“আপনি কে?”
প্রশ্নটি যে করেছে, তাকে আমার কাছে মনে হলো বিশ-বাইশ বছরের তরুণী। তার পরনে বহুল ব্যবহৃত মলিন শাড়ি। মাথায় লম্বা ঘোমটা। ঠিকমতো কপালও দেখা যাচ্ছে না। কথা বলছে কীরকম আড়ষ্ট হয়ে। কথা বলার ভঙ্গি আর স্পষ্ট উচ্চারণ শুনে মনে হলো এই মেয়ের এখানে থাকার কথা না। এর আসলে থাকার কথা গান শেখানোর স্কুলে। সে সেখানে স্পষ্ট উচ্চারণে রবীন্দ্রনাথের ফাগুন হাওয়া গাইবে। কিংবা নজরুলের কারার ঐ লৌহ কপাট।
আমি স্নেহের সঙ্গে বললাম, “তুমি আনিসের মেয়ে? কী নাম তোমার মা?”
তরুণী একটুও অপ্রস্তুত না হয়ে স্পষ্ট স্বরে বলল, “আমি আনিসের স্ত্রী। আমার নাম রাবেয়া।”
আমি চমকে উঠলাম। একধরনের অস্বস্তি অনুভব করলাম। কিন্তু মুখের ভঙ্গিএমন রাখলাম যেন কারো স্ত্রীকে তার মেয়ে মনে করা খুবই সাধারণ ভুল। এবং এতে লজ্জার কিছু নেই। তবু একটা কারণে আমি মনে-মনে লজ্জা পেলাম। রাবেয়াকে একটু আগে আমি মা ডেকেছি। এখন থেকে তাকে ভাবী ডাকতে হবে।
“আনিস কখন ফিরবে জানেন?”
“ওর ফেরার ঠিক নাই। যখন মন চায়।”
“আমার হাতে তো কাজ আছে ভাবী। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারব না মনে হয়।”
রাবেয়া কিছু বলল না। আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার পেছনে তাকাল। রান্নাঘর থেকে খুব ক্ষীণ একটা শব্দ আসছে। তেলে ভাজার শব্দ। খুব সম্ভব মাছজাতীয় কিছু আজ রান্না হচ্ছে। ভাজাভুজার ক্ষেত্রে মেয়েদের অন্যরকম দক্ষতা। তারা চোখে না দেখে শুধু শব্দ শুনেই বুঝতে পারে কতটুকু ভাজা হয়েছে, কিংবা আর কতমিনিট লাগবে ভাজতে। আমার মা'ও এই গুণে গুণান্বিত ছিলেন। তিনি চলে গেছেন; তাঁর গুণ দিয়ে গেছেন আমার স্ত্রীকে। তাকে দেখেই আমার একরকম অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে— মৎস্যজাতীয় আমিষ খাবার ফোস্কাপড়া গরম তেলে ভাজতে সর্বনিম্ন পাঁচ থেকে সাত মিনিটের মতো লাগে।
রাবেয়া সম্ভবত এখনো এই দক্ষতা রপ্ত করতে পারেনি। সে তেলে ভাজার শব্দ শুনে কিছুটা বিচলিত হলো। আমার ধারণা গরম তেলে মাছ ছেড়ে দিলে তা কয়মিনিট পর উল্টাতে হয়, সেটাও এই মেয়ে জানে না। অবশ্য না জানারই কথা। অল্পবয়সী মেয়ে... রান্নাশিল্প এত কমবয়সে আয়ত্ত করা যায় না।
রাবেয়াকে একটু অস্থির দেখা গেল। সে বলল, “আপনি ঘরে এসে বসুন। আমি রান্নাঘর থেকে আসছি।”
আমি হেসে বললাম, “আপনাকে তো এখনো আমার পরিচয় দেয়া হয়নি। আমাকে না চিনেই ঘরে ঢোকাবেন?”
