তাসলিমা!
ওকে আদর করে অনেকেই ডাকত লিমা। লিমা নামটা আধুনিক আর তাসলিমা নামটা সেকেলে। আরবি নামগুলোই কেমন যেন সেকেলে। আরবরা নিজেরাও যেমন। এমনকি এই আরব্য সংস্কৃতিটাকে যারা আকড়ে থাকে তারাও কেমন সেকেলে হয়ে থাকে। গত ১৪এপ্রিল একটা টকশোতে মোজাম্মেল বাবুর কিছু কথা শুনে মনে হলো বাংলাদেশে এমন একটা রাজনৈতিক দল বা গ্রুপ আছে যারা পরিকল্পিতভাবে আরব কালচারকে জোরকরে ধরে রাখতে চায়। তারা দুই ঈদের বাইরে কোনও উৎসব মানতে চায় না। এমনকি বাঙালি সংস্কৃতির প্রাণ পহেলা বৈশাখের আয়োজনেও তাদের ঘোর আপত্তি। নজরুল ইসলাম খানকে সামনে বসিয়ে উপর্যুপুরি যে ধারালো বাক্যবাণ ছুড়ছিল বেচারা একদম জবুথবু হয়ে বসেছিল। মোজাম্মেল বাবু ছাড়াও সেখানে ছিলেন জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষিকা অত্যন্ত এবঙ অতিমাত্রায় সুদর্শনা আর একজন শিক্ষক প্রগতিবাদী।
আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ক্লাসরুম ছেড়ে মাঠে ময়দানে না ঘুরে টিভির পর্দায় নিজেদের বিকিয়ে দিচ্ছেন দোরসে। যদিও সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের একজন শিক্ষক হিসেবে তাদের প্রথম দায়িত্ব ছিল ছাত্রদের মঙ্গল কীসে তাই দেখা, কিন্তু তারা নেমেছেন দলীয় এজেণ্ডার আওতায় নিরপেক্ষ তত্ত্বজ্ঞান প্রচারে।
একটু আগে ঢা.বির একজন সম্মানীত প্রফেসরের সঙ্গে কথা হলো। আমি তাকে আঙ্কেল ডাকি...
আঙ্কেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা কি?
গতানুগতিক! লেখাপড়া তেমন চলছে না।
নতুন ভি.সি আসায় কোনও পরিবর্তন কি ঘটেছে
তাতো ঘটেছেই, এতদিন যারা মাঠেঘাটে পড়েছিল, ছিনতাই রাহাজানি সন্ত্রাসী করে সময় কাটাচ্ছিল তাদেরকে ধরে আনা হচ্ছে হল দখলে। এখন এসব সোনার ছেলেরা থাকলেই হয়।...অন্তত পাঁচটা বছর থাকলেও অনেক কামাই রোজগারের পাশাপাশি কিছু জ্ঞানওতো পাবে। তা দেশের কী অবস্থা বলোতো? কী মনে হয়?
কী আর ভাবব! পিলকানার পরতো মনে হচ্ছিল দেশটা বুঝি ভারত নিয়েই নিচ্ছে...ওদের বাহিনী নাকি রেডি ছিল...কিন্তু হাসিনার শক্ত হ্যান্ডেলিং এ শেষপর্যন্ত রক্ষা পেল বলেই মনে হচ্ছে।
আসলে ভারত হলেওতো কথা ছিল, সবতো আমেরিকার চাল....
ভারতের নিজের অস্তিত্বইতো বিপন্ন! তারা নিজেরা কি কিছু করতে পারে? সবতো আমেরিকার ইচ্ছায় চলে....
আমার মতো ইলিটারেট মেয়ের সঙ্গে এরকম জটিল বিষয়ে আঙ্কেলের আলাপের কারণটা আমি বুঝি। প্রথমত কারণ যে মানুষ যতো বড়ো তার চিন্তা ততো বড়, বড় মানুষরা ছোটদের সাথেও বড় ব্যবহার করতে অভ্যস্ত। বলেনা ব্যবহারে বংশের পরিচয়। আর দ্বিতীয় কারণ আমার বর। আঙ্কেল তাকে অত্যন্ত স্নেহ এবং সম্মানের চোখে দেখেন। এবার একুশের অনুষ্ঠানে আঙ্কেলের সাক্ষাৎকার দেখেছিলাম। আমার বর আঙ্কেলের সাথে একমত। এবং তার সাহসী উচ্চারণের জন্য তাকে ধন্যবাদ দেন। যদিও আমি জানি তাদের রাজনৈতিক মত ভিন্ন!
