বড় বাঁধ মানে বড় বিপর্যয়। যত বড় বাঁধ হবে, জলবিদ্যুতের জন্য যত বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে, মানুষ আর প্রকৃতির ক্ষতি হবে তত বেশি। বাঁধ মাইলের পর মাইল জলমগ্ন করে, মানুষকে উচ্ছেদ করে তার ভিটামাটি থেকে, ঘরবাড়ি বনজঙ্গল ক্ষেতখামার ধ্বংস করে, নি্নভূমিকে বঞ্চিত করে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ থেকে, সুন্দর ভূপ্রকৃতিকে বিনষ্ট করে, ঐতিহাসিক ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিমগ্ন করে, প্রাণী ও উদ্ভিদবৈচিত্র্যের বিনাশ ঘটায়।
এর বাইরেও সমস্যা আছে। বড় ড্যাম বা আড়াআড়ি বাঁধ থেকে ভূমিকম্প হতে পারে, গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপাদিত হতে পারে, উপকূলে ক্ষয়ের কারণ হতে পারে, আর যদি কোনো কারণে বাঁধ ভেঙে যায়, তা হতে পারে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ। ১৯৭৫ সালে চীনে দুটো বড় বাঁধের ভাঙনে মারা পড়েছিল দুই লাখ ৩০ হাজার মানুষ।
এ সবই যেকোনো জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য তৈরি বাঁধ সম্পর্কে একেবারেই প্রাথমিক বিবেচ্য কথা, যা প্রকৌশলবিদ্যার প্রাথমিক পাঠেরই অন্তর্গত। আজকাল তাই বড় বাঁধ হওয়ার প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেই পরিবেশবাদীরা সেসবের বিরোধিতা করেন। খুব সংগত কারণেই করেন।
তাঁদের এই বিরোধিতার পেছনে থাকে তাঁদের শতাব্দীসঞ্চিত জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা। কিন্তু একটা পাহাড়ি এলাকায় যখন বাঁধ দেওয়া হয়, তখন যে পাহাড়িরা হারায় তাদের ঘরবাড়ি, পৈতৃক ভিটা, তাদের চাষাবাদ বা ফলচাষের জমি, তাদের পরিবেশ, তাদের প্রাণী আর বৃক্ষরাজি, তাদের প্রতিবাদটা কেবল পেশাজীবীদের বা সিভিল সোসাইটির নেতাদের মতো বিবেকের প্রতিবাদ থাকে না, তা হয়ে ওঠে জীবন-মরণের সংগ্রাম; কারণ এটা হয়ে ওঠে তাদের জীবন-জীবিকা, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য, জীবনচর্যা রক্ষার সংগ্রাম।
বাংলাদেশের আছে বাঁধ নির্মাণের ফলে পাহাড়ি আদিবাসীদের উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়ার অশ্রু ও রক্তক্ষরণের অভিজ্ঞতা। রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প করতে গিয়ে হাজারো পাহাড়ি উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছিল, যা পরবর্তীকালে বছরের পর বছর ধরে চলা রক্তাক্ত সংঘাতের অন্যতম প্রধান কারণ বলে বিবেচিত হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকেও আমরা বলতে পারি, বড় বাঁধ নির্মাণ করে বড় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র বানাতে যারা যাবে, তাদের জন্য অপেক্ষা করছে বড় বড় বিপদ।
এই কথা আমরা ভারতকে বলতে পারি। ভারত নির্মাণ করতে যাচ্ছে টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। উত্তর-পূর্ব ভারতের টিপাইমুখ নামের জায়গায় বরাক আর টুইভাই নদীর সংযোগস্থলে টিপাইমুখ বহুমুখী বাঁধ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে গেছে। ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে নর্থ ইস্ট ইলেকট্রিক পাওয়ার করপোরেশন (নিপকো) ২০১২ সালের মধ্যে সম্পন্ন করবে বলে এই প্রকল্পের কাজ শুরু করে দিয়েছে।
যথারীতি, এই প্রকল্পের সবচেয়ে বড় সমালোচক খোদ ভারতেরই পরিবেশবাদীরা, আর সবচেয়ে বড় বিরোধী মণিপুর, মিজোরাম ও আসাম রাজ্যের লাখ লাখ মানুষ। এই প্রকল্প চালু হলে ২৮৮·৬ বর্গকিলোমিটার ভূমি জলমগ্ন হবে, অনেক ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্থান জলমগ্ন হবে, বরাক ও অন্যান্য নদীতে পানিপ্রবাহ কমে যাবে, এক হাজার ৩২০টি আদিবাসী পরিবারসমেত ৪০ হাজার মানুষ জলমগ্নতার কারণে বাস্তুচ্যুত হবে। আর এই লেখার শুরুতে যেকোনো বাঁধ নির্মাণের ফলেই যেসব ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে বলে উল্লেখ করেছি, তার সবই ঘটবে। স্থানীয় আদিবাসীরা তাই ঘোষণা করেছেন, রক্ত দেবেন, কিন্তু টিপাইমুখ প্রকল্প তাঁরা হতে দেবেন না। (সূত্রঃ মিজিমা নিউজ, অক্টোবর ৩০, ২০০৩) সেটা ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আমরা এই বিষয়ে কথা বলতে চাই না।