“পরিচয় রান্নাঘর থেকে এসে জানব। আপনি বসুন।”
আমি বসলাম। গ্রীষ্মকালের দুপুর। ঢাকা শহরে কাকমারা গরম পড়েছে। প্রাণ ওষ্ঠাগত হবার মতো অবস্থা। তার মধ্যে আমি বসে আছি আমার বন্ধু আনিসের বাসায়। বাসা কী... এরচেয়ে পাখির বাসা ভালো; আকারে বড় হয়। এত সংকীর্ণ কামরা আমি ঢাকা শহরের আর কোনো বাড়িতে দেখিনি। পাঁচতলা বিল্ডিং, কিন্তু আনিসের বাসা হচ্ছে নিচতলায়। ঘিঞ্জি-টাইপ বাসা। এখনই আমার কেমন হাঁসফাঁস লাগছে। আর কিছুক্ষণ থাকলে আমি নিশ্চিত দম বন্ধ হয়ে মারা যাব।
আনিস আমার হাই-স্কুলের বন্ধু। ওর পুরো নাম আনিসুজ্জামান মৃধা। এমন কাঠখোট্টা টাইপ নাম, আমরা কেউই তাকে ভদ্রভাবে ডাকতাম না। আনা, আনি, আইন্যা— যে যা পারে ডাকত। তবে সবচাইতে যে নামটা বেশি প্রচলিত ছিল, সেটা হলো— আনিচ্ছ্যা। আমি নিজেও তাকে এ নামে ডাকতাম। তার সাথে কারো যেমন খুব গাঢ় বন্ধুত্ব ছিল না, তেমনি কারো সাথে তার তেমন সামান্য শত্রুতাও ছিল না। সে সবসময়ই চুপচাপ আর শান্ত।
ছাত্র হিসাবে আনিস প্রথম শ্রেণীর। টেপ রেকর্ডারের মতো। ক্লাসে স্যার যা পড়াতেন, সে তা হুবহু হড়বড় করে বলে দিতে পারে। এমনকি পড়ানোর সময় স্যার কোন জায়গায় এসে গলা খাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করেন, কিংবা কোন লাইন পড়ানোর সময় থেমে গিয়ে ক্লাস ফাটিয়ে বিকট শব্দে হাঁচি দিয়ে বসেন— আনিস তাও নির্ভুলভাবে বলে দিতে পারে। তার এই আশ্চর্য্য স্মরণক্ষমতার জন্য গোটা স্কুলে তার খ্যাতি ছড়িয়ে যায়। স্যাররা তাকে স্নেহের চোখে দেখে। আর আমরা দেখতাম ঈর্ষার চোখে।
আনিস নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা ছেলে। তবে অর্থবৈষম্য নিয়ে তার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না। স্কুলের কোনো হৈ-হুল্লোড়েও তাকে পাওয়া যেত না। সে অনেকটা অসামাজিক ছিল। ছাত্রজীবনে যেসব দুষ্টুমি না করলে স্কুলের দিনগুলো রঙিন হয় না, আনিস সেসব দুষ্টুমির ধারেকাছে দিয়েও যেত না। সে ক্লাস ফাঁকি দিত না। স্কুল পালাত না। ক্লাস চলাকালীন সময় কাগজ দলা পাকিয়ে মেয়েদের দিকে ছুঁড়ে মারত না। আমরা প্রায়ই টিফিন পিরিয়ডে খেতে যাবার নাম করে পালিয়ে যেতাম। আনিস সেটাও করত না। বর্ষাবাদলের সময়ও স্কুলে তার শতভাগ উপস্থিতি ছিল। এসব কারণে শিক্ষকমহলে তার কদর আরো বেড়ে যায়। একদিন স্যাররা সবাই মিলে পিটি করার সময় সকলের সামনে আনিসকে স্কুলের সবচাইতে আদর্শ ছাত্র হিসাবে ঘোষণা দিয়ে বসল। তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করল। তখন মোটামুটি আমরাও নিশ্চিত ছিলাম— বড় হয়ে আনিস নিশ্চয়ই ডাক্তার নাহয় ইঞ্জিনিয়ার হবে।
