আমি দু'টি কারণে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। প্রথমত, আমি জন্মেছি গ্রামাঞ্চলে। দ্বিতীয়ত, আমার ঘরটি টিনশেডের। এই অতি সাধারণ দুটো কারণ দর্শিয়ে নিজেকে ভাগ্যবান রূপে জাহির করার ব্যাপারটি অনেকের কাছে 'সিলি' লাগতে পারে। কিন্তু না, ব্যাপারটা মোটেও হালকা নয়। এবার তবে খোলাসা করা যাক।
একটি দেশের সভ্যতার প্রতীক বহন করে সে'দেশের শহর। আর গ্রামাঞ্চল হলো সেই দেশের ভিত। এই গ্রামাঞ্চলের শ্রেষ্ঠত্বের অনেকটা জুড়ে আছে বর্ষা। বর্ষার মত যৌবনময় আর কোনো ঋতু নেই। অন্তত আমার কাছে নেই। একমাত্র বর্ষার সময়ই গ্রামাঞ্চলের প্রকৃত সৌদর্য্য ফুটে ওঠে।
আমাদের যাদের শৈশব কেটেছে গ্রামে, একমাত্র আমরাই সগর্বে বলতে পারি- 'আমাদের মত হিরণ্ময় শৈশব আর কারো নেই'। সেই সোনালী শৈশবের প্রধান উপকরণ বর্ষা। আজকের লেখাটি মূলত বর্ষাকে নিয়ে। ঋতুর নাম 'বর্ষা' হয়ে ঝামেলা হয়ে গেল। যদি মনভুলে বলে বসেন, 'বর্ষা, আমি তোমায় ভালোবাসি', আর সেটি যদি কোনোক্রমে আপনার স্ত্রীর কানে গিয়ে পৌঁছায়, তবে ভাই আপনার জন্য সমবেদনা। আপনার বৈবাহিক আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।
রসিকতার পর্ব শেষ। এবার গল্পমূলে চলি। প্রথম কথা, বর্ষা আসলে কী? এটি একটি দ্বিমাসিক ঋতু বা সিজন, যে সিজনে মেঘের দেশের রাজকন্যারা গর্ভবতী হয়ে প্রসব করে বৃষ্টি নামক বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন জলকণা। সেই জলকণায় আমরা ভেসে যাই। আষাঢ়-শ্রাবণ মাস দুটোকে বর্ষার জন্য নির্দিষ্ট করে দেয়া হলেও বর্ষা প্রায়ই অনিয়ম করে বসে। অন্য ঋতুর মাসেও বর্ষাকে প্রায়ই হানা দিতে দেখা যায়।
আমি গ্রামীণ নাগরিক, শৈশব কেটেছে বর্ষার ছোঁয়ায়। আকাশটা একটু অন্ধকার হয়ে এলেই উন্মাদ হয়ে যেতাম। পুরনো জামাকাপড় পরে হাত-পা গুটিয়ে অপেক্ষা করতাম কখন বৃষ্টি আসবে, আর কখন আমি একছুটে চলে যাব বিস্তীর্ণ ধানক্ষেতের তেপান্তরে। ছ'সাত দিন যেবার টানা বর্ষণ চলত, সেবার ধানক্ষেতগুলো ভেসে যেত, ডুবে যেত পানিতে। আমরা তখন শখের মাঝি হতাম। কলাগাছ দিয়ে ভেলা বানিয়ে ভেসে চলেছি ঘন্টার পর ঘন্টা। উপরে আকাশে নিচে পানি। পানিতে আকাশের ছবি দেখা যায়। অর্থাৎ পানিটাও আকাশ। খুব যখন জোর বাতাস হত, তখন সত্যিই মনে হত আমি কোনো যাদুকর। পায়ের তলায় যাদুর বিছানা নিয়ে উড়ে যাচ্ছি মিল্কিওয়ের দিকে।
