ইদানিং আমি কেমন জানি অদ্ভুত একটা সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি যা কিনা আমার চরিত্রের সাথে একেবারেই বেমানান। বিভিন্ন পশুপাখির বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আমাদের সবার মাঝেই কমবেশী বিদ্যমান। সেই হিসাবে বর্তমানে কুমির, গন্ডার কিংবা অতীতে একসময়ে বান্দরের চারিত্রিক বৈশিষ্টও আমার মধ্যে বিদ্যমান আছে/ছিল। এই খৃষ্টমাসের সময়টাতে প্রতিবছরই কাজের প্রচন্ড চাপে চ্যাপ্টা হই। দম ফেলার সময় থাকে না। এবারও তার ব্যাতিক্রম না, বরন্চ বিভিন্ন কারনে এবারে চ্যাপ্টা না, একেবারে চিড়ে চ্যাপ্টা অবস্থা। যতোক্ষণ ব্যস্ত থাকি, ঠিকঠাক থাকি। কাজের বাইরের সময়টা নিয়েই যতো সমস্যা। এক জায়গায় বসলে কুমিরের মতো নড়াচড়াহীন অবস্থায় বসেই থাকি। বসে বসে আগা-মাথা ছাড়াই আকাশ-পাতাল ভাবি। বউ কিছু বলে না, তবে মাঝে-মধ্যে উকি দিয়ে দেখে যায় শ্বাস-প্রশ্বাস ঠিকমতো নিচ্ছি কিনা। বিভিন্ন রকমের ভয়াবহ চিন্তা একের পর এক মাথায় জড়ো হতে থাকে। আসলে যতোই পশুপাখির চরিত্র ধারন করি না কেন, দিন শেষে আমরা সবাই এক একজন মানুষই তো, নাকি!!!
খুশীর খবর নিয়ে কোন সমস্যা হওয়ার কথা না। কারন, সেটা খুশীরই খবর! দুঃখের, সেটা যতোই কঠিন দুঃখের খবর হোক না কেন, আমি বড়জোড় ঘন্টা দু'য়েক মন খারাপ করে তারপরে কাধ ঝাকিয়ে ঝেড়ে ফেলতে পারি…….অন্ততঃ এতোদিন তো পারতাম; অনেকটা গন্ডারের মতো, দুঃখটাকে ভিতর পর্যন্ত স্পর্শ করার সুযোগ না দিয়ে। কিন্তু এই করোনার যন্ত্রণা শুরু হওয়ার পর থেকেই এই সমস্যার শুরু। টেনশানের বিষয় হলো, এটা দিন দিন বাড়ছেই। কমার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সব সময়ে কেমন একটা আতঙ্কে থাকি। ফোনটা বেজে উঠলেই মনে হয়, নিশ্চয়ই কোন খারাপ খবর! আর বে-টাইমে বাজলে তো কোন কথাই নাই!
ঘুমালে বিভিন্ন রকমের স্বপ্ন দেখি। সেটা তো সব সময়েই দেখি, নতুন কিছু না। বেশীরভাগ স্বপ্নই জেগে ওঠার পর পরই খানিকটা সময়ে মনে থাকে, তারপরে যথারীতি ভুলে যাই। গত সপ্তাহে একটা স্বপ্ন দেখলাম, তবে ভুলতে পারছি না কোনভাবেই। স্বপ্নে দেখলাম, আমি খাটে বসে আছি। আমার সেজমামা আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, আচমকা কষে এক থাপ্পড় কষিয়ে দিলেন আমার গালে। আমি খাট থেকে ছিটকে পড়লাম। ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখলাম বিছানাতেই আছি, ছিটকে পড়ি নাই। তবে থাপ্পড়ের বিশালত্ব এমনই ছিল যে, ঘুম ভাঙ্গার পরও দেখি মাথা ভো ভো করে ঘুরছে!
