somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

৪২ বছর ধরে যারা আমরা আমাদের স্বজন দের খুজে ফিরছি

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ দুপুর ১২:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




৪২ বছর ধরে যারা আমরা আমাদের স্বজন দের খুজে ফিরছি তাদের মত তিনটি শহিদ পরিবারের তিনজন সদস্য এসেছিলেন চ্যানেল আই সেরাকন্ঠ নামের টিভি অনুষ্ঠানে। শহিদ সৈয়দ সলিমুল্লাহ এর ছেলে সাদি মোহাম্মদ। শহিদ আলতাফ মাহামুদ এর মেয়ে শাওন মাহামুদ। শহিদ প্রকৌশলী ফজলুর রহমান এর ছেলে সাইদুর রহমান।
তিনজনই তাদের কষ্টের কথা বলেছেন। তাদের কাছের মানুষদের হারানোর কথা বলেছেন।যা এক হৃদয়বিদারক বাস্তব ঘটনার বর্ণনা। যা শুনে গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। চোখে পানি এসে যায় ।
শহিদ প্রকৌশলী ফজলুর রহমান এর ছেলে সাইদুর রহমান এর মুখে শুনুন (ভিডিও দেখতে ইউ টিউবে যেতে হবে , নিচে লিঙ্ক)
http://www.youtube.com/watch?v=1FjqYgAeSz8

............................................................আমি জানি এরা সবাই স্বাধীনতার পরে জন্ম গ্রহণ করেছে। যাদের হয়ত কোন স্মৃতিই মনে নেই । আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই। ১৯৭১ । আজ থেকে ৪২ বছর আগে, ১৫ ই এপ্রিল সেদিন বাংলা ১লা বৈশাখ ছিল।আমার বাবা সৈয়দপুর রেলওয়ে ওয়াকসপ এর মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। বাবার অপরাধ ছিল যে উনি প্রচণ্ড স্বাধীনতা কামি একজন মানুষ ছিলেন। এবং সবচেয়ে চূড়ান্ত যে দোষের কাজটি করেছিলেন সেটা হচ্ছে এপ্রিল এর প্রথম সপ্তাহে, আমাদের (সেই সময় যারা রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন তাদের দোতালা বাংলো ছিল) পুরানো বাংলোর আরথিং এর তার যা দোতালা থেকে নিচে মাটিতে চলে যায় সেই তারে তখনকার যেটা বাংলাদেশের পতাকা ছিল, মানচিত্র খচিত পতাকা, সেই পতাকা টাঙ্গিয়েছিলেন। এটাই হয়ে গেছিল আমার বাবার জন্য কাল । পরে পাকিস্তানি আর্মিদের সহযোগিতায় । বিহারিরা এবং পাকিস্তানি আর্মিরা যৌথ ভাবে আমাদের বাসায় অপারেশন করে। আমার বাবা তখন দোতালায়, চাশত এর নামাজ বলে, ১০ টা সাড়ে ১০ টার দিকে নামাজ পড়ছিলেন। বাবা কে বললাম, বাবা তাড়াতাড়ি মোনাজাত টা করে আমাদের সবাইকে নিচেরতলায় চলে যেতে বল্লেন। ওখানে যাবার পর আমাদের সবাইকে বল্লেন- তোমরা খাটের নিচে ঢুকে যাও। আমরা ৪ ভাই ২ বোন ছিলাম, সবাই আমরা খাটের ভিতর ঢুকে যাই এবং আমার মা ও ঢুকে পড়ে। আমার বাবা একা ওই দরজা হাত দিয়ে ধরে রাখে। আজকে ভাবতে খুব আবাক লাগে বাবা কিভাবে ভেবেছিলেন উনি একাই ঠেকিয়ে রাখবেন ওদেরকে।



