আমার এই পোষ্টের উপরের ছবির কোটেশানটা আমার খুবই পছন্দের। এটি দীর্ঘ বারো বছর একনাগাড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডির রেকর্ড গড়া ইলিনর রুজভেল্টের। ইনি একজন বিখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং এক্টিভিস্টও ছিলেন। আমাদের দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে উনার এই কথাগুলো খুবই যথাযথ। কিভাবে? বলছি।
দেশে একেকটা ঘটনা ঘটার পর সেটার নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়। ইলেকট্রনিক, পাবলিক, সোশ্যাল….সবকয়টা মিডিয়া সোচ্চার হয়ে ওঠে বিষয়টা নিয়ে। সরকারের বিষয়-সংশ্লিষ্ট মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় কিছু জ্বালাময়ী কথাবার্তা বলেন, যেগুলো আদতে পুরানো বিভিন্ন বক্তব্যের চর্বিতচর্বণ। তারপরে একসময়ে সব ঠান্ডা হয়ে যায়। জনগন রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে নতুন ঘটনার। বলাই বাহুল্য, তারা ভাগ্যবান। বেশীদিন অপেক্ষা করতে হয় না জনসাধারনকে। চিরাচরিত পরিবহন খাতে দূর্ঘটনা, পাহাড়ধ্বস, দূর্ণীতি, রাজনৈতিক হত্যাকান্ড কিংবা গুম তেমনই কিছু ঘটনার শিরোনাম সরবরাহ করে আমাদেরকে প্রতিনিয়ত। এছাড়া বোনাস হিসাবে কিছু নতুন, বৈচিত্রময় বিষয়ের দেখাও আমরা পাই মাঝে-মধ্যে; যেমন, ইদানিংকার ক্যাসিনো ঘটনাপ্রবাহ। ছাত্র রাজনীতি তেমনই একটা সেক্টর, যার সাব সেক্টর হলো 'হত্যাকান্ড'। এর সর্বশেষ বলি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ।
আমাদের দেশে সমস্যার শেষ নাই। এর মধ্যে কিছু সমস্যা আছে যেগুলোর কথা দেশের আপামর জন-সাধারন বেশ ভালোভাবেই জানে। আবার কিছু সমস্যা ভাসা ভাসাভাবে জানলেও সবসময় এর তীব্রতা বুঝতে পারে না। যখনই কোন খবর সামনে চলে আসে, শুধুমাত্র তখন জনগন জানতে পারে আসলে সমস্যাটা কতোটা বড় কিংবা ভয়াবহ। বর্তমানের তেমনি একটা বহুল আলোচিত কিংবা সমালোচিত একটা বিষয় বা সমস্যা হলো 'ছাত্র রাজনীতি'।
একটা ব্যাপার আমাদেরকে বুঝতে হবে। কোন কিছুর একসময়ে প্রয়োজন ছিল বলে সবসময়েই সেটা দরকার হবে তা ভাবা কোন কাজের কথা নয়। যুগের সাথে সাথে চাহিদার ধরনও পাল্টায়। যেমন, বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তুরের গন-আন্দোলন; এগুলো ছিল স্বাধীনতা-পূর্ব ছাত্র রাজনীতির সফল উদাহরন। একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দেশের ছাত্রসমাজের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। পরবর্তীতে স্বাধীনতা-উত্তর ছাত্র রাজনীতির সর্বশেষ গঠনমূলক ভূমিকা দেখি নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে। সেগুলো ছিল যুগের চাহিদা কিংবা দাবী। সাধারনভাবে আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তেমনভাবে শিক্ষিত না, সচেতনও না। ছাত্ররা দেশ বা সমাজের সচেতনতা ধারন করে বহুলাংশে। বিশেষ করে যেই আন্দোলনগুলোর কথা বললাম, সেগুলোতে দেশের জনগন তাকিয়ে ছিল ছাত্রদেরই দিকে। তাদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধকেই সমর্থন দিয়েছিল সবাই। তাদের দিক-নির্দেশনার হাত ধরেই এসেছিল সাফল্য। ছাত্রদের এই শক্তিতেই নজর পরে কিছু কুচক্রী মানুষের। তাদের এই শক্তিকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করার মাধ্যমে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের যে সূচনা একটা সময় হয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে আজকের ছাত্র রাজনীতি। ছাত্রদের যেটা মূল কাজ….