ার মতোই। মীরা হাসতে-হাসতে আমাকে রাগানোর জন্য বলল‚ ‘লাগেনাই লাগেনাই।’
আমার রাগ আরও বাড়ল। এবার তার শিনায় মারলাম। তাও বলল লাগেনাই। তখনও আমি বুঝতে পারিনি আসলে সে ব্যথা পাচ্ছে, কিন্তু জেদের কারণে বলছে না। রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে এবার লাগার মতোই বাড়ি দিলাম। মীরা প্রথমে অবিশ্বাসের দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকালো। মানে আমি যে তাকে মারতে পারি সেটা সে বিশ্বাসই করতে পারছে না। তারপর মীরা ‘লাগেনাই’ বলতে-বলতে হাসতে শুরু করলো। এমনই সেই হাসি যে হাসতে-হাসতে ওর দম বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। পরক্ষণেই দেখলাম মীরা চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো। যেখানে-যেখানে মেরেছি সেখানে হাত বুলিয়ে-বুলিয়ে বলল, ‘শি ধরছে।’
আমার কলিজাটা তখন মোচড় দিয়ে উঠল। এই প্রথম আমি ওকে মারলাম। ওর সেই অবিশ্বাসী দৃষ্টি, হাসতে-হাসতে কেঁদে ওঠার সেই মুহূর্ত এখনো আমাকে পীড়া দিয়ে যাচ্ছে। আমি ভুলতে পারিনা। আমরা যখন ছোট ছিলাম, আম্মু যখন আমাদের মেরে আবার আদর করে বলত— ‘তোদের মারলে তো আমি ব্যথা পাই’— তখন আমি মনে-মনে বলতাম, ঢং... মেরেধরে এখন আবার ঢং করতে আসছে। এখন বুঝতে পারছি এসব ঢং নয়। এটা যে কী তা আমি নিজেও জানিনা।
মীরাকে ছেড়ে বিদেশে এসেছি। আসতে হয়েছে। পরম করুণাময় চাইলে আবার কোনো এক বিকেলে দেশে ফিরব। মীরাকে দেখব। সে তখন অনেক বড় হয়ে যাবে। আমি তখন ওই মীরাকে চিনতে পারব না। ওকে আমার ভালো লাগবে না। আমায় দেখে সে উল্লাসিত হয়ে দু'হাত বাড়িয়ে কোলে ওঠার জন্য ছুটে আসবে না। মামা বলে গালে চুমু খাবে না। সে তখন আর আমার ছোট্ট সোনামা-টি থাকবে না।
জীবন আমার কাছ থেকে মীরাকে... বিশেষ করে মীরার শৈশবকে কেড়ে নিয়ে গেল।
[মীরাকথন]
বিবাগী শাকিল
মক্কা‚ সৌদি আরব।
২৭-০২-২০২২
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুন, ২০২২ ভোর ৫:০১