ব্লগে বেশ কিছুদিন পর পরই কপি-পেষ্ট নিয়ে তুমুল আলোচনা চলে। এই আলোচনা ভালো; ট্রায়াল এন্ড এররের মাধ্যমে এতে করে একটা নির্দিষ্ট সিস্টেম গড়ে তোলা বেশ সম্ভব। যদিও অনেকে এটাকে সুস্থ আলোচনার দিকে না নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার অপপ্রয়াস চালিয়েছে। তারপরেও এই আলোচনার ভালো দিকটাই বেশী। অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম বিষয়টা নিয়ে লিখবো। ভাবতে ভাবতে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা দিয়ে অনেক পানি প্রবাহিত হয়েছে, তবে আমার আর লেখা হয় নাই। তাই ভাবলাম, এটা নিয়ে কিছু বলার এখনই সময়।
যে কোনও লেখায় যথাযথ রেফারেন্স বা সাইটেশান দেয়া একটা অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। তবে স্থান-কাল-পাত্রভেদে এর ভিন্নতা থাকা উচিত। কেন? তার বিস্তারিত আলোচনা করছি। সেটাতে যাওয়ার আগে রেফারেন্সিং পদ্ধতি বা সাইটেশান মেথড নিয়ে কিছু কথা বলি। একাডেমিক এরেনাতে রেফারেন্স একটা মাস্ট। বিভিন্ন রেফারেন্সিং পদ্ধতি চালু আছে। বিলাতে আসার সুবাদে এখানে কিন্চিৎ পড়ালেখা করার সুযোগ হয়েছে। আমি যেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছি, সেখানে এপিএ (আমেরিকান ফিজিওলজিকাল এসোসিয়েশান) পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। ব্যবহার যেহেতু করি নাই, তাই অন্য পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানি না। তবে এই পদ্ধতিতে এমনকি প্যারা-ফ্রেজিং (কারো কোন লেখা বা মন্তব্যকে নিজের মতো করে পূনঃলিখন) করলেও যথাযথ রেফারেন্স দিতে হতো। আবার আমি যে সময়টাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছি, তখন বিভিন্ন এসাইনমেন্টে বা থিসিসে রেফারেন্সের ব্যাপারটা থাকলেও সেটাকে তেমন একটা গুরুত্ব দেয়া হতো না। অর্থাৎ, গরু কিতাবে অবশ্যই ছিল, বাস্তবে ছিল না সেভাবে। এখনকার অবস্থা জানি না, তবে যেসব খবর পাই তা খুব একটা আশাব্যন্জক কিছু না। ফলে, এ‘ব্যাপারে আমাদের সচেতনতা তেমনভাবে গড়ে ওঠে নাই; যার প্রতিফলন ব্লগেও কিছুটা দেখা যায়। এতো গেল একাডেমিক ব্যাপার-স্যাপার।
আমাদের সামু একটা ইন্টারনেট ভিত্তিক কমিউনিটি ব্লগিং প্ল্যাটফর্ম। এই ধরনের সোশ্যাল মিডিয়াতে সাইটেশানের বিষয়টা কেমন? এটাতে ফোকাস করার আগে আপনাদেরকে একটা উদাহরন দেখাই। গতকালকে নাসা'র জলবায়ু সংক্রান্ত পর্যবেক্ষনের উপরে একটা ফিচার পড়ছিলাম। ফিচার লেখার একটা উদাহরন হিসাবে দিলাম, আগ্রহীরা দেখতে পারেন।
খেয়াল করলে দেখবেন, এই লেখাটাতে অনেক রকমের তথ্য দেয়া আছে, যা নিশ্চিতভাবেই লেখক বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগ্রহ করেছে কিন্তু কোন রেফারেন্স দেয়া নাই। কেন এমন? কারন এটা একটা সোশ্যাল মিডিয়া যাতে একাডেমিক ক্ষেত্রে যতোটা বাধ্যবাধকতা থাকে, তা নাই। সন্নিবেশিত তথ্যের ভিত্তিতে লেখক তার নিজস্ব বিচার-বিশ্লেষণ করেছে। পুরো লেখাটাই তার মতো করে লেখা। এখানে অন্যের কোন লেখা পুরোপুরি হুবহু বা আংশিক কপি/পেষ্ট করা হয় নাই। করলে ধরা পড়বে নিশ্চিতভাবেই। কাজেই এ‘ক্ষেত্রে রেফারেন্স দেয়া সর্বক্ষেত্রে জরুরী না, কিন্তু কেউ যদি একাউন্টেবিলিটি নিশ্চিত করার জন্য দিতে চায়, দিতে পারে। তাছাড়া, এটা নিয়ে সামু'তে যেহেতু মাঠ গরম হয়, তাই কিছু মূল রেফারেন্স তো দেয়া যেতেই পারে।
