ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে চীন বেশ উদ্বেলিত। ট্রাম্প লোকটা প্রোটেকশনিস্ট ,আমেরিকায় ইমপোর্ট কমিয়ে দেশেই উৎপাদন বাড়াতে চায় ,আমেরিকান জন্য জব ক্রিয়েট করতে চায় --বক বক করার সাথে সাথে ইত্যাদি প্রভৃতি আরো অনেক কিছু করতে চায়। এখন আমেরিকায় সবথেকে বেশী এক্সপোর্ট করে চীন। চীনের অর্থনীতির এক বিরাট অংশ দাঁড়িয়ে আছে এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড ইন্ডাস্ট্রির ওপর ,কয়েক কোটি চাইনিজ এই এক্সপোর্ট এই সেক্টরে কাজ করে। চীনের অন্য বৃহত্তম এক্সপোর্ট মার্কেট গুলো হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন , মিডল ইস্ট ,জাপান এবং ভারত।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর দেশগুলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ঠান্ডা ,গ্রোথ সেরকম নেই। তেলের দাম কমে যাওয়ায় মিডল ইস্ট এর রমরমা অনেক কমে গেছে। চীন ঝগড়া করছে জাপান ,ভিয়েতনাম ,ফিলিপাইনস এবং আরো অনেক দেশের সাথে সাউথ চায়না সমুদ্র নিয়ে। নরেন্দ্র মোদী আসার পর ভারত তার ম্যানুফ্যাকচারিং বেস শক্ত করার চেষ্টা করছে। চীন তাহলে ট্রিলিয়নস অফ ডলার এর উৎপাদিত পণ্য রপ্তানী করবে কোন দেশে? মানে যদি আগের থেকে ২০-২৫% কম রপ্তানীও হয় সেটা চীনের অর্থনীতিতে এক বিরাট ধাক্কা দেবে--জব লস হবে এবং আনুষঙ্গিক অনেক সমস্যা দেখা দেবে।
কিন্তু চীনের প্রধান সমস্যা এটা নয়। তাদের টাইমবম্ব টিক টিক করছে অন্য জায়গায়। মরগ্যান স্ট্যানলির এক সম্প্রতি রিসার্চ রিপোর্ট জানাচ্ছে গত ১৫-২০ বছরে চীন এক ভয়ংকর ঋণগ্রস্ত দেশে পরিণত হয়েছে। কোন দেশ ঋণ গ্রহণ করে দুই স্তরে --সরকারী (দেশের সরকার এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত বানিজ্য সংস্থা গুলি ) এবং বেসরকারি সংস্থা গুলি। এখন ঋণ নেওয়া বিদেশ থেকে হতে পারে অথবা দেশের জনগণের থেকে। যার থেকেই নেয়া হোক না কেন সেটাকে সুদ সহ পরিশোধ করতে হয়।
ঋণ অভ্যন্তরীন হোক অথবা বিদেশ থেকে ,সরকারী হোক অথবা বেসরকারী --সেটাকে সুদ সহ পরিশোধ করতে হয়। চীনের ক্ষেত্রে এই অভ্যন্তরীন ঋণ এক ভয়ংকর জায়গায় পৌছে গেছে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। অর্থনীতিবিদরা একটি দেশ কতটা ঋণগ্রস্থ এটা পরিমাপ করতে একটা অনুপাত বা রেশিও ব্যবহার করেন -সেটা হচ্ছে প্রতি ডলার জিডিপি তৈরী করতে কত ডলার debt বা ঋণ ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০০৮ সালে অত্যধিক ঋণগ্রস্থ আমেরিকান অর্থনীতি যখন সাব -প্রাইম ক্রাইসিস এর কারণে আমেরিকা সহ সারা বিশ্ব কে নিয়ে অর্থনৈতিক মন্দায় পড়ে তখন সেখানে প্রতি ডলার জিডিপি তৈরী করতে ঋণ ব্যবহার হতো ৩ ডলার। এটা একটা ভয়ংকর অনুপাত --৩ ডলার ঋণ তৈরী করছে মাত্র ১ ডলার জিডিপি। এটা sustainable নয় । বিশ্বের অধিকাংশ বড় অর্থনীতির দেশগুলোর ক্ষেত্রে এই অনুপাত ১:১ অর্থাৎ প্রতি এক ডলার জিডিপি তৈরী করতে ঋণ ব্যবহার হয় এক ডলার। ইউরোপের কিছু দেশে এই অনুপাত ১: ১.৫--এই পর্যন্ত অনুপাত ঠিক আছে --এটা ম্যানেজ করা যায়। ঋণ -জিডিপি অনুপাত যদি ২ বা তার বেশি হয় তাহলে সেটা ডেঞ্জার জোন , মানে নদী বিপদ সীমার ওপর দিয়ে বইছে। ২০১৬ সালের শেষে চীনের ক্ষেত্রে এই অনুপাত পৌঁছেছে ৪.৫ এ। অর্থাৎ চীনের এখন প্রতি ডলার জিডিপি তৈরী করতে ঋণ লাগছে ৪.৫ ডলার। এটা এক ভয়ংকর অবস্থা। চীনের বর্তমান নমিনাল জিডিপি প্রায় ১২ ট্রিলিয়ন ডলার --এখন গণনা করে নিন তার ঋণ কত --১২ ট্রিলিয়ন ডলারের ৪.৫ গুন। আজ পর্যন্ত পৃথিবীর কোন দেশ এই বিশাল পরিমান ঋণ নিয়ে সারভাইভ করে নি --না আমেরিকা না ইউরোপের কোন দেশ। চীন কি পারবে? বিশ্বের জন্য এটা একটা বিরাট ইভেন্ট রিস্ক।
অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন এটা চীনের সমস্যা অন্যদের কি? ঘটনা হচ্ছে পৃথিবীর দেশগুলো এখন ইন্টার -ডিপেন্ডেন্ট। ২০০৮ সালে আমেরিকান সাব -প্রাইম ক্রাইসিস এর সময় আমেরিকার সাথে সাথে বিশ্বের বাকী দেশগুলোর কী হাল হয়েছিল সবাই দেখেছেন। মাত্র কয়েক বছর আগে অত্যধিক ঋণের কারণে গ্রীসের মত ছোট্ট দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা পুরো বিশ্বের অর্থনীতিকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলো। চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। চীনের অর্থনীতির পতন হওয়া জঙ্গলে মহীরুহের পতনের মতো হবে। জঙ্গলে বিশাল মহীরুহ যখন ভূপতিত হয় তখন তার আশেপাশের গাছেরা রক্ষা পায় না।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৩:১২