আমি এক দুঃখী মেয়ের গল্প জানি—
যার নরম বুকে চেপে আছে শক্ত অনেক পাথর।
আমি এক দুঃখী মেয়ের কিচ্ছা জানি—
যার পাশবিছানায় শুয়ে থাকে মৃত স্বপ্ন নিথর।
যার পায়ের তলায় মাটি আছে বড্ড নড়বড়ে;
তার ঠোঁটের ডগায় গল্পকথা বোবা হয়ে ঝরে।
তার চোখের ভেতর গুমরে কাঁদে স্তিমিত বাতি‚
তার শহরেতে বাস হলেও বিষম দেহাতী।
আমি তাকে প্রায়ই দেখি বিকেল কি সন্ধ্যায়—
মুখ তার দুখে ভরা‚ সুখ বাঁধা বন্ধ্যায়।
শাড়ি খুব এলোমেলো— ঝড়ো হাওয়া চুলে।
শেষ কবে হেসেছে সে মনপ্রাণ খুলে?
দেখে তাকে ভার হয়ে যায় মন আমার।
কাছে গিয়ে শুধি তাকে‚ ‘কী বিষয় তোমার?’
দুঃখী ঠোঁটে ফুল হয়ে ফুটে উঠে হাসি—
‘জীবন আমার প্রভু‚ আমি তার দাসী।’
এই বলে চলে গেল দ্বার দিল আটকায়;
তার বলা কথাখানি আজও আছে খটকায়।
সেই থেকে তাকে খুব মনে ধরে আমার‚
কার মুখে শুনি যেন নীলা নাম তার।
ঘরে তার পাঁচ বোন— মা'র আছে জরা।
বাপ কবে মরে ভূত‚ সংসারে খরা।
নীলা ছিল পতিগৃহে কিছুমাস আগে;
মার খেয়ে ফিরে এলো এই পৌষ-মাঘে।
তার মদ্যপ স্বামী তাকে বলে বারবার—
‘যৌতুক ছাড়া ছাঁই কী বালের সংসার!’
নীলার শরীরে ভরা নিয়তির ঘাত—
রোদ নামে শহরেতে‚ তার ঘরে রাত।
এতসব জেনে আমি ভেঙেচুরে খানখান‚
মনভূমি হয়ে গেছে কারবালা ময়দান।
রোজ মেরে যাই উঁকি নীলার দরজায়‚
রোদে পুড়ে কয়লা সে‚ কাদা হয় বর্ষায়।
চোখে ভাসে অবিরত নীলার করুণ মুখ—
আমি তার দেখা পেতে হয়ে পড়ি উৎসুক।
এইভাবে দিন যায় রাত ফিরে আসে‚
আমায় দেখে নীলা শুকনো হাসে।
বিষাদের খনি ভরা তার সেই হাসি—
আমি তার সেই হাসি বড় ভালোবাসি।
তারপর একরাতে নিভৃতে নির্জনে—
ঘুম ভেঙে উঠে বসি‚ শুধাই আপনমনে।
আমার জীবনে কি নীলাকেই চাই?
মুখ থাকে কথাহীন‚ মন বলে চাই।
পরদিনই ছুটে যাই নীলাদের গলিতে—
সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে মনকথা বলিতে।
বিধিবাম সেদিন আর নীলা নেই সেথা—
সে গলির সকলির মুখে তার কথা।
রাতের আঁধারে নীলা চলে গেছে কোথা;
সাথে ছিল শাড়ি আর একবুক ব্যথা।
তার ঘরে মা-বোন অতি স্বাভাবিক—
নীলার হারিয়ে যাওয়া যেন নব দিক।
আমি মন ভার করে ফিরে আসি রাতে;
হাঁটু ভেঙে আসে মোর বসি ফুটপাতে।
নীলার বিরহে আমি যন্ত্রণাকাতর—
আমি তার বুকে চাই আমার নিজের ঘর।
সে আশায় গুড়েবালি জানি আমি রোজ;
কোনোভাবেই মেলে না আমার নীলার খোঁজ।
কেন ভালোবাসি তাকে‚ কেন এই মায়া?
নীলা ছাড়া চাইনি তো আর কারো ছায়া।
কী চেয়ে কী পেলাম হিসেবের গরমিল;
ভালোবাসা হলো মোর ডানাভাঙা গাঙচিল।
আমার ভালোবাসা বুঝি মাঠে মারা গেল!
মায়াবতী নীলা মোর কোথা হারালো?
বুকে ব্যথা চেপে ধরে রুখে ফেলি মন—
নীলা নেই তবু কেটে যায় এ জীবন।
সময় আর স্রোত কারো ধার ধারে না‚
নীলাকেও আজকাল মনে পড়ে না।
এইভাবে সেইভাবে কাটে রাত-দিন—
হঠাৎ আচমকা জীবনে এলো সেইদিন।
যেদিন আমি জানলাম নির্মম সত্য‚
কী করে বলি সে-তো নয় অত কথ্য!
নীলা আজ দেহ বেচে জীবিকার তাগিদে—
কখনো বা নগদ আবার কখনো বাকিতে।
শরীর বিকিয়ে সে আনে যেই টাকা‚
তাতে তার স্বজনের মিটে খাওয়া-থাকা।
সেদিন হবে রাত কতো; এগার কি বারো—
নীলা দাঁড়িয়ে আছে অপেক্ষায় কারো।
আমি ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে তার সামনে‚
বলি‚ ‘তুই হ আমার নিবি যত দাম নে।’
‘তবু তুই ফিরে আয় খোদার দোহাই।’
‘তোর বুকের খাঁজে আমি আমায় রাখতে চাই।’
নীলার রঙিন ঠোঁটে শুকনো হাসি—
বলে‚ ‘ধুর‚ বলো না তো পঁচা কথা বাসি।’
‘চাইলে বলো দেখাতে পারি আমার বুকের খাঁজ।’
‘জায়গা নেই কো তোমার জন্যে— হাজারজনের বাস।’
‘অতীতে তোমায় বলেছি আমার এমন কুফা রাশি।’
‘জীবন আমার প্রভু আর আমি তার দাসী।’
এইটি বলে চলে গেল আমার প্রিয় নীলা।
তার চোখেতে জল দেখেছি‚ মুখে হাসির মেলা।
ধপ করে বসে পড়ি ফাঁকা প্ল্যাটফর্মে—
নীলার কথাগুলো খোঁচা দেয় মর্মে।
এই যদি হয় মোর নীলার দাসত্ব;
তার প্রভু ‘জীবনের’ এই কি প্রভুত্ব?
এরকম জীবনের শেষ করো লীলা—
নাহলে সে বিয়োবে আরও বহু নীলা।
আমি এক দুঃখী নীলার গল্প জানি—
যার নরম বুকে চেপে আছে শক্ত অনেক পাথর।
আমি এক দুঃখী নীলার কিচ্ছা জানি—
যার পাশবিছানায় শুয়ে থাকে মৃত স্বপ্ন নিথর।
---------------
আমি এক দুঃখী মেয়ের গল্প জানি
বিবাগী শাকিল
১২/০১/২০২২
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০২২ ভোর ৪:১৯