কিন্তু আনিস ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হয়নি। সে হয়েছে শিক্ষক। গনকটুলির এদিকে বাচ্চাদের একটা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। অতি অল্প বেতন। শুনেছি এক লালশার্ট দিয়ে সে গত দুইবছর মাস্টারি করে যাচ্ছে। তার অবস্থা নুন আনতে পান্তা ফুরায়।
আমি দেশের বাইরে ছিলাম অনেক বছর। বন্ধুবান্ধব অনেকের সাথেই যোগাযোগ হয়ে ওঠেনি। আর আনিসের কথা তো খুব একটা মনেই পড়ত না। আমার ধারণা আনিস এমন একটা চরিত্র, যাকে আসলে কারোরই তেমন মনে পড়ে না। সে হয়ত চোখের সামনেই থাকে, কিন্তু কীভাবে-কীভাবে যেন দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়।
দেশে এসেছি কয়েক মাস হলো। সামনের মাসে আবার চলে যাব। এরমধ্যে সবার সাথেই দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। একমাত্র আনিস ছাড়া। আমার হঠাৎ তার কথা মনে পড়ল। এবং আমি খুব অবাক হয়েই লক্ষ্য করলাম— আনিসের সাথে আমার শেষ কবে দেখা হয়েছে, আমি সেটাও মনে করতে পারছি না।
ব্যাপারটা আমার মনে বেশ পীড়া দিল। আমি আনিসের খোঁজখবর করা শুরু করলাম। এখানেও আমাকে বিস্মিত হতে হলো। কারণ আনিসের খবর খুব বেশি মানুষ আমায় দিতে পারেনি। যে কয়জন তার খবর জানে, তারাও দেখি তাকে নিয়ে নেতিবাচক কথা বলে। আমার আরেকজন বন্ধু, ইদরিস নাম। সে আমাকে বলল, “ওই হারামজাদার খোঁজ দিয়া তোর কাজ কী? তার খবর নিয়া কোনো লাভ নাই বুঝছিস?”
“লাভ নাই কেন?”
“আরে ও স্কুলে থাকতে যেরকম মেলের বাইরে ছিল, এখনও ওইরকমই আছে। এখন বরং তার চেয়ে আরো বেশি হয়েছে। শালা পুরা অসামাজিক। হারামজাদার ভাবসাব দেখলে মন চায় চড়ায়ে দাঁত ফেলে দিই। সে প্রাইমারি স্কুলের টিচার, কিন্তু ভাব নেয় যেন ঢাবির প্রফেসর। একদিন যা রাগ হইছিল না!”
ইদরিসকে রাগের কারণ জিজ্ঞেস করতে সে যা বলল, তার সারসংক্ষেপ এইরকম—
ইদরিস প্রায়ই গনকটুলির ওদিকে যায়। সেকশন পার হয়ে আরেকটু এগিয়ে গেলে বড় রাস্তা। রাস্তার ধারে প্রতি মঙ্গলবার মেলার মতো মাঝারি ধরনের হাট বসে। সবকিছুই নিম্নমানের এবং কমদামী। এটাকে বলা হয় মঙ্গলি মার্কেট। এই মার্কেটে প্রায়ই আনিসের সঙ্গে ইদরিসের দেখা হয়। ইদরিস তাকে দেখে খুশি হয়ে কথা বলতে গেলে আনিস কেমন যেন ইতস্তত বোধ করে। কথাবার্তা চালিয়ে নেবার আগ্রহ তার মাঝে দেখা যায় না। দায়সারা টাইপ কথা বলে। কখনো ইদরিস জোর করলে দু-এক কাপ চা হয়ত একসঙ্গে বসে খায়। তারপর অবধারিতভাবেই কোনো একটা কাজের অযুহাত দিয়ে সে দ্রুত চলে যায়।
ইদরিস আমাকে আরো জানাল— আনিস তার বাসায় যাওয়া পছন্দ করে না। শুধু বন্ধুমহলের কেউ নয়, দেশ থেকে আত্মীয়-স্বজন এলেও নাকি তার অসুবিধা হয়। কী অসুবিধা কেউ জানে না। সে এই নিয়ে মোট তিনবার বাসা বদলেছে। আগে কাঁঠালবাগানের দিকে ছিল। তারপর নিউপল্টন। ওখান থেকে আজিমপুর কলোনি হয়ে এখন আছে গনকটুলি। তার এই নতুন ঠিকানা খুব বেশি মানুষ জানে না। আমি ইদরিসকে বলেছিলাম, “তুই ওর নতুন বাসায় যাসনাই কখনো?”