ভুলেই গেছিলাম আসল প্রসঙ্গ! নাম! তাসলিমা। লিমা। গত সাতদিন ধরে লিমা আমার বাসায় আছে। লিমা দেখতে খুব সুন্দর। যে কারণে এতোদিন আমার বাসায় আসুক এটা আমি চাইলেও ওর জন্য সাহস করিনি। কিন্তু আর না করতে পারিনি। বেচারী খুবই বিপদে পড়েছে। সম্পর্কে যদিও ওর ভাগ্নির মতো। তবুও....আপনতো নয়....আর আজকাল এমনতো খুবই দেখছি....
আবার এও শুনি ঘরপোড়া গরুকে আশ্রয় দিলে সেই ঘরও পোড়ে.....আশঙ্কা সত্ত্বেও ওকে আমাদের বাসায় আনা হলো। কি ছিরি পোশাকের! অথচ এই মেয়েটাকে দেখলে যে কেউ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতো। এতো সুন্দর আর এতো সুন্দর শারিরীক মাপ। আমরা ওকে নায়ীকা বলতাম। হঠাৎ করে শুনলাম বিয়ের খবর! ক্লাস নাইনে পড়ে তখন! আপাকে বকলাম খুব! আপা বলে(দূরতম ফুপাতো বোন, )এখন একটা ছেলে পাইছি হাত ছাড়া করলে পরে কে বিয়া দিবো? তোরতো বাপচাচারা আছে অর আছে কে? কে নিবো অরে?
এক মাদ্রাসার দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষকের সাথে বিয়ে হয়। বিয়ের সময় সব আত্মীয় স্বজনরা মিলে এটা সেটা দিয়ে বিয়ে দেয়। কিছুদিন যেতে না যেতে হুজুর একটা হোণ্ডা দাবি করে বসে। মাদ্রাসাটা অনেক দূরে। যেতে আসতে অনেকটাকা খরচ যায়। তিনহাজার টাকা বেতন। চল্লিশটাকা রিক্সা ভাড়া দিলে আর থাকে কি?
আপা চালডাল কুড়িয়ে কাছিয়ে পাঠাতেন তবু ভাবতেন সুখেই আছে। কারণ আপার তখন আর কোনও পিছুটান ছিল না। সে ভাইদের বাড়ি ওবাড়ি ছেলেদের কাছে বেশ আয়েশেই কাটিয়ে দিতেন। আর তাকে পেলে সবাই খুশিই হতো। কাজের লোকটা আর দরকার হতো না। আর তিনি যেতেনও বিপদ আপদ জেনে। অমুকের মেয়ের ডেলিভারি আছে, বাচ্চার বাচ্চার মার যত্ন নিতে একজন আপন লোক দরকার! তিনি হাজির। অমুকের মার শেষদশা বিছানায় পড়েছেন, তার হাগুমুতু বিছানায় হয়, ধোয়া পরিষ্কারের জন্য তাকে ছাড়া আর কাকে চাই!
এই লিমার কাছেই শুনলাম ওর গল্প। স্বামী লোকটা কেমন তার গল্প!
ওর গল্পশুনতে শুনতে আমি ভুলে যাই সব। আমার স্বামীর প্রতি আমার যতো ক্ষোভ, দুঃখ, কষ্ট সব! মনে হচ্ছিল ওর মতো ভালো মানুষই হয় না। ওর যা দোষ শুধু রাগ বেশি। পি.সিতে বসে আমাদের ভিডিও দেখে লিমা বলে আন্টি আপনি মামার সাথে এরকম ব্যবহার করেন? বাবাহ! মামার অনেক ধৈর্য! ও দেখে ভিডিওতে আমি ওকে ঝারি দিচ্ছি। জিদকরে প্লেট ছুড়ছি, গড়গড় করছি....
লিমা সকালে উঠে রুমগুলো ঝাড়ু দেয়। রান্না করে। আর আমি ঘুমাই। বাবুটাকেও প্রায় ওই সামলায় আর আমি পায়ের উপর পা তুলে, শুয়ে বসে বেশিরভাগ সময় বইপড়ে কাটাই। বইপড়া দেখলে আমার স্বামীর মুখটা সুন্দর হয়ে যায়। পড়তে দেখলে ও যে কী খুশি হয়। যে বইই পড়ি। কদিন ধরে ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় এর উপন্যাস সমগ্রটা পড়ছি। টানটান আকর্ষণ। টি.ভি দেখা ভুলেই গেছি।
লিমা সবকিছু এমন পরিপাটি করে রাখে আমি অবাক হয়ে ভাবি ও পারে কী করে?
