সময় এখানে থমকে গেছে ৭০,০০০ বছর আগে।
হ্যাঁ , ঠিক পড়েছেন। পৃথিবীর এই জনজাতির জন্য সময় থেমে আছে এই আন্দামানে। এরা জারোয়া -- এই আধুনিক আমাদের পূর্বপুরুষ। বর্তমান আমাদের এই আধুনিক ,তথাকথিত সভ্য ,শিক্ষিত ,চাঁদে ,মঙ্গলে উপগ্রহ পাঠানো , কম্পিউটার -ইন্টারনেট চালানো উত্তর পুরুষদের থেকে তাদের দূরত্ব লক্ষ আলোকবর্ষ। প্রকৃতির অংশ হয়ে গভীর জঙ্গলে তারা বেঁচে আছে একই ভাবে হাজার হাজার বছর ধরে আন্দামানের জঙ্গলে। সংখ্যায় তারা মাত্র ৩৫০-৪০০।
এনথ্রোপোলজিস্টরা অনুমান করেন প্রায় ৬৫-৭০ হাজার বছর আগে আফ্রিকার কোনো গহীন জঙ্গল থেকে যে কোন কারণে বা যেকোন ভাবে সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে তারা আসে আন্দামানে। আফ্রিকা থেকে আন্দামান এই হাজার হাজার কি.মি পথ তারা কি ভাবে পাড়ি দিয়ে ছিল ,তাদের সংখ্যা তখন কত ছিল তার কোন তথ্য নেই কারও কাছে।
হাজার হাজার বছর ধরে তারা বাস করছে একই ভাবে। আধুনিক মানুষের পোশাক -পরিচ্ছদ তাদের কাছে অজানা , জঙ্গলে গাছের পাতা বা ছাল দিয়ে বানানো তাদের পরিধান , অধিকাংশ সময়ে তারা সম্পুর্ণ উলঙ্গ থাকতে পছন্দ করে। তারা hunter -gatherer , বন্য শূকর ,হরিণ , লিজার্ড এবং সামুদ্রিক মাছ এবং কচ্ছপ শিকার করে। সভ্য জগৎ এবং তার সভ্য মানুষদের তারা পছন্দ করে না , তীর -ধনুক নিয়ে তেড়ে যায়।
জারোয়াদের বর্তমান বাসস্থান :
এরা বাস করে সংরক্ষিত বনাঞ্চল , প্রায় ৯০০ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত আন্দামান দ্বীপের জারোয়া রিসার্ভ ফরেস্টে। আন্দামান দ্বীপের একদম দক্ষিণ প্রান্তে আছে এর প্রধান শহর পোর্ট -ব্লেয়ার। এটি ভারতীয় নেভীর একটি বেস। বেশ কয়েক বছর আগে আন্দামান প্রশাসন নির্বুদ্ধিতার চরম পরিচয় দিয়ে উন্নয়নের নামে পোর্ট -ব্লেয়ার এবং উত্তর আন্দামান মধ্যে তৈরী করে এক সংযোগ কারী রাস্তা -আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড যার প্রায় ৬০ কি.মি গেছে জারোয়া রিসার্ভ ফরেস্টের ভিতর দিয়ে।
এই ট্রাঙ্ক রোড বিভিষীকা নিয়ে আসে জারোয়াদের আদিম ,প্রাকৃতিক জীবনে। আধুনিক সভ্য ট্যুরিস্ট /বহিরাগতরা হাজারে হাজারে ধেয়ে আসে ভারত এবং বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চল থেকে।ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠে অসংখ্য ট্যুর -অপারেটর , তারা চালু করে জারোয়া রিসার্ভ ফরেস্টে জঙ্গল -সাফারী। ট্যুরিস্টরা আসে তাদের খাদ্য নিয়ে ,বস্ত্র নিয়ে ,নেশা করার সামগ্রী এবং মানষিক বিকৃতি নিয়ে। অভিযোগ ওঠে জারোয়া শোষণের ,তাদের নেশা করানোর ,খাদ্যের বিনিময়ে তাদের নাচ করানোর এবং শ্লীলতাহানীর।প্রমাদ গনেন পরিবেশবিদরা।
আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড এবং জঙ্গল -সাফারী বন্ধ করার জন্য মামলা হয় সুপ্রিম কোর্টে ২০১৩ সালে । কোর্ট জঙ্গল সাফারী বন্ধ করে , ট্যুরিস্টদের জারোয়া দের সাথে কোনোরকম সম্পর্ক এমনকি জঙ্গলে তাদের ফটো তোলা বে-আইনি ঘোষিত হয়।