বিদ্যার্জন; সেটা বাদ দিয়ে চাদাবাজী, টেন্ডারবাজী, মাস্তানী, খুন, ধর্ষণ; হেন কোন কুকাজ নাই যেটা করে না আজকের ছাত্রনামধারী গুন্ডারা। আর এদেরকে অত্যন্ত সফলভাবে ব্যবহার করে আসছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো; যাদের মূল নেতারাই এসব কর্মকান্ডের আসল ধারক ও বাহক।
ছাত্র রাজনীতি কি শুধু আমাদের দেশেই আছে? না। পৃথিবীর বহু উন্নত দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গসংগঠন হিসাবে ছাত্ররা সক্রিয়। উদাহরন হিসাবে বলা যায়, বৃটেনের লেবার এবং কনজার্ভেটিভ পার্টি, আমেরিকার ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকানদের ছাত্র সংগঠন। এছাড়া ইউরোপের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠন রয়েছে। এমনকি ভারতেও কিছু কিছু দলের আছে। পশ্চিম থেকে পূর্বে, বাংলাদেশ পর্যন্ত যদি একটা সরলরেখা টানি, তাহলে দেখা যাবে, যতই পূর্বে এগুবেন, ততই এর চরিত্র বদলে অপ-রাজনীতির অশুভ কালো ছায়া দেখবেন আর এর সর্বশেষ সর্বগ্রাসী কু-প্রভাব দেখবেন আমাদের এই সোনার বাংলাদেশে। কথা হলো, লেবু কচলালে প্রথমদিকে আপনি ভালো রসটাই পাবেন। কিন্তু যদি ক্রমাগত কচলাতেই থাকেন, তাহলে তিতকুটে রস পাবেন আর এক পর্যায়ে লেবুর খোসাও ছিবড়ে যাবে, কিন্তু কিছুই পাবেন না। আগের আমার এক পোষ্টে বলেছিলাম, যে কোনও কিছুই মাত্রাছাড়া কচলানো আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য। কার্যকরী উদাহরন হিসাবে ক্ষমতাসীন দলকেই বেছে নেয়া ভালো কারন এখানেই মধুলোভীদের সমাগম বেশী ঘটে। এই আওয়ামী লীগকে কচলানো শুধু ছাত্র সংগঠনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে নাই কিন্তু। 'লীগ' নামধারী এতো এতো সংগঠন আপনি পাবেন যে, হাতেগুনে শেষ করতে পারবেন না। এইসব অঙ্গসংগঠনের নেতাককর্মীরা সবাই একেকজন প্রচন্ড ক্ষমতাধর বঙ্গসন্তান। সবাই ক্ষমতা নামক হালুয়া রুটির ভাগ পায়। এই চারিত্রিক পরিবর্তন কেন? বেশী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষনের প্রয়োজন নাই। মূল দলগুলোর চরিত্র বিশ্লেষন করলে অতি সহজেই এর উত্তর আপনারা পেয়ে যাবেন।
পশ্চিমা মূল রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধানতম লক্ষ্যই থাকে ছাত্রসংগঠনের মাধ্যমে ভবিষ্যতের জন্য যোগ্য নেতা তৈরী করা যেন দেশ কোনসময় নেতৃত্বের সঙ্কটে না পরে। মূল দলগুলোর আদর্শ, দেশের প্রতি কমিটমেন্ট, জনগনের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা এবং দেশের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দেখেই সেদেশের ছাত্রনেতারা অনুপ্রেরণা পায়, দলের নেতাদেরকেই তারা তাদের আদর্শ মানে। এখান থেকেই তারা ভবিষ্যত নেতৃত্বের দিক-নির্দেশনা পায় এবং পর্যায়ক্রমে যোগ্য নেতা হিসাবে গড়ে ওঠে। এখন আপনারাই বলেন, আমাদের মূল দল এবং তার নেতাদের কাছ থেকে ছাত্ররা কি শিখে? যা শিখে, সেটাই তারা প্রয়োগ করে তাদের মেধায়-মননে, আচার-আচরণে আর কর্মপদ্ধতিতে। আর তাদের এই কর্মপদ্ধতি যে কতোটা ভয়াবহ, তা জানতে বা বুঝতে কি আর কিছু বাকী আছে?