ওর জন্য দুইসেট নতুন জামা আনিয়েছি। আমি বলেছিলাম একসেট। ও এনেছে দুইসেট। আমি যদি কিছু বলি তাই কৈফিয়ত দেয় বলে গত ঈদে ফিতরা দেওয়া হয়নি। সেটার জন্যই বোধয় বিপদ হচ্ছিল। এখন শোধ গয়ে গেলো।
কই! নানুর বাসার বুয়াটাকে না একটা শাড়ী দিলে!
আরে ওইটাতো আরেক ঈদে! তোমার কি মাথা খারাপ? আমরা না এবার গ্রামের বাড়িতে ঈদ করছি। ...
হ্যা, কিন্তু ঈদের সময় দিলে না কেন?
দিব দিব ভেবেও দেওয়া হয়নি....
রানীর মাকে না কি দিলে?
কী দিলাম চিতিৎসার জন্য একশটাকা দিছি....ওইটাতো ধরো আমরা যাওয়ায় ওর কষ্ট কিছুটা বেশি হইছে তাই না! ওকে তো মা রাখছে শুধু তার কাজের জন্য, আমরা সবাই যাওয়ায় ওনার ঝামেলা কতোখানি বাড়ছে বলো! তাই বখশিশ হিসেবে দিছি, কিন্তু একচুয়েলি ওটা তার প্রাপ্য। কাউকে ঠকালে জীবনে জিততে পারবানা।
আশচর্য আমি কিছু বলছি নাকি। তুমি ফিতরার টাকা দিয়ে জামা কিনছ এইটা কেন বলতে গেলে! আমিতো তোমাকে কিছু বলিনি...
বলোনি তবু তোমাদের মেয়েদের কতোরকমের টর্চার থাকে। একদিন বলেই ফেললে এতো দরদ ক্যান?
লিমা খুবই খুশি।
ইদানীং ওর যত্ন অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন ও বাথরুমে ঢুকে কাপড় চাইলে আমার আগে লিমা দৌড়ে যায়। পানি চাইলে আমার আগে লিমা নিয়ে আসে। তবে আমার স্বামী ওর কোনও কাজের জন্য লিমাকে ডাকে না, আমাকেই ডাকে। কিন্তু সার্ভিস দেয় লিমা।
খেতে বসে প্রতিদিনই ও লিমার কথা জিজ্ঞেস করে, ও খাইছে?
আমি জানি না কেন এতে আমার এতো কষ্ট হয়। নতুন জামাগুলোতে ওকে এতো সুন্দর লাগছে যে মনেই হয় না কদিন আগে আসা সেই মেয়েটি যাকে দেখলে যে কারও নাকশিটকাতে হতো।...
লিমার সাথে পাল্লা দিয়ে আজকাল আমিও সেজেগুজে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আগে যেমন আমি কোনও ভালো ড্রেস পড়লে, সাজুগুজু করলে আমার স্বামী খুব আগ্রহ নিয়ে আদর করতো এখন আর তা করে না। কেন করে না? ওকি তবে আর আমাকে দেখে আকর্ষণ ফিল করে না? নাকি লিমার কাছে আমার সৌন্দর্য ম্লান মনে হয়?
কীসব আজেবাজে জিনিস ভাবি!
ওর কিছু বাজে অভ্যাস ছিল, বাথরুমে গিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে রাখতো, বন্ধ করতো না। যেহেতু রুমের দরজা বন্ধ আর কি দরকার। আমি রাগারাগি করতাম। বাইরে থেকে আটকে দিতাম। ও খেপে যাওয়ার আগে খুলে দিতাম। কমোডে বসলেই ওর পিপাসা পেতো। এমনকি বাবুটাও ওর পেছন পেছন গিয়ে ওর কোলে চড়ে বসতো। কমোডে বসে এসব ওর নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়। আর এখন! এসব যে ও কখনও করেছে সেটা ভাবাই কষ্টকর।
এতো ভদ্র হয়ে গেলো কেন ও!
যদিও সন্দেহ করার কিছু পাইনি তবু আজকাল ওকে কেমন অচেনা মনে হয়....
কিছু বলতে পারছি না, ওর যা মাথা গরম! কী থেকে কী হয়ে যায় এই ভয়ে।
বড্ড টেনশনে আছি।....
দোয়া করবেন। প্লিজ!