সামু‘তে কপি-পেষ্ট নিয়ে বহু আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে; তাই এর একটা সুরাহা হওয়াটাও জরুরী। আমি সামু‘র ''ব্লগ ব্যবহারের শর্তাবলী'' অংশটাতে চোখ বুলিয়েছি। এই বিষয়ে কোন নির্দিষ্ট নির্দেশনা আমার চোখে পড়ে নাই। কারো নজরে পড়লে জানাবেন প্লিজ। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা নিয়ে তেমন কোন নির্দেশনা না থাকার কারন যেটা আমি বুঝি……..কর্তৃপক্ষ মনে করেছেন, ব্লগারগণ যেহেতু শিক্ষিত এবং সমাজের একটা সচেতন অংশ, কাজেই সবাই বিষয়টা এমনিতেই বুঝবেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলছে। এটা নিয়ে একটা ব্যাখ্যা যদি থাকে, তাহলে নতুন ব্লগাররা যেমন বিষয়টাতে গুরুত্ব দিবেন, তেমনি পুরাতন ব্লগাররাও সচেতন হবেন। ফলে, এই ধরনের ব্লগীয় ঝামেলা কমে আসবে বলেই মনে হয়। তাছাড়া, পরিস্কার ব্যাখ্যা থাকার আরেকটা সুবিধা হলো, নিয়ম ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়াও সহজতর হয়।
কপি-পেষ্ট এর কিছু প্রকারভেদ আছে।
আগেই বলেছি, কেউ যদি বিভিন্ন জায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে, প্যারাফ্রেজিং করে নিজের মতো করে কিছু ব্লগে লিখে, তাহলে বিস্তারিত সাইটেশান জরুরী না। এখানে ব্লগ কর্তৃপক্ষ কিছুটা ফ্লেক্সিবল হলে ভালো। আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, ব্লগে বহুদিন ধরে কোন ভালো মানের ফিচার পোষ্ট আসে না। একটা সত্যিকারের ফিচার পোষ্ট লিখতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়, অনেক আর্টিকেল পড়তে হয়, তারপরে সেখান থেকে প্রয়োজনীয় বা রেলেভেন্ট তথ্যগুলো নিয়ে নিজের মতো করে লিখতে হয়। আমার ধারনা, রেফারেন্সের ভয়ে কেউ এই ধরনের লেখা আজকাল লিখতেই চায় না। ডয়চে ভেলের বিভিন্ন ফিচারধর্মী রিপোর্ট আমাদের এই ব্লগ থেকেই দেখা যায়। সেখান থেকেও আইডিয়া নিতে পারেন। তবে হ্যা, কেউ যদি মূলতঃ ২/১টা আর্টিকেল এর উপর ভিত্তি করে কিছু নিজের মতো করেও লিখেন, তাহলে রেফারেন্স দেয়াটা অবশ্যই উচিত হবে।
অন্য কারো পুরো লেখা কপি-পেষ্ট পোষ্টের ক্ষেত্রে বিষয়টা খুবই সহজ। মূল লেখকের লিঙ্ক সংযুক্ত করে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। মূল লেখককে কোন ক্রেডিট না দিয়ে তার লেখা নিজের নামে চালিয়ে দেয়ার মধ্যে নীতি-নৈতিকতার নাম-গন্ধও নাই। এটা ব্লগিংয়ের মূল স্পিরিটের সাথেই যায় না। এতে বিষয়টা যা দাড়ায়, তা হলো শ্রেফ চুরি। একজন সহব্লগারকে চোর ডাকতে কারই বা ভালো লাগে? কেউ কেউ তো আবার এক কাঠি সরেস। মূল লেখার শুরু-শেষে কিংবা মধ্যাংশের কিছু বাক্য পরিবর্তন করে দেয়। এটা যারা করে তারা কিন্তু জানে যে, কপি-পেষ্ট একটা অপরাধ; তারপরেও করে শুধুমাত্র মূল লেখককে ক্রেডিট না দিয়ে নিজে ক্রেডিট নেয়ার জন্য। না জানাদের চাইতে এই জ্ঞানপাপীদের শাস্তি তৎক্ষনাৎ এবং কঠোর হওয়া উচিত বলে মনে করি।