এই মামার একটা বিশাল থাপ্পড় আমি একবার সত্যি সত্যিই খেয়েছিলাম। মামার কথা মনে হলেই সেই ঘটনা মনে পড়ে…...স্বপ্নটা দেখার সেটাও একটা কারন হতে পারে, কারন ইদানীং মামার কথা কেন জানি বেশী বেশী মনে পড়ছে। সে যাই হোক, সেই ঘটনাটা বলার আগে একটু ব্যাকগ্রাউন্ড বলে নেই, বুঝতে সুবিধা হবে। আমার সাত মামা। তারমধ্যে তিন জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, মেজ, সেজ আর ছোট। বড়মামা যান নাই। আর বাকী তিনজনের বয়স যথেষ্ট ছিল না। যা বলছিলাম, মেজমামা যুদ্ধে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বিদায় নেন এপ্রিলের শেষের দিকে। বাড়িতে বলেই গিয়েছিলেন। মে মাসে সেজমামা যাওয়ার জন্য জেদ ধরেন, কিন্তু আমার নানু অনুমতি দিচ্ছিলেন না। ফলে মে'র শেষের দিকে মামা উনার আরো তিনজন চাচাতো ভাইয়ের সাথে পালিয়ে যান (উনারা অবশ্য অনুমতি নিয়েই গিয়েছিলেন), আর যাওয়ার সময়ে ছোটমামাকেও সঙ্গে নিয়ে যান।
স্মৃতিচারণ যেহেতু করছি আর মামার চাচাতো ভাইদের সাথে পালিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গটা যেহেতু এসেই গেলো, এখানে আমার নানাবাড়ির একটু বর্ণনা দেই। আমার নানারা ছিলেন পাচ ভাই। নানার বাবা এক সময়ে একটা বড়সড় দৃষ্টিনন্দন দোতলা বাড়ি তৈরী করেছিলেন। ব্লগের খলিল ভাই আমাকে 'ভুয়া মফিজ' না বলে 'ভুইয়া মফিজ' বলেন। এটার পিছনের কারন হলো, গতবার ব্লগ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত আমার গল্পে প্রুফ রিডাররা আমাকে 'ভুইয়া মফিজ' বানিয়ে দিয়েছিল। তাই এই সুযোগে জানিয়ে দেই, আমার নানাদের বংশগত পদবী হলো 'ভুইয়া'! ব্যাপারটা কেমন কাকতালীয় না!!! যাই হোক, ভুইয়াদের মূল বাড়ি এক সময়ে সংস্কারের অভাবে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাওয়ার ফলে কম্পাউন্ডের মধ্যেই অবস্থিত একটা দিঘীর চারপাশে নানারা পাচ ভাই আলাদা করে বাড়ি করেন। খুব ছোটকালে মূল বাড়িতে থাকার সৌভাগ্যও আমার হয়েছিল। সেটা আমার জন্য সব সময়েই একটা চমৎকার স্মৃতি হয়ে থাকবে। উনাদের প্রত্যেকের পরিবার বড় হতে হতে পুরো এলাকাটা একটা ছোটখাটো পাড়া হয়ে গিয়েছিল। সেজন্যে নানাবাড়ি গেলে প্রচুর আনন্দ হতো এক সময়ে। বাদরামী করার মতো সঙ্গী-সাথী আর উপকরনের কোন অভাব ছিল না সেখানে।
তো, নানাদের পাচ ভাইদেরই আল্লাহর অশেষ রহমতে সন্তান সন্ততির অভাব ছিল না। এক আমার নানাভাইয়েরই সাত ছেলে আর পাচ মেয়ে ছিল! দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে উনারা বেশ কার্যকরভাবেই অবদান রেখে চলছিলেন। ফলে নানাদের পাচ ভাইয়ের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল সন্তানদের বেশ কয়েকজনই যুদ্ধে যান। আমার নানা-নানু সেজমামার পালিয়ে যুদ্ধে যাওয়া আর সেই সাথে ছোটভাইকে সাথে নিয়ে যাওয়াতে দীর্ঘদিন নাখোশ ছিলেন। অক্টোবরের দিকে কোন এক অপারেশানে সেজমামার পায়ে (হাটুর একটু নীচে) গুলি লাগে। যার কারনে যুদ্ধের বাকী সময়টা উনাকে হাসপাতালেই কাটাতে হয়। এটা নিয়ে মামা আজীবন দুঃখ করেছেন। উনার বদ্ধমূল ধারনা ছিল, মা-বাবার কথা না শোনার ফলেই এই শাস্তি পেতে হয়েছিল উনাকে। আমি যখন থেকে উনাকে দেখি, উনি ছিলেন প্রচন্ড রাশভারি একজন মানুষ। কথা বলতেন খুবই কম। যুদ্ধের কোন গল্পই উনি কারো সাথে করতেন না। আমি যেহেতু শয়তান কিসিমের ছিলাম, উনি আমাদের বাসায় বেড়াতে এলে আম্মা আমাকে আগেই বলে রাখতেন উনার ধারে-কাছে না যাওয়ার জন্য। এদিকে যেখানে নিষেধ, সেখানেই আমার কৌতুহল…….বিশেষ করে গুলিটা ঠিক কোথায় লেগেছিল এটা জানার আগ্রহ ছিল ভীষণ।
