আমি একবার রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম।
পথিমধ্যে ওবাড়ির ভাবীর সঙ্গে দেখা।
‘ও দেবর’ ভাবী শুধায়, ‘যাচ্ছো কোথা?’
আমি বললাম, ‘হাটে যাচ্ছি, বেচব আজ মাথা।’
ভাবী হাসলো, ‘সে কি, মাথা বেচবে মানে!’
‘ও কি বেচার মত জিনিস?’
আমি হাসলাম, কিছু বললাম না।
তাড়া বেশি, সময় ছয়টা তিরিশ।
‘ও কি দেবর, চললে কোথায়- দুয়েক কথা শোনো?’
‘অমন মেয়ে যে করলে বিয়ে, যুক্তি আছে কোনো?’
‘তাকায় দেখো আমার দিকে, আমার কেমন রুপ।’
‘তোমার বউ তো আচ্ছা কালো, মুখে আঁটা কুলুপ।’
‘গতর খালি, হালকা বুক, নিতম বড় নেই।’
‘এ বউ দিয়ে করবে কী তুমি যেমন যেই।’
‘বউ হতে হয় আমার মত যৌবনে ঢলঢলা।’
‘তোমার ভাই তো আমার মাঝে পায় না খুঁজে তলা।’
আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘থামো ভাবী,
শোনো চুপটি করে।’
‘নারী হয়েও অপরজনায় নিন্দো কেমন তরে?’
‘মেয়েমানুষ যে পণ্য নয়, এইটি জানো নাকো?’
‘রুপের মত গুণকে তুমি একচোখেতেই দেখো।’
ভাবী একটু গোমড়া হলো, ‘যাও তো দেবর,
চুলের জ্ঞান ঝেড়ো না।’
‘তুমি একটা আস্ত গাধা, বুঝতে পারো না।’
‘রুপই নারীর আসল জিনিস, বাকি সবই মিছে।’
‘ঘরকন্না সবাই পারে, গুণ সবারই আছে।’
আমি বললাম, ‘যাকগে ভাবী, ছাড়ো এসব কথা।’
‘পয়সাকড়ি দাও তো কিছু, কিনো আমার মাথা।’
‘আমার মাথার বিষয়বস্তু তোমার মাঝে নাই।’
‘সমাজ সভ্য করে তুলতে মাথা বেচতে চাই।’
ভাবী এবার রেগে আগুন, মুখে বারুদবুলি।
বলল, ‘তোমার সঙ্গে আমি আর কথা বলবো না।’
‘অসভ্য বলতে আমায় তোমার একটু বাঁধলো না।’
‘যাও তো তুমি তোমার কাজে, বেচো তোমার মাথা।’
‘কিনবে যারা তারাই হবে চামড়াছিলা গাধা।’
এরপর যে কেটে গেল তিন-তিনটি বছর।
বউটি আমার গত হলো মেয়ে বিয়োবার পর।
আমি কিন্তু ভীষণ খুশি, সত্যি বলছি ভাই।
কারণ শুধোও বলছি তবে খুলে বলে যাই।
আমার অরুপসী বউকে নিয়ে যাদের ছিল চুলকানি।
হাত ডুবিয়ে তারাই খেলো আমার বউয়ের কুলখানি।
কৃষ্ণকন্যা ঘরে তুলে খুয়েছি যাদের সোনার মান।
এবার আমার সব পড়শীর চিন্তা হবে অবসান।
কিন্তু ওমা এ কী দেখি‚ চোখ উঠে যায় কপালে।
আমার ঘরে পড়শীর ভীড় সন্ধ্যা, সকাল, বিকালে।
সবার মুখে একই কথা- ‘মেয়েটি বড় ভালো ছিল।’
‘স্বামী-সংসার গুছিয়ে তুলে অসময়ে জীবন দিলো।’
‘লাখের মাঝে একটি হয় এমন গুণবতী।’
‘কালো হলেও মেয়েটি ছিল দুই নয়নের বাতি।’
আমি শুনে বড্ড অবাক‚ ও ভাই- ‘কথায় মনটা দিও।’
আমার অরুপসী বউটি কবে হলো সবার প্রিয়!
পড়শীর ভীড়ে তাকিয়ে দেখি সেই ভাবীটাও আছে।
তফাত করে গেলাম সরে সামনে পড়ি পাছে।
ভীড়টা যখন কমে এলো আসমানেতে চাঁদ।
পত্নীবিহীন আমার সেদিন দ্বাদশতম রাত।
ভাবী এলো আমার কাছে তার চোখেতে পানি।
বলল‚ ‘দেবর‚ ভুল ভেবেছি ক্ষমা চাইছি আমি।’
‘তোমার বউকে বলেছি কত নানানরকম কথা।’
‘কটু কথায় নানান ছুঁতোয় দিলাম কত ব্যথা।’
‘এমন মোটা চামড়ার মেয়ে কোথায় পেলে খুঁজে?’
‘এত ব্যথা‚ এত কথা‚ সয়ে গেলো মুখ বুজে।’
‘কালো হলেও বউটি তোমার শ্রেষ্ঠ গুণবতী।’
‘পিঁপড়ার মত শরীর তার‚ মনটা ছিলো হাতি।’
‘এইপাড়াতে তোমার বউটি সবার মাথার ওপরে।’
‘চামড়া সাদা হয়েও আমার মনটা ভরা গোবরে।’
‘বেচতে থাকো তোমার মাথা চাঁনখা দিঘীর হাটে।’
‘তোমার বউই আসল নারী স্বীকার করি বটে।’
আমি আবার অবাক হলাম বলবো কী রে ভাই?
যা পেয়েছি তারপরেও আর কী পেতে চাই?
বউকে ভালোবাসা যদি দুর্বলতা হয়‚
আমার নবীর চাইতে বড় দুর্বল তো কেউ নয়।
এই সমাজের সকল ঘরে সকল বউয়ের অপমান।
বন্ধ করো মূর্খ সমাজ দাও এবারে পরিত্রাণ।
এই পৃথিবীর সকল মানুষ আল্লাহপাকের তৈয়ারি।
সাদা-কালোর ফারাক খোঁজা খোদার সাথে মশকারি।
খোদা যারে যেমন বানায় কারো কিছু করার নাই।
মানবতার চাইতে বড় সত্য কিছু নাই।
যেই সমাজের সাম্য বন্দী বর্ণভেদের খাঁচায়।
কষে জোরে লাত্থি মারো সেই সমাজের পাছায়।
বর্ণবাদী‚ লিঙ্গবাদী তোদের দিলাম অভিশাপ।
এই সমাজের খানাখন্দে তোরাই হলি কেউটে সাপ।
আমার মাথার এসব বিষয় কিনবি কেউ কি ভাই?
তোদের সভ্য করে তুলতে মাথা বেচতে চাই।
বিনে পয়সায় দিচ্ছিরে ভাই‚ আমার মাথা কিনে নে।
মানুষ-মানুষ একসমান এইটা ভালো জেনে নে।
আমার মত সাম্যবাদী আছিস যারা শুনে রাখ।
তোদের মত করে তোরা মাথা বেচতে থাক।
প্রয়াণকালে বউ বলেছে ফিসফিসানি করে‚
‘তোমার মাথা বেচতে থাকো সারাজীবন ধরে।’
রচনাকালঃ- ৫/৬-এপ্রিল-২০২১
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মে, ২০২১ রাত ১:২৫