লিখতে-লিখতে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। ছোট করে বলি। সপ্তাহখানেক ধরে টানা বৃষ্টি। জমিগুলো চলে গেল জলের তলায়। এখানে বলে রাখি, আমি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম অঞ্চলের মানুষ। কুমিল্লা দেশের উঁচুভূমিদের মধ্যে অন্যতম। এখানে কখনো বন্যা হয় না। জলজাতীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের এখানে খুব একটা হানা দিতে পারে না। বড়জোর জমিগুলো ভেসে যায় কিংবা ফুলেফেঁপে ওঠে পার্শ্ববর্তী গ্রামের ডাকাতিয়া নদী। এই পর্যন্তই। কারো ঘরবাড়ি ডুবে না। কারো তেমন ক্ষয়ক্ষতিও হয় না। এজন্য বৃষ্টি বরাবরই কুমিল্লায় মচ্ছবরূপে উপভোগ্য।
টানা বৃষ্টির ফলে জমি ভেসে যাওয়ায় গ্রামে উৎসব পড়ে গেল। আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠরা কলার ভেলা ভাসালো থৈ-থৈ জলরাশিতে। অসংখ্য ভেলা জলের বুকে পিঁপড়ের মত ছুটোছুটি করতে লাগল। আমি যেন পাগল হয়ে গেলাম। বড়রা ভেলা ভাসালো, তারা তাদের দলে 'লেদা হোলাইন' নেয় না। আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় 'পিচ্চি পোলাপান'কে 'লেদা হোলাইন' বলা হয়।
আমার একার পক্ষে ভেলা ভাসানো সম্ভব না। ডেকে আনলাম শুভকে। আমার মামাত ভাই এবং সহপাঠী। দু'জন মিলে ঝপাঝপ কলাগাছ চার-পাঁচটা ফেলে দিলাম। সেগুলো টেনে নিয়ে গেলাম রাস্তায়। সেখানে ভেলা বানিয়ে ভাসিয়ে দিলাম রাস্তার পশ্চিমদিকের জলে। ব্যস, আমাদের তখন পায় কে আর! সারাদিন চলে গেল পানিতে। ফুরফুরে বাতাস, চারদিকে অথৈ জল, এরমাঝে ছান্দসিক বাঁশির সুর। আমাদের একটু দুরের ভেলায় বসে বাঁশি বাজাচ্ছিল পুরান বাড়ির সোহেল মামা। বাঁশির সুরে এই গান- 'সোনাবন্ধু তুই আমারে করলি রে দেওয়ানা'।
সারাদিন এই করে কাটিয়ে সন্ধ্যার প্রাক্কালে বাড়ি ফিরলাম। মা রেগে অগ্নিশর্মা। আমাকে দেখেই হাতে বাঁশের কুঞ্চি নিয়ে তেড়ে এলো। একে তো সারা গা ভেজা, চোখ টকটকে লাল (পানিতে আমি পাঁচমিনিট থাকলেও আমার চোখ লাল হয়ে যায়), দুপুরে কিছু খাইনি- সব মিলিয়ে অপরাধ করেছি তো বটেই। তার মধ্যে ভয়ঙ্কর অপরাধ হলো কলাগাছ কাটা। আম্মুর রাগ করার যথেষ্ট কারণ আছে। যে গাছগুলো আমি কেটেছি তার সবগুলোতেই সবে 'থোর' ধরেছে। পুস্তকের ভাষায় 'মৌচা' বলে। ভেলায় চড়ার নেশায় আমি কলার মায়া করিনি।
স্মৃতির সূতা ধরে টান দিলে একসূতায় বাঁধা অন্য স্মৃতি চলে আসে। তেমনি এই ঘটনা বলতে গিয়ে আরেকটা ঘটনা মনে পড়ল। বলার লোভ সামলানো যাচ্ছে না। বলেই ফেলি। সংক্ষিপ্ত ঘটনা।
এই লেখাটি যখন আমি লিখছি, তখন চলছে ২০২১ সন। আমার বাবা রেমিট্যান্সযোদ্ধা। সংক্ষেপে প্রবাসী। জন্মের পর থেকে এখনো পর্যন্ত আমি তাঁকে মাত্র চারবার দেখেছি। অর্থাৎ চারবার ছুটি নিয়ে দেশে এসেছিল, সেই চারবারই দেখেছি। প্রথমবার যেবার আসলো, তখন সম্ভবত আমি প্রাথমিকের গণ্ডিও পেরোইনি।