ওরা প্রথমে দোতালায় যায় । তারপর সেখান থেকে নেমে এসে যখন দেখে কেউ নাই, বুঝতে পারে নিচতলায় সবাই আছে । শাবল দিয়ে ব্রিটিশ আমলের সেই বাড়িগুলোর দরজা ভেঙ্গে ফেলে। ভেঙ্গেই আমার বাবাকে দেখতে পায়। দেখার পরে, বাবা দৌড়ে যখন পালাতে যায় – তখন বেডরুমের দরজায়, প্রথমে বাবাকে ঠিক এই জায়গায়-{হাত দিয়ে উনি কোমর দেখান} কোমরটার এই জায়গায় স্টেপ করে, করার সাথে সাথে বাবা পড়ে যায় এবং ওখানেই শাহাদৎ বরন করেন ।
ওটা দেখে আমার মা খাটের নিচ থেকে চিৎকার করে বেরিয়ে আসে। আসার পর আমার মাকেও তারা বেয়নেট চার্জ করে। করার পর টেনে হিঁচড়ে আমার মাকে সিঁড়ি বারান্দায় নিয়ে যায়। আমি এগুলো সব লুকিয়ে লুকিয়ে খাটের নিচ থেকে দেখছিলাম। এবং আমার খুব অবাক লাগে আমি একটি কথাও বলিনি। আমার মা চিৎকার করে বলছিল যে আমাকে মেরে ফেল, আমার বাচ্চাদের মের না। খুব অনুনয় বিনয় করছিলেন ওদের কাছে। আর তোমাদের বলে রাখি যখন আমাদের বাসায় হত্যাকাণ্ড চালানো হয় তখন বঙ্গবন্ধুর নাম ধরে এবং জয়বাংলা স্লোগানের নাম ধরে অকথ্য ভাযায় গালাগাল করতে থাকে এরা। ঘাতক রা এই অবস্থায় আমার মাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়। আমার মা কিন্তু তখনও বেচেছিলেন। আমি এটুকু দেখেছি এবং পরে প্রতিবেশীদের কাছে শুনেছি যে – আমার বাবার শখের বাগান ছিল বাসার সামনেই – আমার মাকে জিবিত অবস্তায়, তখন আমার মায়ের দেহে প্রান ছিল। সেই অবস্থায় পুতে ফেলে ওই মাটিতে।
ওই দিন আমার তিন ভাই বেচে যায় আহত অবস্থায় । এরপর আমার বড় ভাই বের হয়ে আসে। বড় ভাই কেও তারা ছুরি মারতে থাকে বেয়নেট চার্জ করতে থাকে। তারপর, ছোট বোনটার বয়স তখন আড়াই বছর । ও {বড় ভাইর } কোলে ছিল। ওকে হত্যা করার জন্য...... ও {বড় ভাই }খালি কোল বদল করছিল। আমার ভাই এর পুরা দু পা ঝাঁজরা হয়ে যায়। এ অবস্থায় একটা পর্যায়ে ভাই ছোট বোনটাকে খাটের নিচে ফেলে দেয়। কিন্তু অবাক কান্ড যে ওই ছোট বোনটা একটুও কাদেনি। এর পর ও {বড় ভাই } পড়ে যায়। এর পর এক এক করে আমার বাকি দুই ভাই কেও টেনে হিঁচড়ে ওরা বের করে। বের করে তাদেরকেও............।
আমি ভেবেছিলাম –তারা বোধহয় মারা গেছে ওখানে। ওইদিন সৈয়দপুরএ প্রচুর বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছিল। ফলে এতই বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছিল যে লোকাল এডমিনিস্ট্রেশন তখন কারফিউ জারি করে সৈয়দপুরে ।কারফিউ জারি করার পর ওরা চলে যায়। এবং যাওয়ার সময় ওরা বলতে থাকে “ "ছব মার গ্যায়া, মার গিয়া”"। ইভেন আমাকেও লাথি মেরে , বুট দিয়ে লাথি মেরে বলে যে মরে গেছে ।