আমাদের মাথাব্যথা আমাদের সুরমা, কুশিয়ারা, মেঘনা নদী আর তার অববাহিকায় এর ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে। ওই প্রকল্পটিতে সেচের জন্য শুকনো মৌসুমে প্রচুর পরিমাণে পানি সরিয়ে নেওয়া হবে বরাক নদী থেকে। আমাদের নদীতে পানিপ্রবাহ কমে যাবে; বিনষ্ট হবে নৌপথ; বিপর্যস্ত হবে গাছগাছালি, পাখপাখালি, প্রাণী ও মৎস্যকুলের জীবন; ফল-ফসল-কৃষিজমি ধ্বংস হবে, মরুকরণ ঘটবে, সমুদ্রের লোনা পানি ওপরে উঠে আসবে, পানীয় জলের সংকট দেখা দেবে। শীতকালে মরুকরণের কুফল ভোগ করতে হবে আবার বর্ষাকালে বাঁধের মুখ খুলে দিলে ভেসে যাবে আমাদের জীবন আর জনপদ। আর এই এলাকাটা ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা; আসাম ভূমিকম্প এখনো ইতিহাসে সবচেয়ে কুখ্যাত। ১৮৯৭ সালে সংঘটিত ‘গ্রেট আসাম ভূমিকম্প’ ছিল খুব মারাত্মক ও বড় মাপের। ভূমিকম্প সাধারণত ১০০ বছর পরে পুনরাবৃত্ত হয়। এটা আরেকবার ঘটবে, এই আশঙ্কার সময়কালেই আমরা বসবাস করছি। টিপাইমুখ জলাধার এই ভূমিকম্পকে ত্বরান্বিত করবে; এর ধ্বংসযজ্ঞকে করবে ভয়াবহতর। শুধু এই একটা বিবেচনাতেই এই প্রকল্প বাস্তবায়ন থেকে ভারতের বিরত থাকা উচিত।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিনের সূত্রে আমরা জানতে পারি, টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প যদি ভারত বাস্তবায়িত করে, তা হবে জাতিসংঘ জলপ্রবাহ কনভেনশন ১৯৯৭-এর লঙ্ঘন। এতে বলা হয়েছে পানির সমব্যবহার আর অন্যের ক্ষতি না করার কথা, সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে তথ্যবিনিময়ের কথা। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যেকার ফারাক্কা চুক্তি ১৯৯৬ অনুসারে সমতা, স্বচ্ছতা ও অন্যের ক্ষতি না করার বিষয়েও আমরা পরস্পর অঙ্গীকারাবদ্ধ। বিশ্বব্যাংকের পরিবেশ নীতিমালা, বিশ্ব বাঁধ কমিশন নীতিমালা, আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য ঘোষণা, জাতিসংঘের আদিবাসী অধিকার ঘোষণা, উন্নয়নবিষয়ক জাতিসংঘের ঘোষণা ও সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণারও পরিপন্থী হবে এই প্রকল্প।
ভারত কিন্তু কাজে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। ওদের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এটাকে সবুজ সংকেত দিয়েছে ২০০৬ সালে, কেন্দ্রের জ্বালানিমন্ত্রী সুশীল কুমরা সিন্দে ওই বছর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনও করেছেন। এখনকার খবর, প্রকল্পে লোক নিয়োগের নামে স্থানীয় যুবকদের কাছ থেকে ২০ হাজার আর ৪০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে প্রতারিত করেছে কোনো প্রতারক চক্র। (সূূত্রঃ দ্য সাংগাই এক্সপ্রেস, ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯)
বাংলাদেশ শুরু থেকেই এই টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছে। ২০০৪ সালে ডেইলি স্টার-এ প্রকাশিত এক খবরে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের সদস্য তৌহিদ আনোয়ারকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে ভারতীয় উদ্যোগের ব্যাপারে কূটনৈতিক সূত্রে তিনবার আপত্তি জানানো হয়েছে। যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকেও এ ব্যাপারে বাংলাদেশের আপত্তি উত্থাপন করা হয়।