“গেছিলাম দুইবার। ওইখানেই তো মূল সমস্যা।”
“কী সমস্যা?”
“শালায় আমারে একদিন কয় ওর বাসায় আর না যাইতে। কোনো দরকার লাগলে আমি যেন তারে ফোন করি। আমার তো মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।”
ইদরিসের কথা শুনে আমার একটু অবাকই লাগল। আনিস অমিশুক ধরনের আমি জানি। কিন্তু সে বন্ধুকে বাসায় আসতে মানা করবে— এটা কেমন কথা! তাও ইদরিস আমাদের যেই-সেই বন্ধু নয়। আমরা ছোটকাল থেকে বন্ধু, প্রাইমারি ও হাই একসাথে শেষ করেছি। আমি ইদরিসকে জিজ্ঞেস করলাম, “আনিস তোকে বাসায় যেতে মানা করল কেন?”
“কেন আবার! ওর বউয়ের জন্য।”
“বউয়ের জন্য মানে?”
“বউয়ের জন্য মানে বউয়ের জন্য। তার বউ দেখতে খুবই সুন্দরী। বন্ধুবান্ধব গেলে নাকি তার বউয়ের দিকে কুদৃষ্টি দেয়। চিন্তা কর কীরকম বউপাগল হয়েছে সে।”
“আনিস তোকে এটা বলেছে?”
“মুখে বলেনাই। আমি ধারণা কইরা নিছি।”
“তোর ধারণা ভুল হতে পারে না?”
“পারে না কেন, অবশ্যই পারে। তবে এই ধারণা ভুল না। এইটা একশভাগ সঠিক। বিশ্বাস না হইলে তোরে আনিসের ঠিকানা দিতেছি। তুই গিয়া স্বচক্ষে দেখে আয়।”
আমি স্বচক্ষে দেখতে এলাম। কিন্তু এখনো আনিসের দেখা পেলাম না। তবে ইদরিস আমাকে খুব একটা ভুল বলেনি। আনিসের স্ত্রী আসলেই সুন্দরী। এবং কমবয়সী। এরকম সুন্দরী স্ত্রী ঘরে থাকলে সব স্বামীই মনে-মনে ভয় পায়। বাসায় কেউ এলে সূক্ষ্ম একধরনের আতঙ্ক অনুভব করে। আনিসও হয়ত তাই করে। তবে আমার ধারণা আমাকে দেখলে আনিস সেরকম আতঙ্ক অনুভব করবে না। আমাকে বাসায় আসতে মানাও করবে না হয়ত। কারণ স্কুল জীবনের শেষদিকে তার সাথে আমার কিঞ্চিৎ ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল।
“আপনাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম।”
রাবেয়া এসেছে। রান্নাঘরের কাজ তার শেষ মনে হয়। এখন আর তেলে ভাজার শব্দ আসছে না। রাবেয়াকে এখন আগের চেয়ে কিছুটা সতেজ লাগছে। সম্ভবত হাত-মুখ ধুয়ে এসেছে। অনেকক্ষণ বসে থেকে সত্যিই আমার বিরক্ত লাগছিল। তবু হাসি মুখ করে বললাম, “না। ঠিক আছে। কোনো ব্যাপার না।”
রাবেয়ার হাতে একটা ট্রে। সে সেটা টেবিলের উপর রেখে বলল, “খুব বেশি কিছু করতে পারিনি। চা করেছি। বিস্কুট দিয়ে চা খান।”
এখন গ্রীষ্মের দুপুর। গরমে ভেতরটা এমনিই উত্তপ্ত হয়ে আছে। এখন চা খেলে নির্ঘাত পাকস্থলী সিদ্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু মেয়েটাকে মানাও করতে পারছি না। শখ করে চা বানিয়েছে; না খেলে অন্যায় হবে।
রাবেয়া চেয়ারে বসল। শুরুতে তাকে যেরকম আড়ষ্ট লাগছিল, এখন আর তেমন লাগছে না। সে বলল, “আপনি জানেন আমি কেন আপনার পরিচয় না নিয়ে ঘরে আসতে বলেছি?”