এরপর আমি ( ভাইদের ) একাকজন কে ডাকতে থাকি যে কেউ বেচে আছে কিনা। তখন দেখলাম আমার তিন ভাই জবাব দিয়েছে যে ওরা বেচে আছে আহত অবস্থায় ।আমি অতটুকু মানুষ তখন ক্লাস ফাইভ পাঁশ করে সিক্সে উঠেছি মাত্র। ওই অবস্থায় ওদের কে নিয়ে আমাদের বাসার কাছেই ছিল সৈয়দপুর রেলওয়ে হাসপাতাল ।ওখানে ওদের ভর্তি করি।করার পর সারাটাদিন আমার বোন আমার ছোট বোনটাকে কোলে নিয়ে আমাকে হাতে নিয়ে সারা সৈয়দপুর ঘুরে বেড়িয়েছে কেউ আশ্রয় দিতে চায়নি।ওই অবস্থায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। পরে একজন ডাক্তার এসে তার বাসায় নিয়ে আমাদের কে আশ্রয় দেয়। আমরা তিনদিন পযন্ত জানতাম যে আমার ভাইরা বেচে আছে। এরপর ১৮ এপ্রিল জানতে পারি আমার ভাইদের খুজে পাওয়া যাচ্ছে না।
সত্যি কথা বলতে স্বাধীনতার পরেও আমরা জানতাম ভাইরা বোধহয় পালিয়ে গেছে হাসপাতাল থেকে। কিন্তু পরে ওই হাসপাতালে যারা ছিল তারা আমাদেরকে জানিয়েছে যে –ওঁদেরকে পরে হাসপাতাল থেকে নিয়ে – তোমার ভাই এবং বোন দেখা করতে এসেছে এ কথা বলে হাসপাতাল থেকে ফুসলিয়ে নিয়ে যেয়ে হাসপাতালের পেছনেই একটা গর্তর মধ্যে তিন ভাইকে জবাই করে হত্যা করেছে।
এই হচ্ছে আমাদের পরিবারের ইতিহাস। যে ইতিহাস ১৯৭৫ এর পরে ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিল ঘাতকের দল। এদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল একটা গল্প। আজ তোমরা দেখতে পাচ্ছ মুক্তিযুদ্ধের তিনজন জলন্ত সাক্ষী বসে আছি। ৪২ বছর ধরে যারা আমরা আমাদের স্বজন দের খুজে ফিরছি। পারত পক্ষে এ সব অনুষ্ঠান গুলোতে আসতে চাই না আমরা কারন খুব আবেগ তাড়িত হয়ে পড়ি।
আমি একটা কথা বলবো আজকে, এমাসে যুদ্ধ অপরাধিদের বিচার চলছে। এই ৫৬ হাজার বর্গ মাইলের বাংলাদেশ পাকিস্তানি আর্মি কিন্তু চিনত না। তখন রাস্তাঘাট আরও খারাপ ছিল। তোমরা হয়তো জান না। এই রাজাকার রা পাকিস্তান আর্মিদের ( যারা ১২০০ মাইল দুরের থেকে এসেছিল) এই ৫৬ হাজার বর্গ মাইলে নিয়ে গেছে। নিয়ে এদেশের ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে। । আজকে তাদের বিচার চলছে। আমার খুব অবাক লাগে যারা ৯ মাসে এদেশের ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে। তাদের বিচার করতে কেন একটি সরকারের পুর মেয়াদ অথাৎ ৪ থেকে ৫ বছর লাগবে ?? এই বিচার ৯ মাসে হওয়া উচিত ছিল। তাহলে আজকে যে দৃশ্য তোমরা দেখছ তা হত না।
আমি এও প্রতিবাদ করি, আন্তর্জাতিক আইনের নামে যে বিচারের কথা বলা হচ্ছে । আমরা শহিদের সন্তানরা এতা মানি না। মানি না এই জন্যই – আমাদের ৩০ লক্ষ শহিদ কে যারা হত্যা করেছে তারা কোন আন্তর্জাতিক আইনে হত্যা করেছিল। তা যদি না হয়ে থাকে তাহলে আমাদের দেশের মানুষকে যারা হত্যা করেছিল তাদের বিচার আমাদের দেশের আইনেই হওয়া উচিত ছিল এবং তার জন্য ৯ মাস ই যথেষ্ট।

http://www.youtube.com/watch?v=1FjqYgAeSz8
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×