১৮২১ সালে জন মার্টিনের আকা ছবি, ''Destruction of Pompeii and Herculaneum''.
১৮৩০-৩৩ এ আকা কার্ল ব্রুলভ এর ছবি, ''The Last Day of Pompeii''.
ছবি দু’টা কিন্তু নিছক কল্পনা না, উনারা বিশেষজ্ঞদের অভিমতের উপর ভিত্তি করেই একেছিলেন!
স্বপ্নযাত্রা: ইটালী - ২
প্রকৃতি সবসময়ই মানুষকে সাবধান করে, মানুষ বোঝে না। কিংবা বুঝলেও গুরুত্ব দেয় না। ৬২ খৃষ্টাব্দের ৫ই ফেব্রুয়ারী একটা শক্তিশালী ভূমিকম্প হয় পম্পেই ও এর আশেপাশে। ৬৪ তে আবারও ভূমিকম্প হয়, কিন্তু কেউই গুরুত্ব দেয়নি কারন ভূমিকম্প ওই অন্চলের স্বাভাবিক ঘটনা, আর ভিসুভিয়াস যে একটা আগ্নেয়গিরি তাই লোকে তখন জানতো না! এগুলো ছিল ভিসুভিয়াসের প্রস্তুতিপর্ব। ২০ শে অগাস্ট ৭৯ তে ঘন ঘন ঝাকুনি শুরু হয় এবং পরবর্তী ৪দিনে তা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। তাও লোকজনের হুশ হয়নি, কেউ পালিয়েও যায়নি। অবশেষে ৭৯ খৃষ্টাব্দের ২৪ শে অগাস্ট সকালে শুরু হয়ে যায় কেয়ামত! পরবর্তী ২৪ঘন্টায় একটা আড়ম্বরপূর্ণ, প্রানচন্চল উন্নত নগরী শ্রেফ উধাও হয়ে যায় পৃথিবীর মানুষের চোখের সামনে থেকে। পম্পেই ও এর আশেপাশের লোকসংখ্যা তখন ছিল আনুমানিক ১৬ থেকে ২০ হাজার। পরবর্তীতে মাত্র দেড় হাজার দেহ বা দেহাবশেষ পাওয়া যায়, বাকীদের অল্পকিছু নিশ্চিতভাবেই পালাতে পেরেছিল আর অবশিষ্টরা হয়তোবা শ্রেফ বাস্প হয়ে উড়ে গিয়েছিল প্রচন্ড উত্তাপে।
কেমন ছিল এই কেয়ামত? অগ্নুৎপাতের ফলে যে মেঘের সৃষ্টি হয় তার উচ্চতা ছিল প্রায় ২১ মাইল। ভিসুভিয়াসের জ্বালামুখ থেকে প্রতি সেকেন্ডে দেড় লাখ টন গলিত লাভা, পাথরের গুড়া আর তপ্ত ছাই বেরিয়ে আসতে থাকে। এর থার্মাল এনার্জি ছিল হিরোশিমা-নাগাসাকির দু’টা এটম বোমার মিলিত শক্তির চেয়ে এক লাখ গুন বেশি। ভারী, ঘন ধোয়া সূর্যকে পুরোপুরি ঢেকে দেয়। উল্টাদিকের নেপলস বে এর এক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায়, ” পৃথিবীর অন্যত্র তখন দিন ছিল, কিন্তু সেখানের নিকশ কালো অন্ধকার ছিল রাতের অন্ধকারের চেয়েও ঘন”! অগ্নুৎপাতের ফলে ভিসুভিয়াস থেকে যে লাভা, পিউমিস আর ছাই বেরিয়ে আসে তার গতি এত দ্রুত ছিলো যে অধিবাসীরা খুব বেশি সময় পায়নি পালাবার। মনে রাখতে হবে যে, তখন পায়ে হাটাই ছিলো যাতায়াতের অন্যতম উপায়, আর এলাকাটা পর্বতময়! ঘোড়ায় টানা গাড়ী খুব ধনী কয়েকটা পরিবার ছাড়া আর কারো কাছেই ছিলো না। এর সাথে যোগ হয়েছিলো ঘন ঘন ভুমিকম্প এবং নেপলস উপসাগরে সৃষ্ট সুনামী।
সত্যি বলতে ভিসুভিয়াস কাউকে বাঁচার ন্যুনতম সুযোগও দেয়নি। অগ্নুৎপাতের সময় তাপমাত্রা ৩০০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের উপরে উঠে গিয়েছিল! বাতাসে মিশে গিয়েছিলো সালফার ও অন্যান্য বিষাক্ত গ্যাস। একদিন পর যখন অগ্নুৎপাত বন্ধ হলো, ধোয়া আস্তে আস্তে সরে যেতে লাগলো ততক্ষণে পুরো এলাকা চাপা পড়ে গিয়েছে ১৫ থেকে ১৭ ফুট উচু পিউমিস আর ছাই এর নীচে। আমুল বদলে গিয়েছে পুরোটা ল্যান্ডস্কেপ। আর একটা কথা, বছরের ওই সময়ে ওখানে বায়ুপ্রবাহ থাকে সাধারনভাবে দক্ষিন-পশ্চিম মুখী, আর অগ্নুৎপাতের দিন বায়ুপ্রবাহ ছিলো উত্তর-পশ্চিম মুখী; অর্থাৎ সোজা পম্পেই এর দিকে! একে গজব ছাড়া আর কি বলা যায়?