ট্রাঙ্ক রোড বন্ধ হয় না , পুলিশ পাহারায় দিনে ষাটটি গাড়ী এই রাস্তায় চলাচলের অনুমতি দেয় , জারোয়াদের সাথে ট্যুরিস্ট /বহিরাগতদের কোন রকম ইন্টারঅ্যাকশন এখন শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
সভ্য সমাজ বিতর্ক করে তাদেরকে কি ওই ভাবেই থাকতে দেওয়া উচিত যে ভাবে তারা ৭০ হাজার বছর ধরে আছে না তাদের সভ্য সমাজের অংশীদারি করা দরকার। তাদের পোশাক -পরিচ্ছেদ ,শিক্ষার আলো , আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া উচিত না সংরক্ষিত বনে আদিম জীবনই ভাল। বিশেষজ্ঞ দের মধ্যে এই বিতর্কে কোন সহমত নেই।
পৃথিবীর বেশীরভাগ হিউমান রাইটস অর্গানাইজেশন এবং এনথ্রোপোলজিস্টরা বলেন ( এটাই মেজরিটি ভিউ ) এরা যে ভাবে আছে সে ভাবেই থাকতে দেওয়া উচিত। অভিজ্ঞতা বলে আধুনিক সভ্য জগৎ এবং মানুষের সাথে তাদের সংযোগ এই আদিম জনজাতিদের পক্ষে ভীষণ ক্ষতিকর। পৃথিবীর অনেক প্রান্তে অসংখ্য আদিম জনজাতি এর ফলে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
কয়েক বছর আগে আন্দামান প্রশাসন এই আদিম জনজাতিদের ভবিষৎ পরিকল্পনা ঠিক করতে এক আন্তর্জার্তিক কনফারেন্সএর আয়োজন করে যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ এনথ্রোপোলজিস্ট ,হিউমান রাইটস বিশেষজ্ঞ এবং পলিসি মেকাররা অংশগ্রহণ করে। এখানে নির্ধারিত হয় যে জারোয়া দের সভ্য জগতের সাথে সম্পর্কে উৎসাহিত করা উচিত কিন্তু সেটা কি ভাবে , কতটা সময় নিয়ে এবং সভ্য জগতের সঙ্গে কতটা যুক্ত হবে সেটা জারোয়ারাই ঠিক করবে।সরকারের তাদের ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়ার কোন জায়গা নেই। ভারত সরকার এই মতামত গ্রহণ করে। বর্তমানে জারোয়া অধ্যুষিত অঞ্চলে এই সব কর্মসূচি গ্রহণ করা হচ্ছে।
১) জারোয়া দের সাথে আলোচনা করে তাদের সংস্কৃতি এবং দৈনন্দিন জীবনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রাথমিক শিক্ষার বই বানানো হচ্ছে।
২) জারোয়া অঞ্চল সংলগ্ন স্থানে তাদের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র চালু হয়েছে। নন -ট্রাইবাল রোগীদের সেখানে প্রবেশ নিষেধ।
৩) পৃথিবী জুড়ে অন্য প্রিমিটিভ জনজাতিদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে তাদের টিকাকরণের আওতায় আনা হলে তাদের প্রিজারভেশন বেটার হয়। এখানেও সেই চেষ্টা করা হচ্ছে।
জওহরলাল নেহেরু একদা বলেছিলেন -I don't want these tribes to be kept in a zoo nor to be made into our own clones .
আমিও তাই মনে করি। এরা কোন বাঘ ,সিংহ ,গন্ডার নয় যে এদের সংরক্ষিত বনে রাখতে হবে। আবার এদের আধুনিক সভ্য মানুষের ক্লোন বানিয়ে আমাদেরই একজন বানানোর দরকার নেই। এদের অস্তিত্বই তাহলে বিপন্ন হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১৭ সকাল ১১:৫৪