আমার ইমিডিয়েট বড়বোন, নাম স্মৃতি। সে আমার চেয়ে দুই ক্লাস ওপরে। বিরাট স্কুলচোর। আমি ছোটভাই হয়ে তাকে মেরেধরে স্কুলে নিয়ে যেতাম। সে সবচেয়ে বেশি খুশি থাকত বৃষ্টির দিনে। কারণ, স্কুলে যেতে হত না।
এমনই এক বৃষ্টির দিনের কথা। সে কী বৃষ্টি! সকাল-সন্ধ্যা মুখর বর্ষণ, যাকে বলে কুকুর-বেড়াল বৃষ্টি। আমার বোন নেমে গেল উঠোনে, তার পিছু-পিছু আমি। ইচ্ছেমতো ভিজে জামা পাল্টালাম। তারপর দুপুরের খাবার খেয়ে আবার চলে গেলাম বাইরে। পুরান বাড়ির আমগাছের তলায় ঘুরঘুর করতে লাগলাম। একটা আম পড়তে দেরি, 'টুক' করে পলিথিনে ভরে নিতে দেরি হত না। আমকুড়ানো শেষ করে ঘরে ফিরে আবার জামা বদলে নিলাম। তারপর কী যেন কোন কারণে দু'ভাইবোন আবারও বাইরে গেলাম। সেখান থেকে ঘরে আসতেই শুরু হলো বিদ্রোহ। আমার বাবা তখন ছুটিতে দেশে এসেছে। আমাদের বারবার ভেজা আর জামা পাল্টানো দেখে তিনি প্রচণ্ড রেগে গেলেন। তাঁর রাগমূর্তি দেখে আমরা দুই ভাইবোন দুইদিকে ভোঁদৌড়। বাবা আমাদের পিছনে হাতে লাঠি নিয়ে ছুটছে। দৌড়ানি খেয়ে তাড়াহুড়োয় আমি ভুল করে ফেললাম। বোন চলে গেল ঘাস গজানো জমির দিকে। আমি বোকামো করে কাঁচা রাস্তা ধরে ছুটলাম। বাবা বোনকে বাদ দিয়ে আমার পেছনে ছুটল। তাঁর পেছনে আমার ছোটকাকা। বাবা আমাদের মারতে দৌড়াচ্ছে, আর ছোটকাকা দৌড়াচ্ছে মারের হাত থেকে বাঁচাতে।
বৃষ্টির দিন, কাদামাখা পিচ্ছিল কাঁচা রাস্তায় কতক্ষণই আর দৌড়ানো যায়! একসময় আমি পা পিছলে টলকে পড়ে গেলাম। বাবা এসে ধরে ফেলল। খড়ি দিয়ে দুয়েকটা বাড়ি দিতেই ছোটকাকা এসে বাবাকে আটকালো। আমার তখন মাথা গরম। বাপমানুষ, মুখে তো কিছু বলতে পারিনা, তাই মনে-মনে বললাম, "এই বদ লোকটা যেন আর কখনো দেশে না আসে।"
যাইহোক, বর্ষা নিয়ে লিখছিলাম। বৃষ্টির মাঝে ফুটবল খেলা, সাইকেল চালানো, আম চুরি, পিচ্ছিল মাটিতে দুরপাল্লা খাওয়া- সবই ছিল আমাদের শৈশবের অংশ। বৃষ্টির প্রধান আনন্দ মাছ ধরায়। আমার দুর্ভাগ্য আমি জাল মারতে পারিনা, কায়দা করে মাছ ধরতে জানিনা। যারা মাছ ধরায় ঝানু লোক, আমি তাদের সঙ্গে গেলে তারাও মাছ পায় না। বলা চলে আমার মাছের রাশি খারাপ।
কদমফুলের কথা মনে আছে? পুষ্পকূলের মাঝে একমাত্র কদম'ই ব্যতিক্রম। টেনিস বলের সাইজের ফুল হয়, এটা চট করে সহজে কারো বিশ্বাস হবে না। কদমফুল কার কেমন লাগে জানিনা। আমার খুব ভালো লাগে। গোলাকার এই ভিন্নধর্মী পুষ্পের আছে দু'টি আস্তরণ। সাদা ও কমলা রঙের ছোট-ছোট পুষ্পরেণু দ্বারা ফুলটি গঠিত। আমরা টেনে-টেনে সেসব আলাদা করে ফেলতাম। এই দৃষ্টিনন্দিত ফুলটির সমারোহ কখন দেখা যায়? একমাত্র বর্ষাকালে।