আমার ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়াকালীন সময়ের কথা। মামা বেড়াতে এসেছেন। উনি তখন চিটাগাং মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তার ছিলেন, ওখান থেকেই পাশ করে। একদিন দেখলাম, মামার মেজাজ খুবই ভালো। সবগুলো দাত বের করে আব্বা-আম্মার সাথে কথা বলছেন। এহেন আজব ঘটনার কারন জানলাম। উনার বিয়ে, প্রেমের বিয়ে। নানাজান রাজি ছিলেন না, এখন রাজি হয়েছেন। হবু মামীও চিটাগাং মেডিকেল থেকে পাশ করা ডাক্তার। ভাবলাম, এই সুযোগ। মামাকে বললাম, মেজমামা যুদ্ধের কতো গল্প করে, আপনি তো কিছুই বলেন না। আজ আমাকে আপনার পায়ে গুলি লেগেছিল যেই যুদ্ধে, সেটার কথা বলতে হবে। অরন্যে রোদন হবে জানার পরেও অনুরোধ করেছিলাম আর আমাকে ভড়কে দিয়ে উনি সেই ঘটনা বলা শুরু করলেন।
সেদিন রাতে উনারা আটজনের একটি দল এক কৃষকের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। রাতে খাওয়ার সময় খবর এলো, এলাকার স্কুলে ১৪/১৫ জনের একদল পাকসেনা ১০/১২ জন রাজাকারসহ ঘাটি গেড়েছে। তো, উনারা সিদ্ধান্ত নেন ওদেরকে আক্রমন করার। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাত প্রায় দু'টার দিকে আক্রমন শুরু হয়। স্কুলের সামনে ছিল খোলা মাঠ, পিছনে বাগান (জঙ্গল) আর খাল। তাই উনাদের দল পিছন থেকে আক্রমন শুরু করে। আক্রমনের প্রথম ধাক্কাতেই রাজাকারগুলো ভেগে যায়। গোলাগুলির মধ্যেই পজিশন বদল করতে গিয়ে উনার পায়ে গুলি লাগে। ব্যাস…….এটুকুই। বুঝলাম, আমার স্বল্পভাষী মামা গল্প বলাতেও অপটু। তবে আমার মূল উদ্দেশ্য তো গল্প শোনা ছিল না! মামা বিছানাতে লুঙ্গি পড়া অবস্থায় আধশোয়া হয়ে শুয়েছিলেন। আমি 'কোন জায়গাতে গুলি লেগেছিল মামা' বলে যেই না লুঙ্গিতে হাত দিয়েছি, মামা বিদ্যুৎবেগে আমার গালে দশমনি ওজনের এক থাপ্পড় বসিয়ে দেন। বিছানায় বসেছিলাম। সেই থাপ্পড়ের মাহাত্ম্যে হঠাৎ দেখি আমি মেঝেতে বসে আছি!!
পরে ঘটনা শুনে আম্মাও কিছু উত্তম-মধ্যম দিয়েছিলেন আমাকে।
আমার এই মামা প্রচন্ড রকমের সৌখিন একজন মানুষ ছিলেন। সে'সময়ে উনি ব্রুট আফটার শেইভ লোশন আর জোভানস সেক্স অ্যাপিল নামে একটা পারফিউম ব্যবহার করতেন। আমার তখনও দাড়ি গজায়নি বলাই বাহুল্য, তারপরেও সুযোগ পেলেই ব্রুট আফটার শেইভ লোশন গালে লাগিয়ে বড় সাজার ভাব নিতাম। মামী ছিলেন চিটাগাংয়ের মেয়ে। চাকুরী, শ্বশুরবাড়ি আর পরবর্তীতে নিজের ক্লিনিক…..…...সবমিলিয়ে মামা চিটাগাংয়েই স্থায়ী হয়ে যান। কালে-ভদ্রে ঢাকায় আসলে আমাদের বাসায় উঠতেন।
পরবর্তীতে সৌখিন কিন্তু রাশভারী আমার এই মামা আমার খুবই প্রিয় একজন মানুষে পরিনত হন। ২০১৭ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় এই মামাকে হারাই আমরা। শোনা কথা…...চিরবিদায় নেয়া প্রিয় আত্মীয়-স্বজনকে স্বপ্নে দেখার মানে নাকি, উনারা উনাদের জগতে প্রিয় মানুষদেরকে নেয়ার জন্যে আসেন। আমার সময় কি তাহলে শেষ হয়ে গেল নাকি?
ভয়ে ভয়ে ইদানীং খুব করে ভাবছি……...ধুমপানটা এবার ছেড়েই দিব!!!

মহান বিজয় দিবসের সুবর্ণ জয়ন্তীকে উপলক্ষ্য করে আমার এই ক্ষুদ্র স্মৃতি-তর্পণ। নানাবাড়ির দিঘীটার মতো দেখতে একটা দিঘীর ছবির জন্য গুগল ঘাটাঘাটি করে সবচেয়ে কাছাকাছি এটাই পেলাম, তাই শিরোনামের সাথে ছবিটা জুড়ে দিলাম।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২০ বিকাল ৪:১৪