“কেন?”
“এর একটাই কারণ। আপনি আমাকে প্রথমবার দেখেই মা বলে সম্বোধন করেছেন। অর্থাৎ একদম প্রথমেই আমার প্রতি আপনার স্নেহ এবং মমতার উদ্রেক হয়েছে। এরকম মানুষকে নিয়ে ভয়ের কিছু নাই। তাদের পরিচয় না জেনেও ঘরে আসতে বলা যায়।”
“তাই নাকি ভাবী! আপনি তো বেশ ভালো চিন্তা করেন।”
“আমাকে আপনি আপনি করে বলবেন না। আর ভাবীও ডাকবেন না। একবার মা ডেকেছেন, এখন ভাবী ডাকলে শুনতে ভালো লাগবে না।”
আমি মুচকি হেসে বললাম, “মা বলেও তো ডাকা যাবে না আর। সম্পর্ক বনছে না। আনিসটা যা করল... মেয়ের বয়সী মেয়েকে বিয়ে করে বসেছে।”
রাবেয়া মুখ কালো করে বলল, “আমি আনিসের মেয়ের বয়সী নই। সে আগে একবার বিয়েও করেনি যে আমার সমান তার কোনো মেয়ে থাকবে। আপনি আমাকে যত ছোট ভাবছেন, আমি ততটাও ছোট নই। আমার বয়স বত্রিশ। আর আনিসের ছেচল্লিশ। চৌদ্দ বছরের ব্যবধান। চৌদ্দ বছরের ছোট মেয়েকে নিশ্চয়ই মেয়ের সমান লাগে না।”
আমি অবাক হলাম। রাবেয়াকে মোটেই বত্রিশ বছর বয়সী লাগে না। মেয়েদের এই বয়সটাই একটা রহস্য। বাইশও যা... বত্রিশও তা।
আমাকে শেষমেশ রাবেয়াকে তুমি করেই বলতে হলো। তাকে আমার পরিচয় দিয়ে বললাম, “সামনের মাসে আমি আবার বিদেশ চলে যাব। ভাবলাম যাবার আগে আনিসকে একবার দেখে যাই। সে কোথায় গেছে তোমাকে বলে যায়নি?”
রাবেয়া মাথা নাড়াল, “না।”
“এখন তো গ্রীষ্মের ছুটি। স্কুলও নাই। এই ভরদুপুরে সে কোথায় যায়!”
রাবেয়া কোনো কথা বলল না। প্রশ্নটা না বোঝার ভান করল সে। আমি বললাম, “তোমাকে কিছু কথা জিজ্ঞেস করি রাবেয়া?”
“জ্বি করেন।”
“শুনেছি আনিস নাকি বাসায় কারো আসা-যাওয়া পছন্দ করে না?”
“জ্বি, ঠিকই শুনেছেন।”
“তোমার বাপের বাড়ির লোকজন আসে না?”
“প্রথমদিকে আসত। এখন আর আসে না। আমি মানা করেছি।”
“কেন?”
“আপনার বন্ধু চায় না এখানে কেউ আসুক।”
“সে চাইলেই হবে নাকি!”
“জ্বি। সে চাইলেই হবে। কতবার মাথায় ভূত চাপে সব ছেড়ে-ছুড়ে চলে যাই। যেতে পারি না। আমি চলে গেলে আপনার বন্ধু দুই মাসের মধ্যে মারা যাবে। তার খাবার-দাবারের কোনো ঠিকঠিকানা নাই। রাতে ঘুমাতে পারে না। ফ্যান চালু থাকলেও তাকে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে হয়। আর বাসায় কেউ আসলে এমন বিরক্ত হয়, বলার বাইরে।”
“বিরক্ত হয় কেন?”
