খোকন স্যার হারিয়েই গেলেন!
১৯৮১-৮২ সালে তিনি আমার গৃহশিক্ষক ছিলেন। তাঁর সাথে আমার স্মৃতি হলো, একসঙ্গে গোসল করা। সংস্কার কাজে আমাদের পুকুরটি পানিশুন্য করা হয়েছিল।পাশের বাড়ীর পুকুরে তিনি আমাকে সাথে নিয়ে গোসল করছেন, আমার গায়ে সাবান মাখিয়ে দিচ্ছেন, এটুকু মনে পড়ে। পড়ার টেবিলে তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক কেমন ছিলো জানা নেই। হঠাৎ করে তিনি নিখোঁজ হয়ে গেলেন। বাড়ী যাওয়ার নাম করে সেই যে গেলেন, আর ফিরে এলেন না।
তাঁর অন্তর্ধানের পর একে একে বেশ কিছু রোমাঞ্চকর তথ্য প্রকাশ পেতে থাকল। তিনি নাকি পশ্চিম দিকে পা রেখে শুতেন, গরুর মাংসের তরকারী খেতেন না। তাঁকে নামাজ পড়তে কেউ দেখেনি, ইত্যাদি- ইত্যাদি। সবার ধারনা সম্ভবতঃ তিনি মুসলিম ছিলেন না।
যাই হোক, তিনি বাড়ী গিয়ে আর ফিরে এলেন না, তাঁর রেখে যাওয়া জামাকাপড়গুলো স্মৃতি হয়ে রইলো।
গৃহশিক্ষকের অভাবে আমার লেখাপড়া গোল্লায় যেতে লাগল। ক্লাস টু’র ফার্ষ্ট বয় ক্লাস থ্রি’তে হয়ে গেলাম ফিফথ্। এভাবেতো চলতে দেয়া যায় না, অভিভাবকের নিরলস প্রচেষ্টায় শিক্ষক হিসেবে এলেন নুরে আলম স্যার। লেখাপড়া এগিয়ে চললো। এসময়ে আমার সুন্নতে খতনা সমাধা হলো। খতনা উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে স্যার আমাকে দু’টি উপহার দিলেন-ইসলামিক ফাউন্ডেশান থেকে প্রকাশিত মহানবী’র মহাগুন এবং একটি ফাউনটেন পেন।বইটি পাওয়ার পর থেকে প্রতি রাতে শোবার সময় বইটি আমার পাশে থাকতো।একেকটা অধ্যায় পড়তাম আর অভিভুত হতাম। প্রায়শঃই ভাবতাম ইস্ আমি যদি নবীজির মতো হতাম!(পাঠক, ক্ষমা করবেন, কিশোরমনে ভাবনাটার এমনই ছিল)।
স্যার আমাকে তাঁদের বাড়ীতে নিয়ে গিয়েছিলেন। চট্টগ্রাম থেকে চাঁদপুর, সেই সাত বছর বয়সে! ট্রেনে করে লাকসাম নেমে রাতের খাওয়া, আবার ট্রেন, তারপর একই নদীতে দু’রঙের পানি, সেই নদী পাড় হলে স্যার’দের বাড়ী। সকালে ঘুম ভেঙে আশেপাশে পরিচিত মুখ না দেখে ধুমসে কান্না, অতঃপর হাঁসের মাংস দিয়ে ভাত খাওয়া। দু’দিন পার না হতেই মুষুলধারে বৃষ্টি অগ্রাহ্য করে বাড়ী ফেরা।
পড়ার টেবিলের কথা মনে পড়ে- স্যার আমাকে নামতা মুখস্থ করতে দিয়েছেন, খুব সম্ভব স্কুল ছটির দিন, সকালে। জানতাম, স্যার লিখতে দিবেন, আমি মুখস্থ করা বাদ দিয়ে, যার নামতা প্রতিবার তা যোগ করে নামতা মিলানোর ফাঁকিবাজি রপ্ত করলাম। মুখস্থ নামতা লিখছি, একেক কলাম লেখার পর, আঙুলের কড়া গুনে পরবর্তীটা নির্ধারণ করছি। স্যার অবাক, এ ছেলে নামতা লিখতে গিয়ে হাতের কড়ার কি গোণে?
ধরা খেয়ে গেলাম,
-উহু, এভাবে হবে না, ছন্দে ছন্দে মুখস্থ করতে হবে।
নামতা শেখানো নুরে আলম স্যারও বদলীজনিত কারনে চলে গেলেন। এলেন নতুন স্যার, জসীম উদ্দিন স্যার। নুরে আলম স্যারের সাথে পড়ার টেবিলে একটি মজার আবার দুঃখজনক ঘটনা আছে, তবে লেখা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না, পাঠক না আবার আমাকে ক্ষেপাতে শুরু করে, এগিয়ে যাই, সুযোগ বুঝে লেখা যাবে।
নুরে আলম স্যারের দেয়া কলমটিতে জসীম উদ্দিন স্যার আমার নাম লিখিয়ে আনলেন। কলমের গায়ে চক পেন্সিলের ঘষা দিলেই কী সুন্দর আমার নাম ভেসে উঠে, আমি ভীষণ খুশী! স্যার বেশী দিন থাকলেন না, উচ্চাকাঙ্খায় সরকারী চাকুরী ছেড়ে সৌদি পাড়ি জমালেন। নিয়মিত স্যারের চিঠি পেতাম, জবাবও দিতাম। আমার পড়াশোনার খোঁজখবর নিতেন, অগ্রজ আলাদা একটা কাগজে লিখে দিতেন, আমি দেখে দেখে নকল করতাম। পোষ্ট করতাম নিজেই, চিঠি আসতো সরাসরি আমার নামে। চিঠিতেই জানলাম স্যার হজ্ব ও ওমরা সম্পাদন করে বেশ আমেজে আছেন। এক ঈদে আমার জন্য একটি কার্ড পাঠালেন, কার্ডটি খোলার সময় একেকবার একেক রকমের টিউন বাজতে থাকে। আমি তাজ্জব।
একসময় স্যারের চিঠি আসা বন্ধ হয়ে গেল, স্যার হারিয়ে গেলেন।
পড়াশোনাতো চালাতে হবে, শিক্ষক ছাড়া আমার অবস্থা লেজেগোবড়ে। এলেন মিন্টু মোস্তফা স্যার।
চলবে….