যাকগে, উন্নত দেশের কথা চিন্তা করে লাভ নাই। তাতে আঙ্গুরফলকে টকই মনে হবে। আমরা বরং আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটেই চিন্তা করি। 'যুগ' এর প্রেক্ষাপট কিংবা চাহিদার কারনে একসময় আমাদের এই দেশে ছাত্র-রাজনীতির সূচণা হয়েছিল। সেটা আপামর জনসাধারনের ভালোবাসাও অর্জন করেছিল। আবার এই 'যুগ'ই বর্তমানে ছাত্র-রাজনীতির অবসান চাইছে। কারন, বর্তমানের এই তথাকথিত ছাত্ররা নিজেরাও পড়ে না, অন্যদেরকেও পড়তে দেয় না। উল্টো তারা শিক্ষাঙ্গনকে কলুষিত করছে প্রতিনিয়ত। এই চাওয়ার পিছনে আরো আছে হাজারো বাবা-মায়ের করুণ দীর্ঘশ্বাস, অগুনতি সম্ভ্রম হারানো বোনের আর্তনাদ আর চাদা দিয়ে সর্বস্বান্ত হওয়া ব্যবসায়ীদের অভিশাপ। ক্ষমতার ঘুটি হিসাবে ব্যবহৃত না হয়ে ছাত্ররা বরন্চ ফিরে যাক তাদের মূল কাজে…..যেটার জন্য জনগন তাদের কষ্টার্জিত উপার্জন ব্যয় করছে, পিতামাতারা তাদের আরাম-আয়েশ বিসর্জন দিয়ে মনে প্রানে চাইছে, তাদের সন্তান যেন ভালোভাবে লেখাপড়া শিখে একজন মানুষের মতো মানুষ হয়। আর আমরা; ধর্ম, গোত্র, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই চাইছি, জাতী যেন এসব অমানুষদের, এসব মানুষরুপী পশুদের হাত থেকে নিস্কৃতি লাভ করে চিরতরে। জনগনের এই চাওয়াটা কি ভুল কোন চাওয়া? এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কাদের?
মূল দলের যেসকল নেতারা টাকা-পয়সা আর ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে আমাদের তরুণ সমাজকে বিপথগামী করছে, তাদের জন্য শুধুই ধিক্কার!!
আমি এখনও বিশ্বাস করি (কেন করি, তার কিছুটা বর্ণনা করেছিলাম এখানে), এসবের অবসান ঘটানোর পূর্ণ ক্ষমতা বর্তমানের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর রয়েছে। বাস্তবতা হলো, দেশের ভবিষ্যত নেতৃত্বের যে অবস্থা তাতে উনি যেদিন থাকবেন না, সেদিন এই দেশের অবস্থা হবে হালহীন নৌকার মতো, যে কোনও একদিকে ভেসে যাবে এবং অবধারিতভাবে এক পর্যায়ে ডুবেও যাবে।
আমি তথ্য-উপাত্তের দিকে নজর না দিয়ে ছাত্র রাজনীতির ব্যাপারটা সংক্ষেপে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। সাধারন মানুষ বিষয়টা নিয়ে বহুদিন ধরেই ত্যক্ত-বিরক্ত। আমি নিজেও একজন সাধারন মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন হিসাবে খুব কাছ থেকে দীর্ঘদিন এই অপ-সংস্কৃতি দেখেছি। একসময়ে নিজেও সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে হয়ে পড়েছিলাম। সৃষ্টিকর্তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, সেটা আমার উপর খুব একটা প্রভাব বিস্তার করার আগেই সরে আসতে পেরেছিলাম একটা বিশেষ কারনে। ছাত্র রাজনীতি নিয়ে সব পর্যায়ে আলোচনা-সমালোচনা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। একটা প্রকৃত গনতান্ত্রিক দেশের সাধারন বৈশিষ্ট্যই হলো, সরকারের কার্যক্রমে জনগনের চাওয়া-পাওয়ার প্রতিফলন ঘটানো। সরকারের উচিত কান পেতে শোনা, জনগন কি চায়। দূর্ভাগ্যজনকভাবে সেটা আমাদের দেশে অনুপস্থিত। সরকার চলে সরকারের ইচ্ছা এবং স্বার্থ অনুযায়ী। সাধারন জনগনের ইচ্ছা-অনিচ্ছার মুল্য সরকার দিবে না…..এটাই এ'দেশের সরকারগুলোর স্বাভাবিক চর্চা!
এই অবস্থার দ্রুত অবসান দরকার…...দেশের স্বার্থে, আমাদের সবার স্বার্থে!!!
ছবি গুগল থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৯ ভোর ৬:২৯