১৭৪৮ সালে শ্রমিকেরা রাজা তৃত্বীয় চার্লসের প্রাসাদ বানানোর জন্য ওই এলাকা খোড়াখুড়ি শুরু করলে আধুনিক বিশ্বের সামনে প্রথম উন্মোচিত হয় মানব ইতিহাসের অন্যতম এই বেদনাময় অধ্যায়!
দেখুন কেমন ছিলো পম্পেই, পম্পেইবাসীদের জীবন-যাত্রা এবং শেষ পরিনতি;
নগরীর অন্যতম প্রবেশদ্বার
কারুকার্য করা মেঝের মার্বেল পাথরের মোজাইক এবং দেয়ালে ফ্রেসকো। পম্পেইবাসীর রুচি ছিলো!
এম্ফিথিয়েটার, মূলতঃ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো এখানে
গ্লাডিয়েটররা যুদ্ধ করতো এখানে, চারপাশের ছোট ছোট ঘরগুলোতে ওরা থাকতো
নগরীর মূল এম্ফিথিয়েটার, তাই সাইজে অনেক বড়!
ব্যবহার্য তৈজসপত্র
ব্যবহার্য অলংকার, শুধুই কি নারীদের? পুরুষদেরও হয়তোবা!
কাউন্টারসহ মদের দোকান, দেয়ালে সম্ভবতঃ মাতালদের ফ্রেসকো। মাতালদের তীর্থস্থানে আর কাদের ছবি থাকবে!
House of the Tragic Poet, মেঝের কাজ দেখেছেন? ভদ্রলোকের রুচি ছিলো বলতেই হবে!
এটা একটা ইউনিক জিনিস। প্রায় প্রতিটা বাড়ীর মূল দরজা দিয়ে প্রবেশ করলে এমন চৌবাচ্চা দেখা যায়! ঠিক এটার ঠিক উপরে কোন ছাদ নাই। বৃষ্টির পানি এখানে জমা হতো। সামনের এমন পাত্রে তা সংরক্ষনও করতো।
কোনো এক হতভাগা!
রাস্তায় কিছুদুর পর পর এমন পথিকদের পানিপানের ব্যাবস্থা। সমাজকল্যানমুখী প্রশাসন!
নগরীর ফোরাম বা প্রাণকেন্দ্র। সোজা জিউসের মন্দির আর তার পিছনে ভিসুভিয়াস, সকল গাম্ভীর্য নিয়ে দন্ডায়মান!!
গ্রীক মিথোলজির সেন্টুর, অর্ধ ঘোড়া, অর্ধ মানব। ফোরামে স্থাপিত।
প্রচন্ড তাপে গলে যাওয়া পাথরে গাড়ির চাকার স্থায়ী চিহ্ন!
দেয়ালে মাটির পানির পাইপ, প্রযুক্তিতেও তারা কম ছিলো না!
আটা বানানোর জন্য বিরাট পাথরের যাতা আর চুল্লী। একটা রুটির ফ্যাক্টরী
মাথা নীচু করে দাড়িয়ে সমুদ্র, ভূমিকম্প আর ঘোড়ার দেবতা পসেইডন! ভাবছে, কেমন দেবতা হইলাম, এতগুলান মাইনসেরে বাচাইতে পারলাম না!!!!
প্রায় ৮ ঘন্টা ধরে আমি এই নগরীর রাস্তায় রাস্তায় হেটেছি। প্রচুর ছবি তুলেছি। হাটতে হাটতে আমার নেশা ধরে গিয়েছিল, নগরীর সাথে একাত্ব হয়ে গিয়েছিলাম। গভীরভাবে অনুভব করার চেষ্টা করেছি সেই দিনের প্রলয়ংকর প্রতিটা মূহুর্ত, কান পেতে শুনতে চেষ্টা করেছি ভয়ার্ত মানুষের করুণ আর্তনাদ! তাদের নিজেকে বাচানোর আকুতি আর প্রিয়জনকে বাচানোর ব্যর্থ প্রয়াস! যথাসম্ভব প্রতিটা বাড়ীতে, মন্দিরে উকি দেয়ার চেষ্টা করেছি, বিভিন্ন গাইডের বক্তব্য কান খাড়া করে শুনেছি (আমি কোন গাইড নেইনি)। আমাকে আশ্চর্য করেছে প্রচুর মদের দোকান - প্রতিটা রাস্তায়, অলিতে গলিতে! একপর্যায়ে আমার মনে হয়েছে এরা মদ ছাড়া বোধহয় অন্যকিছু খেতো না! প্রতিটা বাড়ির বর্ণনার সাথেই শুনেছি ভয়ংকর বিকৃত যৌনাচারের কথা। এই অবাধ পাপাচার বোধহয় সৃষ্টিকর্তার কাছেও অসহ্য ঠেকেছিল, না হলে এত অল্প সময়ে এই বিশাল আর ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ আর কার পক্ষেই বা সম্ভব!!! আর তাই যদি না হবে তাহলে সেদিন বাতাসইবা নিয়মের ব্যাতিক্রম করে ভিসুভিয়াসের দিক থেকে পম্পেই এর দিকে বইবে কেন???
তথ্য কিছু গুগলের, কিছু ওখানকার পরিচিতিমূলক পুস্তিকা এবং বোর্ডের, প্রথম ছবি দু’টা উইকিপিডিয়া থেকে, বাকিগুলো আমার ক্যামেরা এবং ফোনের।
চলবে.........
স্বপ্নযাত্রা: ইটালী - ৪
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০২০ রাত ৯:৩৬