রাবেয়া বিদ্রুপাত্মক হাসি হেসে বলল, “আপনার বন্ধুর লজ্জাজ্ঞান বেশি। মাসের দশদিন পান্তাভাতে রসুনের ভর্তা করে খায়, একথা কাছের মানুষজন জানলে তার জাত চলে যাবে না! মাস্টার হয়েছে না সে— মাস্টারের জাত রক্ষা করা জরুরী।”
আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম— রাবেয়ার কথাগুলো দুঃখজনক হলেও তার গলায় দুঃখের ছিটেফোঁটা নাই। যেন সে মুখস্থ বই পড়ছে।
“একবার হয়েছে কী শোনেন। ইদরিস নামে তার এক বন্ধু বাসায় আসলো। হাতে এই বড় এক চিতল মাছ। এসে আমাকে বলল— এটা আপনাদের জন্য নিয়ে এলাম ভাবী, কেটেকুটে রান্না করেন, একসাথে খাই। আনিস তখন ঘরেই ছিল। সে চট করে আমার সামনেই বলে ফেলল— তুই এক্ষণই চলে যা ইদরিস, না গেলে আমি তোকে থাপ্পড় মারব।”
“তারপর?”
“তারপর আর কী! ইদরিস ভাই মুখ কালো করে চলে গেল।”
“আনিস ইদরিসকে চলে যেতে বলল কেন?”
“উনি মাছ এনেছিল তাই। আপনার বন্ধু সেটাকে দয়া মনে করেছে। মাস্টার মানুষ তো— দারিদ্র্যতা মেনে নিতে পারলেও করুণা পারে না। আমার বাপের বাড়ির লোকজন এখানে এলে নানান খরচাপাতি করে। এসবও তার পছন্দ না। তার নাকি নিজেকে ছোট মনে হয়। আমার বাপের বাড়ি থেকে একটা কানাকড়িও সে কোনোদিন চায়নি।”
শেষকথাটা বলার সময় রাবেয়ার মুখে চাপা অহংকার দেখা গেল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তোমাদের ছেলেমেয়ে কী?”
রাবেয়া যান্ত্রিক গলায় বলল, “ছেলেমেয়ে হয়নি। বিয়ের আজ পনের বছর চলে গেল, এখনো আল্লাহপাক সেই সৌভাগ্য দেয়নি। আমি কত কান্নাকাটি করি, তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে সন্তান ভিক্ষা চাই... অথচ এটা নিয়ে আপনার বন্ধুর মাঝে একটুও দুঃখবোধ নাই। সে বলে, আল্লাহ মন চাইলে দিবে। না দিলে নাই। এটা নিয়ে হাহুতাশ করার কিছু নাই।”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “হুম, আনিস এরকমই। ছোটকালে যা ছিল, এখনও তাই আছে। কোনো দুঃখই ওকে খুব সহজে ছুঁতে পারে না।”
“এই কথাটা আপনি ঠিক বলেছেন। আমরা একসাথে সংসার করি। কত অভাব, কত দুঃখ আছে সংসারে। তবুও আপনার বন্ধু কখনো বিচলিত হয় না। সে সবসময়ই সুখী। দাঁত বের করে এমনভাবে হাসে... তখন আমারও নির্বিচারে মেনে নিতে ইচ্ছা করে— আমরা আসলে একসাথে সুখেরই সংসার করি। আমাদের কোনো দুঃখ নাই। আমাদের কোনো কষ্ট নাই। আমরা কোনোদিন চোখের পানি ফেলি না।”
বলতে-বলতেই রাবেয়ার চোখে পানি এলো। আমি অবাক হয়ে বসে আছি। রাবেয়া আঁচলে চোখ মুছে বলল, “এইসব কারণে আমি তাকে ছেড়ে যেতে পারি না। আপনার বন্ধু বাইরে যতই অসামাজিক হোক, আমাকে সে খুব ভালোবাসে। অভাবের সংসার, খেতে পাই না ঠিকমতো— তবু সে হঠাৎ-হঠাৎ নতুন-নতুন জামাকাপড় নিয়ে হাজির হয়।”
রাবেয়া থামল। আমি কিছু বলার মতো খুঁজে পেলাম না। রাবেয়া নিজেই আবার বলল, “আমি তখন আপনাকে একটা মিথ্যা কথা বলেছি।”
“কী কথা?”