এখন আমি বাংলা সাহিত্য নিয়ে নাড়াচাড়া করি। বাংলা সাহিত্যের একটা বড় অংশ দখল করে রেখেছে বর্ষা। বর্ষা নিয়ে বাংলা ভাষাভাষীর অগুনতি লেখক-কবি অসংখ্য লেখা লিখে গিয়েছে। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ। আজও মনে আছে আমার স্কুলে থাকাকালীন প্রিয় কবিতাটি।
নীল নবঘনে আষাঢ় গগণে তিল ঠাঁই আর নাই রে।
ওগো তোরা যাসনে আজ ঘরের বাইরে।
বর্ষা নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের চমৎকার একটা লেখা আছে, যেটা বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছিল। একজন বিদেশীর চোখে বাংলাদেশের বর্ষা কতটা আকর্ষণীয়, সেই বর্ণনা লেখায় ছিল। বিদেশী হুমায়ূন আহমেদকে বলল, "বর্ষা নিয়ে তোমাদের সবচাইতে জনপ্রিয় একটা কবিতা শোনাও।"
হুমায়ূন আহমেদ দ্ব্যর্থহীন ভাবে বললেন, "বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর, নদেয় এলো বান।"
বিদেশী স্বাভাবিকভাবে এর অর্থ বোঝেনি। জিজ্ঞেস করল, "এর ইংরেজী কী?"
হুমায়ূন বললেন, "এর ইংরেজী হয় না।"
"কেন হয় না?"
"আক্ষরিক অনুবাদ হয়। তবে তার থেকে কিছুই বোঝা যাবে না। এর ইংরেজী হচ্ছে- 'Patter patter rain drops, flood in the river'.
বিদেশী বিস্মিত হয়ে বলল, "আমার কাছে তো এটা খুবই সাধারণ একটি লাইন মনে হচ্ছে।"
হুমায়ূন বললেন, "সাধারণ তো বটেই। তবে এটা অন্যরকম সাধারণ। এই একটি লাইন শুনলেই আমাদের মনে তীব্র আনন্দ ও তীব্র ব্যথাবোধ হয়। কেন হয় তা আমরা নিজেরাও জানিনা।"
হুমায়ূন আহমেদের কথা সত্য। আজও যখন দেখি আকাশ অন্ধকার করে মেঘ ঘনিয়ে আসে, তখন অদ্ভুত কোনো কারণে মন ছটফট করতে শুরু করে। মন খারাপ থাকলে একটুখানি ঝড়ো হাওয়া দিলেই মন ভালো হয়ে যায়। আমাদের ছোটরা দলবেঁধে হৈ-হৈ করে ফুটবল নিয়ে নেমে পড়ে মাঠে। তারা মনের আনন্দে বৃষ্টিতে ভিজতে-ভিজতে খেলে। আমরা দূর থেকে ছাতা মাথায় মুগ্ধ হয়ে খেলা দেখি। এককালে আমরা খেলতাম, বড়রা দেখত। এখন ওরা খেলে, আমরা দেখি। একসময় ওরা আমাদের মত বড় হবে। তখন তাদের ছোটরা খেলবে, তারা দূরে দাঁড়িয়ে দেখবে। প্রকৃতির কী আশ্চর্য্য অমোঘ বিধান! তবে বর্ষার সেই উন্মাদনা থেকে যাবে সব প্রজন্মের অন্তরে। তীব্র আনন্দ ও তীব্র ব্যথাবোধের সবটা দিয়ে যাবে চিরজীবন ধরে।
