বাংলা প্রবাদ পর্বতের মূষিক প্রসব এবং তৎসংলগ্ন রূপকথার এই কাহিনী অনেকেই হয়তো জানেন। হিমালয়ের কোলে জনমানবহীন স্থানে সাধনা করতেন এক ঋষি । পাশে বয়ে যায় এক পাহাড়ি শীতলা নদী। তা একদিন নদীতে পড়ে যায় ছোট্ট এক মূষিক। অনেক কষ্টে তীরে ওঠে এবং শীতে কাঁপতে থাকে।ঋষির হৃদয়ে করুণা জাগে ,এর সেবা শুশ্রূষা করে একসময় সুস্থ করে তোলে।ঋষি তাকে একটি সুন্দর মেয়ের রূপ দান করে এবং নিজের কন্যা সন্তানের মতই তাকে বড় করতে শুরু করে।
ধীরে ধীরে মেয়েটি বড় হতে থাকে। একসময় সে বিয়ের উপযুক্ত হয়ে ওঠে । ঋষি মেয়ের কাছে জানতে চায় তার কেমন বর পছন্দ। মেয়ে বলে তার বরকে হতে হবে এই বসুধার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী।ঋষির সূর্যকে সবথেকে বেশী শক্তিশালী মনে হল। তা গেলেন তিনি সূর্যের কাছে। তাঁর কন্যাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু, সূর্য বেঁকে বসল ,বললো , আমি তো সর্বাপেক্ষা শক্তিমান নই। আমার চেয়ে শক্তিধর পৃথিবীতে আছে। আর, তা হলো মেঘ। এটি মাঝে মাঝে আমাকে ঢেকে দেয় !
সব শুনে ঋষি মেঘের কাছে গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। মেঘও চিন্তা করে বলল, "আমার চেয়েও শক্তিশালী হল পবন। সে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
এবার ঋষি পবনের কাছে গিয়ে সব খুলে বললেন। পবন বললো , আমি সর্ব শক্তিমান নই , সব জায়গায় চাইলেই আমি যেতে পারিনা। এই হিমালয়ের উপর দিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এই হিমালয় আমার চেয়ে অনেক শক্তিশালী।
ঋষি এবার গেলেন হিমালয়ের কাছে। বিশাল হিমালয়ের কাছে গিয়েও তিনি মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। সূর্য, মেঘ, পবন এর মত হিমালয়ও একই উত্তর দিল। হিমালয় ঋষিকে বলল, দেখতে বিশাল হলেও আমি সর্বক্ষমতাধর নই। আমার চেয়েও ক্ষমতাধর পৃথিবীতে আছে। আর এটি হল মূষিক । এই মূষিক আমার গায়ের ভিতর ফালা -ফালা করে সুড়ঙ্গ বানিয়ে দেয় ,আমি এর কিছুই করতে পারি না।
সবশেষে মূষিকের সাথেই ঋষি কন্যার বিয়ে হয়।তাই "পর্বতের মূষিক প্রসব", প্রবাদ প্রচলন।
যাকগে প্রাচীন কালের মাইথোলজি ,রূপকথা থাক।বর্তমান যুগে ফিরে আসি। এই এঁনারা মানে মূষিককুল না থাকলে ৭৫০ কোটি মানবপুঙ্গব হয়তো আজ পৃথিবীতে দাপিয়ে বেড়াতে পারতো না। মানে বুঝলেন না?? ঘটনা হচ্ছে গত ১০০-১৫০ বছরে আমাদের মানে মানবকূলের দীর্ঘায়ূ হওয়ার পিছনে ওই মূষিককূলের অবদান অপরিসীম !
পৃথিবীতে প্রায় সমস্ত মেডিসিনের পরীক্ষামূলক ট্রায়াল কিন্তু বিজ্ঞানীরা মারেন ওই বেচারা মূষিককূলের ওপর। মানবকূলকে দীর্ঘায়ু করতে এঁনাদের কুরবানী নিয়ে ইতিহাস লেখা না হলেও এক-আধটা রূপকথা কি তাদের প্রাপ্য নয় ?!
মূষিককূলের ওপর মেডিক্যাল রিসার্চের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। অন্য জীব জন্তুরও অবদান আছে --বানর ,ঘোড়া ,গিনিপিগ ইত্যাদি ---কিন্তু মূষিককুলের অবদান সর্ব আগে।
কিন্তু কেন এই মূষিকগণ ? এর বিজ্ঞানভিত্তিক কারণ আছে। এরাই একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী যারা গৃহপালিত এবং সংখ্যায় অগণ্য। তুচ্ছ এই এনারা এবং সর্বশ্রেষ্ট প্রাণী মানব পুঙ্গবদের মগজের গঠন এবং কার্যকলাপে অনেক সাদৃশ্য আছে। সাধারণত মানুষের খাবারই এরা খায় , পাচনতন্ত্রের সাদৃশ্য আছে এবং মানুষের মত মোটামুটি একই ধরণের রোগে ভোগে --হ্যাঁ অবাক হবেন মূষিককুলেরও শারীরিক স্হূলতা এবং ডায়াবেটিস হয় , ক্যান্সার এবং হৃদযন্ত্রের রোগ দেখা যায় এবং নিউরোলজিকাল রোগ যেমন পার্কিনসন ডিজিজ ইত্যাদি হয়।
যাইহোক মানবকুল অকৃতজ্ঞ ! নিজেদের আয়ু বাড়িয়েছে মূষিককুলের আত্মত্যাগএর বিনিময়ে। কিন্তু মূষিকগণ ছাড়বে কেনো ?? পর্বতকে ফালা ফালা করে দেওয়া মূষিকগণও বহুত পাওয়ারফুল ! তারা প্রতিশোধ নেয়। প্রতিশোধ বলে প্রতিশোধ ! পৃথিবীতে ম্যালেরিয়ার পর সবথেকে বেশী মানুষ মারা গেছে প্লেগে। যারা বেঁচে গেছে তাদের উত্তরপুরুষরা কিন্তু সুখে নেই ! আধুনিক , দীর্ঘায়ু মানুষ কেমন নাকে দড়ি লাগিয়ে চরকির মতো ঘুরছে --Rat Race নামক আজব দৌড়ে!!
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুলাই, ২০১৭ বিকাল ৩:৫৪