“আপনার বন্ধু কোথায় গেছে আমি জানি।”
“কোথায়?”
“সম্ভবত আজ সে আমার জন্য নতুন কিছু কিনতে গেছে। আজ আমার জন্মদিন। বিয়ের পর থেকেই দেখছি আমার জন্মদিন এলে আপনার বন্ধু সারাদিন বাসায় থাকে না। রাত করে হাজির হয়। আমার জন্য উপহার কিনে আনে। কখনো শাড়ি, কখনো চুড়ি। একবার তো সোনার একটা আংটি এনে আমাকে....”
থেমে গেল রাবেয়া। কিছুটা লজ্জিত বোধ করল সে। বুঝতে পারলাম— এটা তাদের স্বামী-স্ত্রীর একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। আমার মনে হলো আমি ভুল একটা দিনে আনিসের বাসায় এসেছি। আজ তার স্ত্রীর জন্মদিন। সে স্ত্রীর জন্য উপহার কিনতে গেছে। আর তার স্ত্রী বাসায় আজ ভালোমন্দ রান্না করেছে। অর্থাৎ আজকের দিনটা তাদের নিজেদের একটা দিন। এর মধ্যে আমার আর না থাকাটাই ভালো। আমি বললাম, “আনিসের তাহলে ফিরতে আজ রাত হতে পারে?”
“জ্বি। হতে পারে।”
“আচ্ছা। তাহলে আজ আর তার সাথে দেখা হবে না। আমি বরং আরেকদিন আসব।”
কিন্তু আমাকে আরেকদিন আসতে হলো না। সেদিনই আনিসের সাথে আমার দেখা হয়ে গেল। অত্যন্ত কাকতালীয় দেখা। হাজারে একবার ঘটে এরকম ঘটনা।
আমি আনিসের ঘিঞ্জি-টাইপ বাসা থেকে বের হয়ে গলি ধরে হাঁটছিলাম। গলির মুখে আসতেই তার সঙ্গে দেখা। অবশ্য আমি তাকে আগে দেখিনি। সেই আমাকে আগে দেখেছে। সে রিকশায় বসে ছিল। আমাকে দেখে রিকশাওয়ালাকে থামতে বলে প্রায় লাফ মেরে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর আমার নাম ধরে চিৎকার করে বলল, “বন্ধু তুই!”
আমি হকচকিয়ে গেলাম। আনিসের চিৎকার শুনে দেখলাম আশপাশের কয়েকজন লোক আমাদের দিকে তাকালো। আমার একটু বিব্রত লাগছিল। কিন্তু আনিসের মাঝে ওসব কিছুই নেই। সে প্রচণ্ড উৎফুল্ল। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “কতদিন পর তোর সাথে দেখা। ঊনিশ বছর।”
আমি আনিসের কথা শুনে যেমন অবাক হলাম, তেমনি ওকে দেখেও অবাক হলাম। আনিসের চেহারা কেমন বুড়িয়ে গেছে। গালভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি। মাথার চুলেরও একই অবস্থা। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। মাস্টারসুলভ একটা ভাব এসেছে ওর চেহারায়। আমি বললাম, “কী বলিস! ঊনিশ বছর হয়েছে নাকি!”
“হ্যাঁ। তুই বিদেশ যাবার আগে শেষ দেখা হয়েছিল।”
“আচ্ছা। ভালো আছিস তুই? কেমন কাটে দিন?”
আনিস আনন্দে উত্তেজিত হয়ে বলল, “সব কথা হবে। আগে বল তুই এদিকে কোথায় এসেছিস?”
আমি হেসে বললাম, “এসেছিলাম তোর কাছেই। তোর বাসায় গিয়েছিলাম। তুই বাসায় ছিলি না, তোর বউয়ের সাথে গল্পগুজব করে এলাম।”
“শুধু গল্পগুজব? কিছু খেতে দেয়নি?”