সম্প্রতি আবার বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। এর মধ্যে ভারতের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে বাংলাদেশ থেকে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করতে; আশ্বস্ত করা হয়েছে, কোনো কিছু আপত্তিকর থাকলে তা ভারত শুনবে। এ বছর এপ্রিলের ১৪ তারিখে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব শিবশংকর মেননের আক্নিক ঢাকা সফরের সময় এই আহ্বান জানানো হয়। বলা হয়, ঘটনাস্থল না দেখে প্রত্যেকে মন্তব্য করছেন, এটা ঠিক নয়। আর ভারত মনে করে, ভাটিতে এই প্রকল্প কোনো প্রতিক্রিয়া ফেলবে না। আর বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলে রাজনৈতিক ও কারিগরি বিশেষজ্ঞ যে কেউ থাকতে পারেন; ভারতের কোনো আপত্তি নেই। আরও বলা হয়, বন্ধু দেশের মধ্যে এটাই হওয়া উচিত; বসা, জানা, বোঝা, আলোচনা করা।
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি জাতীয় সংসদে মার্চ মাসে বলেছেন, বাংলাদেশ মেঘনা নদীর পানি বণ্টন বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে কোনো মতৈক্য না হওয়া পর্যন্ত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করতে দিল্লিকে অনুরোধ করেছে। দিল্লিও টিপাইমুখ প্রকল্পের কারিগরি তথ্যসমূহ বাংলাদেশকে দেখাতে রাজি হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এও বলেছেন, বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কিছু করা থেকে ভারত বিরত থাকবে বলে ভারতের পক্ষ থেকে আশ্বাস পাওয়া গেছে। গতকালের প্রথম আলো (১৮ মে ২০০৯) জানাচ্ছে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টি ভারত সরকারকে জানানো হয়েছে। ভারতের নতুন সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা হবে এবং আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
ভারত আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে, প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনের জন্য প্রতিনিধি দল পাঠানোর জন্য বলেছে, বলেছে বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনায় বসতে-এ সবই ভালো দিক। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে। এটা আমাদের সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে। এ জন্য চাই তথ্য। তথ্যের বিনিময়ও তাই দরকার। অর্থাৎ দরকার বিনিময়, দরকার আদান-প্রদানের সুস্থ সৌহার্দøপূর্ণ উদ্যোগ ও পরিবেশ।
বড় বাঁধ মানে বড় ক্ষতি। ভাটিতে বাংলাদেশের ক্ষতি; উজানে প্রকল্প এলাকাতেও মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনা। এ বিষয়ে ভারতের পরিবেশবাদীরা সক্রিয় আছেন। বাংলাদেশেও পরিবেশবাদীরা সোচ্চার। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে মানব-পরিবেশ ও জীববান্ধব উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করতে সারা বিশ্বের নীতিনির্ধারকদের উদ্বুদ্ধ করা আর মানুষ-জীবজগৎ-পরিবেশবিরোধী প্রকল্প গ্রহণ থেকে নিরত রাখা এখন আমাদের কর্তব্য।
তবে মনে রাখতে হবে, আমরা ভারতের কাছ থেকে কেবল বন্ধুত্ব চাইব, বিনিময়ে আমরা বন্ধুত্বের কোনো নিদর্শন দেখাব না, এটাও বাস্তব নয়। বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করে, বাংলাদেশের জন্য লাভজনকভাবে ভারতের সঙ্গে সহযোগিতার হাত বাড়াতে যেন আমরা দ্বিধা না করি। তখন যেন আমাদের অকারণ রাজনৈতিক ভারতবিরোধিতায় পেয়ে না বসে।
আর ভারতের কোনো পদক্ষেপ, কোনো প্রকল্প যদি আন্তর্জাতিক কনভেনশনের লঙ্ঘন হয়, বাংলাদেশের জন্য হয় সমূহ ক্ষতির কারণ, আমাদের অবশ্যই সমস্বরে তার প্রতিবাদ করা উচিত। টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প এমনি এক প্রতিবাদযোগ্য উদ্যোগ। এ জন্য চাই জনসচেতনতা আর কূটনৈতিক উদ্যোগ।
(অরণ্যে রোদনঃ দৈনিক প্রথম আলো ১৯শে মে ২০০৯ইং)
লেখকঃ আনিসুল হক (সাহিত্যিক, সাংবাদিক)।
Click This Link