এবার আসি, আংশিক কপি-পেষ্টের ক্ষেত্রে। অনেক সময়ে পোষ্টের বিষয়-বস্তুর খাতিরে কারো লেখার এক বা একাধিক প্যারা পোষ্টে সংযোজনের প্রয়োজন পরে। এ‘ক্ষেত্রেও মূল লেখার লিঙ্ক সংযোজন করা পোষ্টদাতার অবশ্য কর্তব্য।
সম্পাদনার নামেও অনেকে কপি-পেষ্ট করে। এটা লেখাচুরির ক্ষেত্রে একটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এ‘ধরনের খোড়া যুক্তি দিয়ে নিজের ক্রিয়েটিভিটি নষ্ট করার কি আসলেই কোন মানে আছে? এমন না যে, উহারা লিখতে পারেন না; খুবই ভালো পারেন। কিন্তু ওই যে, শর্টকাটের অভ্যাস! এই ব্যাপারে মডারেটর মহোদয় একটা পোষ্টে সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এর বাইরে বলার মতো আর কিছু আসলে নাই। এই বিষয়ে শেষ কথা হলো, এতো প্যারা না নিয়ে খানিকটা কষ্ট করে রেফারেন্স যুক্ত করে দিলেই কিন্তু হয়ে যায়, তাই না!!!
এই বিষয়গুলো আমার মনে হয়েছে সংক্ষিপ্ত আকারে ব্লগ ব্যবহারের শর্তাবলীতে সংযুক্ত করে দেয়া প্রয়োজন। এতে করে নতুনদের ব্লগ কর্তৃপক্ষের স্ট্যান্সটা জানা থাকবে। আর পুরানোরাও অধিকতর সচেতন হবেন।
কপি-পেষ্ট চেক করার ব্লগে প্রচলিত ধারার বাইরে বিভিন্ন মোবাইল এ্যাপ বা সফটওয়্যার পাওয়া যায়। আমিও ব্যবহার করেছি এক সময়ে, তবে সেগুলো সবই ইংরেজিতে। সেগুলোতে শতকরা কতোভাগ কপি করা হয়েছে, কোথা থেকে কোন লাইন কপি করা হয়েছে ইত্যাদি সবই বিস্তারিত রিপোর্ট আকারে দিয়ে দেয়া হয়। ঠিক এমন একটা বাংলা প্লেইজারিজম চেকার খুজতে গিয়ে এটা পছন্দ হলো। দেখতে পারেন। আমি ব্যবহার করি নাই এখনও, তবে ভবিষ্যতে অবশ্যই করবো। কাজেই সাধু সাবধান!!!
শেষ কথা হলো, কপি-পেষ্ট করেন, তবে মূল লেখককে তার কষ্টের স্বীকৃতিটা দিয়েন দয়া করে। কাউয়া চালাকী করলে সুনিশ্চিত ধরা খাবেন, আজ অথবা কাল। নিজের ইজ্জৎ নষ্ট করার এই ঝুকিটা নেয়ার দরকার কি? সবচেয়ে ভালো হয়, নিজে নিজে কিছু লিখেন। যা খুশী। ভালো হচ্ছে না! কোন অসুবিধা নাই। লিখতে লিখতেই একসময়ে দেখবেন চমৎকার লেখা বের হচ্ছে। নিজের লেখা পড়ে নিজেই মুগ্ধ হবেন, এই নিশ্চয়তা অবশ্যই দেয়া যায়। নিজের মৌলিক লেখা কিন্তু অনাবিল আনন্দ নিয়ে বার বার পড়া যায়। কাজেই শর্টকাটের রাস্তা বাদ দিয়ে নিজে লিখেন। দিন শেষে তৃপ্তিটা আপনারই!!!
আমার পক্ষে যতোটুকু সম্ভব, সংক্ষেপে আলোচনা করলাম। আপনাদের যে কোনও গঠনমূলক আলোচনা বা মতামতও একটা নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে; আর এই বিষয়টাকে আর বাড়তে না দিয়ে কর্তৃপক্ষকে একটা সহজ সমাধানের দিকে নিয়ে যেতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
সবাইকে স্বাগতম!!!
ছবির সূত্র।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মে, ২০২২ দুপুর ১:৪৯