এই তো কিছুদিন আগের কথা। সকাল থেকে আকাশ মেঘলা-মেঘলা। বৃষ্টি হবে-হবে লক্ষণ। আমি অপেক্ষা করছি কখন শুরু হবে বাদর দিনের আসল তাণ্ডবলীলা। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। দুপুর নাগাদ তুমুল বর্ষণ শুরু হলো। শুরুতে বলেছিলাম, আমি ভাগ্যবান যে আমার টিনশেডের ঘর। বৃষ্টিধারা টিনের চালে যে অপার্থিব সুর সৃষ্টি করে, তার কোনো তুলনা হয় না। ঐ ঝমঝম শব্দটা আমাকে পাগল করে দেয়। আমি জানালার কপাট খুলে দিলাম। মুগ্ধচোখে বৃষ্টি দেখছি। সারা শরীরময় অন্যরকম শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। আমি ধীরে-ধীরে অস্থির হয়ে পড়ছি। একসময় আমি আর বসে থাকতে পারলাম না। ছোট্ট জানালা দিয়ে ছোট্ট আকাশ, ছোট্ট প্রকৃতি দেখে মন ভরে না। বৃষ্টি দেখার জন্য বিশাল 'ভিউ' দরকার।
আমার তিন বছরের ভগ্নিকন্যা, নাম মীরা (স্মৃতির মেয়ে) । ঢাকায় থাকে। নানাবাড়িতে বেড়াতে এসেছে। তার জন্য ছোট্ট একটা ছাতা কেনা হয়েছে। আমি তাকে কোলে করে উঠোন পেরিয়ে গেলাম। আমার বোন পইপই করে বলে দিল তাকে যেন মাটিতে না নামাই। আমি বললাম, আচ্ছা।
ঘরের সকলের দৃষ্টির আড়াল হতেই মনে-মনে বললাম, "কীসের আচ্ছা! যে শিশু বৃষ্টির মাঝে হাঁটতে গিয়ে পিছলা খেয়ে পড়েনা, তার আবার কীসের শৈশব!"
আমি ভাগ্নিকে কোল থেকে নামালাম। তার হাতে ছোট্ট ছাতাটি দিয়ে বললাম, "আম্মু, তুমি মামাকে দেখ। মামার মত করে হাঁটো।"
ভাগ্নি আমার হাঁটবে কী! সে কেঁদে অস্থির। তাকে টেনেও এক ইঞ্চি নাড়ানো যাচ্ছে না। তাকে কেন খালি পায়ে ভেজা মাটিতে নামানো হলো, এই নিয়ে তার মনে গভীর দুঃখ। আমি বললাম, "মা হাঁটো।"
ভাগ্নি বলল, "পারব না।"
"মামা তোমাকে ধরে রাখব তো।"
"আমি হাঁটতে পারিনা তো।"
"না হাঁটলে মামা এখন তোমাকে একটা আছাড় দেব।"
ভাগ্নি আরো জোরে চিৎকার করে বলে উঠল, "হাঙ্গা।"
আমার অঞ্চলে দ্বিতীয়বার বিয়ে করাকে 'হাঙ্গা' বলে। তবে এই শব্দটি বেশিরভাগ অত্যন্ত নিম্নমানের গালি হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। এবং এই গালি বড়দের সামনেও নির্বিকারে উচ্চারণ করা যায়। ভাগ্নি আমার এই গালি কোত্থেকে শিখল জানিনা। তাকে ছোট্ট একটা ধমক দিলেও সে ঠোঁট ফুলিয়ে বলে- 'হাঙ্গা'।
'হাঙ্গা' শব্দটি থেকেই একটা গ্রাম্যপ্রবাদ মনে পড়ল- 'হাঙ্গার ওক্তে বিয়ার কাম'। এর ভাবার্থ হলো- এককাজ ফেলে অন্যকাজ করা। আমিও তাই শুরু করে দিয়েছি। লিখতে বসেছি বর্ষা নিয়ে। লেখা চলে যাচ্ছে ব্যক্তিগত সীমানার দিকে। এটাতেও কিন্তু প্রমাণ হয়- বর্ষা আমাদের ব্যক্তিগত সীমানারই একটা অবিচ্ছেদ্য স্বর্ণভূমি।
