পাঠকদের নিশ্চয়ই ২০০৪ সালের ২৬শে ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ায় সুমাত্রার কাছে সংঘটিত ভুমিকম্পের দরুণ ভয়াবহ সুনামীর উৎপত্তির কথা মনে আছে। এতে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত, শ্রীলংকা সহ সদুর সোমালিয়া পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ঐ সুনামী তে সোমালিয়াতে ইউরোপিয়ানদের রক্ষিত পরমাণু ও বিষাক্ত বর্জ্য ফেলার স্থান সুনামী ঢেউ দ্বারা সাগরে মিশে এবং দেশটির উপকুল সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে ছড়িয়ে যায়। পরে ২০০৫ সালের ৪ঠা মার্চ দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবুর্গ হতে টাইমস্ নিউসপেপারস লিঃ এর একজন প্রতিনিধি Jonathan Clayton এর লিখিত বিস্তারিত আর্টিকেল প্রকাশিত হয়।
***********************
বিশাল আকৃতির সুনামীর ঢেউ গুলো যুদ্ধক্ষত সোমালিয়ায় রক্ষিত অবৈধ পরমাণু ও বিষাক্ত বর্জ্য ধুয়ে নিয়ে যায় যা রাখা হয়েছিল ৯০ দশকের শুরুতে।
জাতিসংঘের পরিবেশক বিষয়ক UNEP এর একজন মূখপাত্র জানান ঐ সুনামীতে ৩০০ জন সোমালীর প্রাণহানি, হাজারও ঘরবাড়ী ধ্বংস সহ অবৈধ ভাবে রক্ষিত বর্জ্য গুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
প্রাথমিক রিপোর্ট নির্দেশ করে যে সুনামীর ঢেউ গুলো বিষাক্ত বর্জ্যের দ্বারা পূর্ণ কন্টেইনারের মুখ গুলো খুলে সেগুলো কে বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে। জাতিসংঘের মূখপাত্র নিউক নিউট্টাল টাইমস্ কে ঔষধের বর্জ্য, বিভিন্ন রাসায়নিক বর্জের কথা জানান।
আমরা জানতে পেরেছি যে এই বর্জ্যগুলি আশে পাশের বিভিন্ন গ্রামে ও এলাকার মাটিতে ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা এই সমস্যার পুরোটা জানি না।
মিঃ নিউট্টাল জানান জাতিসংঘের সহায়তায় আফ্রিকার এই আইন-কানুন বিহীন দেশ থেকে ফিরে আসেন(১৯৯১ সাল হতে কোন সরকার নেই) ও রিপোর্ট করেন উত্তর সোমালিয়ার এলাকাগুলি তেজস্ক্রিয় রোগের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আমাদের আরও তথ্য দরকার। আমাদের কে বের করা প্রয়োজন যে সেখানে আসলে কি হচ্ছে, তিনি যোগ করেন যে সেখানে প্রকৃত কারণ রয়ে গেছে। আমাদের কে সেখানে জরুরী ভিত্তিতে বহু প্রতিষ্ঠানের দক্ষ বিশেষজ্ঞদের মিশন পাঠানো প্রয়োজন, যা UNEP এর নেতৃত্বে পূর্ণ তদন্ত হবে।
জাতিসংঘের প্রাথমিক রিপোর্ট বলে যে সোমালিয়ার উত্তর পূর্ব ভারত মহাসাগর সংলগ্ন শহড় হোবিয়ো ও বেনাদির এর বাসিন্দাগণের অনেকেই স্বাভাবিকের চেয়ে উচ্চ মাত্রার শাস-প্রশাসের রোগে আক্রান্ত, মুখের আলসার ও রক্তপাত, পেটের মধ্যবর্তী রক্তক্ষরণ এবং অস্বাভাবিক চর্ম রোগ।
সোমালী উপকূলের বর্তমান বিপদজনক পরিবেশ বিপর্যয় পরস্থিতি শুধু সোমালিয়ার নয় বরং পুরো পূর্ব আফ্রিকার উপ-আঞ্চলিক সমস্যা বলে রিপোর্টে প্রকাশ। সোমালিয়া এই বিষাক্ত বর্জ্য রাখা শুরু হয় ৮০ দশকের শেষ ভাগে এবং ১৯৯১ সালের গৃহযুদ্ধের দ্বারা মৃত মোহাম্মাদ সিয়াদ বারী কে উৎখাতের পর এই রাখার হার আরো বৃদ্ধি পায়।