“দিয়েছে তো। চা, বিস্কুট, পানি।”
আনিসের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। গলা ভারী করে বলল, “বুদ্ধিহীন নারী বিয়ে করার এই সমস্যা। কখন কী করতে হবে জানে না। এই দুপুরবেলা কেউ কাউকে চা খাওয়ায়? তুই চল তো আমার সাথে। একসাথে বসে দুটো ভাত খাই। তোর সাথে শেষ কবে ভাত খেয়েছি মনে নাই।”
আনিসের বাসায় দুপুরের খাবার খাওয়ার ইচ্ছে আমার ছিল না। কিন্তু তার শেষকথাটা শুনে কেন যেন মানা করতে পারিনি। তবে আমার খানিক চিন্তা হলো। আনিসকে মোটেই এখন অসামাজিক লাগছে না। ইদরিস বলেছিল আনিস নাকি কোনো বন্ধুকেই তার বাসায় নিয়ে যেতে চায় না। রাবেয়াও একই কথা বলেছিল। কিন্তু এখন তো দেখছি উল্টো। আনিস নিজেই আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
ঘরে ঢুকে আনিস আমার সামনেই তার স্ত্রীকে বলল, “ওর সাথে আমার প্রায় বিশ বছর পর দেখা। সে আমার বাড়িতে এসেছে। আর তুমি তাকে এই দুপুরবেলা শুধু চা খাওয়ালে? দুটো ভাত দিতে পারলে না?”
রাবেয়ার মুখ শুকিয়ে গেল। মিনমিন করে বলল, “কীভাবে দেব? আজ তরকারি ভালো না।”
“তরকারি যা-ই হোক। যা আছে তাই দিবে। সব বন্ধুর সামনে লজ্জা করতে হয় না। সে আমার সেরকম বন্ধু। তুমি এক্ষুনি আমাদের দুজনের খাবারের ব্যবস্থা কর।”
আমার খুব লজ্জা লাগল। আনিস যেমনভাবে রাবেয়ার সাথে কথা বলছে, যেন আমি তার কাছে রাবেয়ার বিরুদ্ধে নালিশ করেছি— কেন সে আমাকে দুপুরে ভাত খেতে দেয়নি।
খেতে বসেছি আমরা। আমি আর আনিস। রাবেয়া হাতপাখা দিয়ে বাতাস করে যাচ্ছে। তার মুখে লজ্জিত ভাব। অতিথিকে ভালোমন্দ না খাওয়াতে পারার লজ্জা। কিন্তু আনিস এখনো উত্তেজিত। বহুবছর পর স্কুলজীবনের বন্ধুর সাথে দেখা— এই আনন্দ তাকে ঠিকভাবে খেতেও দিচ্ছে না। সে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে।
“বুঝলে বউ, আমার একবার টাকার প্রয়োজন হলো। সে অনেক বছর আগের কথা। আমরা তখন মেট্রিক দেব-দেব করছি। ফরম ফিল আপ করতে হবে। টাকা প্রয়োজন। বহু কষ্টে দরখাস্ত দিয়ে স্কুলের বেতন মওকুফ নিয়েছি, কিন্তু ফরম তো আর ফ্রিতে ফিল আপ দিবে না। কোথায় পাব টাকা? কে দিবে আমাকে? তখন ও আমাকে টাকা দিয়েছে। আমি বললাম, তুই আমাকে দয়া করে টাকা দিচ্ছিস? সে বলল, দয়া না... ধার দিলাম; পরে শোধ করে দিস। সেই টাকা আজও শোধ করা হয়নি। হবেও না কোনোদিন। কিছু-কিছু মানুষের কাছে ঋণী থাকতে হয়। কী বল?”
রাবেয়া আনিসের কথার জবাব দিল না। সে ওর কথা শুনছে কি-না জানিনা, তবে আমার দুইচোখে নীরবে পানি এসে গেছে। ভাতের থালায় আমার হাত কাঁপছে। আমি যেন আজ নতুন করে জানলাম— তেলে শুধু মাছ নয়, বেগুনিও ভাজা হয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০২২ দুপুর ১২:৪৩