যাইহোক, ঘটনায় ফিরে যাই। ভাগ্নির চিৎকারে কান ফেটে যাবে- এমন অবস্থা। বিরক্ত হয়ে তাকে বাসায় দিয়ে এসে এবার ছাতা ছাড়াই নেমে গেলাম খোলা আকাশের নিচে। একমিনিটের মধ্যেই সারা গা ভিজে জবজবে হয়ে গেল। প্রবল এক মোহময় আবেশে দেহমন শিথিল হয়ে এলো। কিছুক্ষণ পর দেখি পুরান বাড়ির ছোট ছেলেপেলেরা ফুটবল নিয়ে নেমে পড়ল। উৎসবের মত করে খেলতে লাগল তারা। প্রত্যেকের মুখে ঝকঝকে হাসি। কেন হাসছে তারা নিজেরাও জানেনা। আমি কিছুক্ষণ খেলা দেখলাম। এরপর আর বসে থাকা চলল না। আমার ভেতরের শৈশবের আমি বেরিয়ে এসে আমাকে টেনে নিয়ে গেল মাঠে। ফুটবল আমি খেলতে পারিনা। খেলতে গিয়ে বড়জোর পিছলা খেয়ে আছাড় খেতে পারি। সেই আছাড় খাওয়ার লোভ আমি সামলাতে পারিনি। লুঙ্গি মালকোঁচা মেরে মিশে গেলাম তাদের সাথে। সবগুলো খেলোয়াড়ের মাঝে আমি সবচেয়ে সিনিয়র। কিন্তু ঐ সময়টুকুতে আমি ওদেরই বয়সী একজন হয়ে গেলাম।
এই লেখায় এখনো পর্যন্ত একবারও শহরের বৃষ্টির কথা উল্লেখ করা হয়নি। আমার মতে উল্লেখ করার কিছু নেই। শহরের বৃষ্টি আমি দেখেছি। নিউমার্কেটে বসে টানা একঘণ্টার বৃষ্টি দেখেছি। তাতে আমার গ্রামাঞ্চলের একমিনিটের বৃষ্টির আনন্দও খুঁজে পাইনি।
বর্ষার অনেক গুণকীর্তন করা হলো। প্রত্যেক জিনিসেরই ভালো-খারাপ দুটি দিক আছে। এবার বর্ষার খারাপটা নিয়ে বলি। একথা সত্য বটে, বৃষ্টি অনেক অঞ্চলের জন্যে অভিশাপের মত। নিচু জায়গাগুলো ডুবে যায়। ধানীজমি ভেসে গিয়ে ফসলের বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হয়। বন্যার কথা উল্লেখ না করলেও চলে। বৃষ্টির সঙ্গে ঝড় হলে অনেকেরই ঘরের ছাউনি পর্যন্ত উড়ে যায়। পুকুর ভেসে গেলে মাছ চলে যায়। বাংলাদেশে এইসমস্ত দুর্যোগের কবলে বেশিরভাগ পড়ে উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দারা। আমাদের এদিকেও হয়, তবে কদাচিৎ। সেটা খুব একটা প্রকট হয়ে দাঁড়ায় না।
আমি যেহেতু উঁচুভূমি অঞ্চলের বাসিন্দা, সেহেতু বৃষ্টির কারণে আমাদের তেমন ভুগতে হয় না। বৃষ্টি বরাবরই আমার জন্য মহানন্দের। এই গ্রাম, এই প্রকৃতি, এই বর্ষা- একটা নজর দেখলেই সকল হতাশা দূর হয়ে যায়। এজন্য আমি প্রায়ই বলি- 'শহরের যান্ত্রিক জীবনের গৎবাঁধা নিয়মে আটকা পড়ে গেছ? এসো ভাই গ্রামের দিকে এসে দম ছাড়ো। গ্রামের ধুলোবালি তোমার নাকে ঢুকে গেলেও তুমি তাতে অদ্ভুত আনন্দ খুঁজে পাবে। বিকেলের বাতাসে কোনো গাঙের পাড়ে এসে দাঁড়াও। তোমার বয়োকনিষ্ঠদের লাফালাফি দেখ। দেখবে, তোমার মনের সকল 'ডিপ্রেশন' কেটে যাবে।
পরম করুণাময়ের কাছে অশেষ শুকরিয়া, আমি বৃষ্টির দেশ বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে জন্মেছি।
বিবাগী শাকিল
০৬/০৬/২০২১
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০২১ সকাল ৭:২১