স্থানীয় যুদ্ধবাজ যারা মৃত সিয়াদ বারীর উৎখাতকৃত সরকারের মন্ত্রী ছিল তারা সুইস ও ইটালিয়ান কোম্পানী গুলো হতে বড় অংকের পেমেন্ট পায়। বেশীর ভাগ বর্জ্যই সোমালিয়ার দূরবর্তী সৈকত গুলিতে কন্টেইনারে এবং ছিদ্রযূক্ত ডিসপোজেবল ড্রাম সমূহের মধ্যে রাখা হয়। সোমালী সুত্র গুলি যারা এই বাণিজ্যের সাথে জড়িত ছিল তারা জানায় বর্জ্যকৃত দ্রব্যের মধ্যে ছিল তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম, সীসা, ক্যাডমিয়াম, পারদ, শিল্প ও হসপিটালের বিভিন্ন রাসায়নিক এবং অন্যান্য বিষাক্ত বর্জ্য। ১৯৯২ সালে ইউএনইপ জানায় যে ইউরোপিয়ান কোম্পানীগুলি এই ব্যাবসার সাথে জড়িত কিন্তু সোমালিয়ায় নিরাপত্তাজনিত সমস্যার কারণে তারা এই বর্জ্যের বিষয়ের পরিণতির সমস্যার ব্যাপারে সেখানে কোন সহায়তা দিতে পারেনি।
ইটালীর পত্রিকা ক্রিষ্টিনা ফ্যামিগলিয়া এবং ঐ দেশেরই গ্রীণপিস যৌথ উদ্যোগে তদন্ত চালিয়ে এই পরমাণ বর্জ্যের ফেলা স্থান নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবদেন প্রকাশ করে ১৯৯৭-৯৮ সালে। ঐ প্রতিবেদন সমূহে বিস্তারিত ভাবে সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক কোম্পানী এচেয়ার পার্টনারস এবং ইটালীর প্রোগ্রেসো জড়িত থাকার ঘটনা উল্লেখ করে।
ইটালীর পত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার পর ইউরোপীয়ান গ্রীণপিস ই ইউ পার্লামেন্ট ষ্টার্সবূর্গে উক্ত দুটি ইউরোপীয় কোম্পানীর সাথে সোমালিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আরী মাহদি মোহাম্মাদ মধ্যকার চুক্তিপত্রের কপি প্রদর্শন করে। ঐ চুক্তিতে দেখা যায় ১ কোটি টন বিষাক্ত বর্জ্য সোমালিয়ায় রাখা হয় ৮ কোটি মার্কিন ডলারের(যা বর্তমানে ৬ কোটি ইউরো) বিনিময়ে। প্রেসিডেন্ট মাহদি সহ তার সাথের লোকজনের মধ্যে এই অর্থের ভাগ বাটোয়ারা হয়।
সুইডেনে অধ্যায়নরত সোমালী ছাত্র আব্দুল্লাহী এলমী মোহাম্মাদ টাইমস্ কে জানায় প্রতি টনের জন্য তার দেশের হর্তকর্তারা ৮ ডলার করে পায়, যা ইউরোপে রাখতে গেলে প্রতি টনের জন্য ১০০০ মার্কিন ডলার দিতে হয়।
মিঃ আলি মাহদি যিনি উত্তর মোগাদিসুর নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং ১৯৯২-৯৫ সালে মানব বিপর্যয়ের উদ্ধারের জন্য জাতিসংঘের মানব সহায়তা কার্যক্রমের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত ছিলেন তিনি সর্বদা ইটালীর সংসদ কর্তৃক বিভিন্ন ধারাবাহিক এতদাসংক্রান্ত অভিযোগের কথা অস্বীকার করেন।
Click This Link
আজকে সোমালীয়দের একটি গ্রুপ লোহিত সাগর ও ইয়েমেনের এডেন বন্দরে জলদস্যুতার সাথে জড়িত। কিন্তু সোমালিয়ার এই বিপর্যয়ের জন্য আসলে কারা দ্বায়ী? কারা সেখানে বিভেদ সৃষ্টি করে অস্ত্র ব্যাবসা ও পরমাণু-বিষাক্ত বর্জ্য রেখে মানবিক বিপর্যয় ঘটায় উপরোক্ত রিপোর্টে সেটা আমাদের কে জানান দেয়। এখন প্রশ্ন হল জাতিসংঘ, আমেরিকা, ইউরোপ তথাকথিত গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ফেরিওয়ালারা এ বিষয়ে কি সোমালীয়া ও সে দেশের জনগণের সাথে সুবিচার করবে? নাকি সেদেশে বিপর্যয় অব্যাহত রেখে সোমালীয়দের কে আজীবন দস্যু ও ব্যার্থ অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে রাখবে?